somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

হৃদয় গহীনে

১৪ ই ডিসেম্বর, ২০১৬ সকাল ৯:৫৯
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



অনেক আগের লেখা একটা গল্প সবার সাথে শেয়ার করলাম। আশাকরি সবার ভালো লাগবে-

মুক্তিযুদ্ধ যখন শুরু হয় সজলের বয়স তখন দশ কি এগারো বছর । গ্রামের মাষ্টার সাহেবের হাত ধরেই সেও চলে যায় যুদ্ধে । মাষ্টার সাহেব তাকে কোথায় রেখে যাবে ? এই যুদ্ধ সজলের বাবা, মা,ভাইবোন সবাইকে কেড়ে নিয়েছে। এমন কি ভিটাটুকু থাকলেও বাস যোগ্য ঘর বাড়ি সব জ্বালিয়ে দিয়েছে রাজাকার মুত্তালিব । বাধ্য হয়ে সজল গ্রাম ছেড়ে সামিল হয় মুক্তি সেনাদের তাবুতে। সবার ফাইফরমাশ খাটে আর মাঝে মাঝে বন্দুকের নল পরিস্কার করে । বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ কাজেও সে সাহসিকতার পরিচয় দেয় । আবার কখনো কখনো সে রান্নায় হাত বাটায় কুসুম খালার সাথে । বেশ আনন্দ সহকারে সে সব কাজ করে । যেদিন পাক সেনাদের ক্যাম্প দখল করে মুক্তিসেনার দল , সেদিন যেন ঈদের আনন্দ উৎসব বয়ে যায় তাবুতে । মাঝে মাঝে অবশ্য এই আনন্দ ফিকেও হয়ে যায় । যখন প্রিয় শহীদ বন্ধুকে সোনার মাটিতে ঢেকে দেয়া হয় । কখনো কখনো আবার আগ্নেয়গিরির লাভা , পাকস্থলীর অলিগলিতে যন্ত্রণার তাণ্ডবলীলা শুরু করে । যখন দিনের পরে দিন একফোঁটা দানা পড়ে না পেটে । তবুও সবার মাঝে প্রতিদিন নতুন সূর্যের আলো নতুনভাবে উদ্যমতা এনে দেয় আগামীর বিজয় প্রতীক্ষায়- কুয়াশা ভেদ করে সবুজ প্রান্তরে অগ্নিতপ্ত সূর্যোদয় হবেই হবে ।

মুক্তিসেনার দল প্রতিটা মুহূর্ত জয়ী হবার বাসনায়,চোখের পাতায় প্রিয়জনের উজ্জ্বল হাসিমুখ স্মরণ করেই; এক এক করে ছিড়ে ফেলে পৈশাচিক পাণ্ডুলিপির পাতা !
কনকনে শীতের রাত । না আছে গায়ে শীতের কাপড়, না পারছে আগুন জ্বালিয়ে উত্তাপ নিতে । নিশুতি রাতে জঙ্গলের মাঝে কুসুম খালার সাথে মশার কাপড়ে যন্ত্রণায় কাতর সজল । কুসুম খালা বুকের মাঝে জাপটে ধরেছে তাকে । একটা শব্দও যেন তার কানে না যায় । গুলির আর বোমার শব্দ , সেই সাথে মানুষের চিৎকার ! কুসুম খালা এত জোরে চেপে ধরেছে যে দম নিতেও কষ্ট হচ্ছে সজলের । খুব জোরে জোরে দোয়া পড়ছে কুসুমখালা , হঠ্যাৎ অনেক আলো জ্বলে উঠে। গরম বাতাস জানান দেয় পাশেই কোথাও ভয়াবহ আগুনের সূত্রপাত ঘটেছে । একসময় থেমে গেল সব কিছু , এমন কি কুসুম খালার দোয়া পড়া কন্ঠও । আশার প্রত্যূষে সত্যিই কুহেলিকা ভেদ করে সূর্য উঠেছে , সাথে নিয়ে প্রশান্তির জয়গান ! শুধু চিরতরে ঘুমিয়ে গেল কুসুম খালা আর মাষ্টার সাহেব ।

এবার ঘরে ফেরার পালা ---
নদী শুকিয়ে গেছে । শীতের এই দিনে ওপারে যেতে এখন আর নৌকা লাগে না । গ্রামের ছোট্ট সুন্দর নদীটায় ভেসে আছে নারী,পুরুষ , পশুপাখি আর জীবজন্তুর লাশ । ক্লান্ত পায়ে সজল হাঁটু পানিতে সাতার কাটে । মাঝামাঝি আসতেই কেউ বুঝি তাকে জড়িয়ে ধরে । আঁতকে উঠে সে , দেখে আট দশ মাসের একটা শিশু মায়ের বুকে জাপটে আছে লাশ হয়ে ।ঐ মায়ের চুল বেধেছে সজলের পায়ে । পচা দুর্গন্ধ পানি ঢকঢক করে গিলে খায় সে । চিৎকার দিয়ে কেঁদে ওঠে তারপর বহু কষ্টে ফিরে আসে জন্মতরী ভিটায় । কিন্তু একি ! সেখানে ঠায় দাঁড়িয়ে আছে সদ্য তোলা টিনের ঘর ! নাকে লাগে রান্নার ঘ্রাণ , পেটের মাঝে মোচড় দিয়ে বমি আসে । পায়ে একটুও জোর পায়না সজল । গোয়াল ঘরেই গরুর পায়ের কাছে নেতিয়ে পড়ে ।

পরবর্তীতে এই গোয়াল ঘরই হয় সজলের পরম শান্তির জায়গা । রাজাকার মুত্তালিব বুড়ী মায়ের অনুরোধে তাকে বাড়ীর কাজে রেখে দেয় । গোয়াল ঘরের লাল গরুটার সাথেই সজলের যেন নাড়ীর টান । রাতের অন্ধকারে ছেড়া মশারির মাঝে একটা চটের চাদর জড়িয়ে পরম প্রশান্তিতে ঘুমিয়ে পড়ে সজল । শীতের তিব্রতা ছুতে পারে না সজলের রক্তকণিকা । এভাবেই দিন যায় ,মাস যায়, যায় বছরের পর বছর ---
সজল এখন বাইশ বছরের টগবগে যুবক । সারা বছর যত না আনন্দিত হয় গ্রামের মানুষ , তার চেয়ে শীত মৌসুমের এই লগ্ন বেলায় আনন্দের বন্যা বয়ে যায় শতগুন । নাড়া , শন দিয়ে ঘর ছাউনি , নতুন ধানের পিঠা , খেজুরের রস, বরই , আর নতুন নতুন টাটকা সব শাকসবজি । সাথে থাকে বাড়তি পৌষমেলায় নাগর দোলা চড়া আর বাইস্কোপে সাহেব বিবির কিসসা দেখার মজা । গ্রামের মানুষের গায়ে তেমন কোন শীতের কাপড় নেই । নেই বাড়তি বিলাসিতা । তবুও কিছু ধান বিক্রি করে বা ধানের বিনিময়ে বউ ঝিয়েরা কেনে কাচের চুড়ী ফিতা , দেখে যাত্রাপালা ।
প্রকৃতির সাথে পাল্লা দিয়ে খুশি আর আনন্দের উচ্ছলতায় ভাসে গ্রাম । এমনই একদিনে সজল খালে নেমে গোসল দেয় গরুকে । রাস্তা দিয়ে হেটে যায় এক পথিক । সজল জানে না কেন এই পথিককে তার অনেক চেনা মনে হয় ।গরুর শরীর মাজন দিতে দিতে হাঁক দেয় -
-" ও---কাকা কেমন আছেন ?" ঘুরে দাঁড়ায় আগন্তক । এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে সজলের দিকে । তারপর বলে -
-"মারা যাবে , সব মারা যাবে ! শেষ হয়ে যাবে সব ! তুই পালা , তুই পা---লা ! বুম বুম "
সজল এবার উঠে আসে উপরে । সে যা ভেবেছিল তাই , রফিজ কাকা । তাহলে কাকা বেচে আছে ! একটা অপারেশনে বোমা নিক্ষেপ করেছিল এই রফিজ কাকা । সজলের মনে আছে ব্রিজের নিচে রফিজ কাকা ঠান্ডা পানির মধ্যে কচুরিপানার আড়ালে সজলের জন্য অপেক্ষা করেছিল দশটা ঘন্টা ধরে। সজল টিফিন কেরিয়ারে করে বোমা নিয়ে ব্রিজ পার হয়েছিল । বাচ্চা ছেলে দেখে মিলিটারিরা তাকে কিছুই বলেনি এমন কি কোন কিছু চেকও করেনি । রফিজ কাকা আর ফেরেনি তবে ব্রিজটি উড়িয়ে দিয়ে গ্রামের সাথে শহরের সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছিল এবং বেশকিছু টহলরত মিলিটারি সেদিন মারা গিয়েছিল ।
-"রফিজ কাকা তুমি বাইচা আছো !" জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে সজল । তা দেখে রফিজ বিরক্ত হয় । ছাড়িয়ে নেয় নিজেকে । বিরক্ত ভরা কন্ঠে বলে -
-"দূর দূর হ ! ছিঃ ছিঃ গায়ে হাত দিস কেন ! সব রাজাকার সব ! তুই রাজাকার , তুই রাজাকার ! "
হনহন করে হেটে যায় সে সামনের দিকে । সজলের মন খারাপ হয়ে যায় ।এই রফিজ কাকা সারাটা দিন দেশের গান গাইতো । সজলকে বলত -
-"হুনো কাকা, দেশের গান গাইলে অন্য রহম একটা শক্তি আহে গাঁয়ে ।তহন মনে লয় যা মনে চাইব তাই করতে পারুম ! ধর আমার লগে গান ধর -কারার ঐ লৌহ কপাট............!" কথাগুলো মনে করে আজ এতোটা বছর পরেও,সজলের বুকের ঢল বেয়ে ঝরঝর করে ঝরে পড়ে অশ্রু প্লাবন ! রাতে জ্যোৎস্নার আলোয় বাঁশের খুঁটিতে হেলেন দিয়ে চাদের দিকে তাকিয়ে থাকে সে । এই জীবন তার ভাল লাগে না । এই জীবন থেকে সে মুক্তি চায় । মুত্তালিব এখন এই গ্রামের মাতবর । সজলের সামনেই, এমনকি কখনও কখনও ওকে দিয়েও কিছু অসৎ কাজ করিয়ে নেয়।কিছুদিন আগে রিলিফের টিন এসেছিল । যা মাতবর নিজের ঘরে লাগিয়েছে । কিছু দিয়েছে নিকট আত্মীয়স্বজনকে আর বন্ধুদেরকে । বাকী টিন পুকুরের পানিতে লুকায়ে রেখেছে । এসব কিছুই সজলের মনের বিরুদ্ধে করতে হয় । মাঝে মাঝে ভাবে- যে রাজাকার তার জীবন অতিষ্ট করে দিয়েছে সেই রাজাকারেরই কাজের ছেলে হয়ে সে জীবিত ,আশ্রিত থাকবে ! না এ হতে পারে না ! তাকে তার পরিবারের করুণ পরিণতির প্রতিশোধ নিতেই হবে , যেভাবেই হোক । কিন্তু কিভাবে ! অনেক চিন্তা করে সে সিদ্ধান্তে পৌছে । কড়া একশিশি বিষ সে সংগ্রহ করে রাখে কিন্তু বুড়ী দাদীর কথা মনে করে সুযোগ পেয়েও মুত্তালিবকে খাওয়াতে পারে না ।ভাবে বুড়ীর একমাত্র সন্তান মুত্তালিব , মরে গেলে বুড়ী যে অনেক কষ্ট পাবে । ঈশ্বর মুত্তালিবের বিচার করবেন ,শাস্তি দিবেন । কিন্তু সজল মুক্তি চায় এই জীবন থেকে । একদিন সে হারিয়ে যাবে , তা যেভাবেই হোক ।
-"কিরে মুখপুড়া কারে নিয়া স্বপন দেখোস ! "
-"দাদী তুমি এই রাইতের বেলা ! ঠান্ডা লাগব তো !"
-"হ বুড়ী হইয়া গেছিতো তাই না !" মিটমিট করে হাসে বুড়ী । "এই নে তর মশারিতে পট্টি লাগাই দিসি , এহন আর মশাই তরে আদর করতে পারব না ।" সজল লজ্জা পায় । এই বুড়ী সজলকে অনেক বেশি ভালবাসে ।
- "আইজগো ঠান্ডা মনে লয় একটু কম কি কস মুখপুড়া!"
-"হ দাদী ।" আনমনা হয়ে জিজ্ঞাসা করে সজল "আচ্ছা দাদী তুমি আমার মাইয়ের গপ্প কউনা ,আইজগো মাইরে খুব মনে পরতাছে ।"
হুস করে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে বুড়ী ।
-"তর মা'ই দেখতে ছিল পরির নাহান ।মনডা ছিল আকাশের নাহান বড়। কি শীত কি ঝড় তর মায়ে আমারে না দেখলে যেন্ তার ঘুম আইত না । ঘরে যাই রান্না হইতো আমারে আর আমার মুত্তালিবরে না দিয়া খাইত না ।তর মা'য়ে আমার মুত্তালিবরে ছোড ভাইয়ের নাহান খুব আ-------- ।" বুড়ী চুপ হয়ে যায় । তার মুখে আর কোন কথা আসে না । ধরিত্রীর সব কথা যেন হঠ্যাৎ দূর আকাশের তাঁরা হয়ে গেছে । আনমনে সেই তাঁরার দিকে তাকিয়ে থাকে । ঝড়বেগে হৃদয় গহীন থেকে আবারো দীর্ঘশ্বাস বের হয়ে আসে ।অন্য খেয়ালে নিজের পেটে কয়েকটা চড় , ঘুষি মারে । সজল চাঁদের আলোতে দেখতে পায় দাদীর চোখে মুক্ত চিকচিক করছে । বুড়ীকে এমন করে পেটে মারতে অনেকবার দেখেছে সে ! কেন এমন করে ? জানে না সজল । বুড়ীর হাত ধরে এগিয়ে দেয় ঘরের দাওয়া পর্যন্ত ।

আজ বেশ খুশীর জোয়ার সবার মনেই। কারন জানতে সজল যায় মাতবরের খাস বন্ধু জমিলের কাছে । সেখানে সে হয় ব্যর্থ । কিন্তু তাকে যে জানতেই হবে কি এমন কথা ! যার জন্য চামচাদের নিয়ে মাতবর বৈঠক খানায় হাসাহাসি , গলাগলি করছে ! কিছুক্ষন পরিশ্রম করতেই রহস্য উদ্ঘাটনে সক্ষম হল সজল । এই গ্রামেরই মেয়ে শিউলি । সে এখন সিনেমার নায়িকা । বেশ টাকার মালিক সে । শিউলি দুইমাস আগে এসেছিল গ্রামে বাবা মায়ের কবর দেখতে আর গরীবদের খিচুড়ি খাওয়াতে । অবশ্য সজলের ছোটবেলার খেলার সাথিও ছিল এই শিউলি । কিন্তু তাতে কি ! এখন সে সজলকে চিনেনা । শিউলি গ্রামের গরীব নারী ও শিশুদের জন্য কিছু কাপড় পাঠিয়েছে মাতব্বরের কাছে । যা শুধুমাত্র গরীব নারী , শিশুদেরই প্রাপ্য । এই নিয়েই সবার আনন্দ । সজলও অনেক খুশি হয় । এটাতো সত্যিই অনেক আনন্দের । এই ঠান্ডায় মানুষগুলোর গায়ে গরম কোন কাপড় নেই ।গ্রামের শিশু ও বৃদ্ধ মানুষের ঠাণ্ডায় সর্দি কাশী , শ্বাসকষ্ট , লেগেই আছে । যাক ঈশ্বর মুখ তুলে তাকিয়েছে ! সজল শিউলিকে অনেক দোয়া দেয় ।
ঐদিন রাতের বেলা মাতবর সজলকে ডাকলেন ।আসতে আসতে বললেন-
-"শুন , কাল ভোরে গ্রাম জাগনের আগেই ভ্যানে কইরা কাপর গুলা গঞ্জে আমার যে দোকান আছে, ঐখানে পৌচাইয়া দিবি । ঠিক আছে ?"
-"কিন্তু কাকা এই কাপুরতো---!" বেশ ভয়ে ভয়ে কথাটা বললেও শেষ করতে পারেনা সজল । মাতবরের হাতের লাঠি এসে পড়ে পিছনে । মাতবর অগ্নিমূর্তি ধারন করেন ।
-"চুপ থাক হারামি ! আমার নুন খাস আর আমার মুখের উপ্রে কথা কস ! যা কইছি তাই হরবি ! যা কাপর গুলান ভ্যানে উডা ।"গজগজ করতে করতে অন্ধকারে মিলায় মাতবর মুত্তালিব ।
সজল বিড়বিড় করতেই থাকে । নিজেই নিজেকে গালি দিতে থাকে, ধিক্কার দিতে থাকে । সে এখন বুঝতে পারছে কেন রফিজ কাকা তাকে রাজাকার বলেছে । ভ্যানে সব কাপড় তুলে , সারা রাত লাল গরুটার মাথায় আদর করে আর কথা বলে । ছোট্র বেলার লাল গরুটা মারা গেলেও সজলকে নিঃসঙ্গ করে যায়নি , রেখে গেছে ছোট্ট বাছুরটিকে । সেই এখন ঠিক মায়ের মত হয়েছে । কিন্তু একি ! সজল নিজেও জানে না কেন তার অনেক কান্না পাচ্ছে ! সেতো সহজে ভেঙ্গে পড়ার মত ছেলে না । গরুটা জিভ দিয়ে আদর করে দেয় সজলের কপোলে , তাকে কিছু বলল সান্ত্বনার সুরে ! সজলের মনে হল তার হৃদয়ের কোণে কিছুটা আলোর ঝিলিক ধীরে ধীরে অমানিশার অন্ধকার সরিয়ে দিচ্ছে । মাতবরের লাঠির বাড়ীগুলো বেশ জোরে ছিল , শুতে তার অনেক কষ্ট হচ্ছে ।সজল একটু কাঁত হয়ে শোয় - দেখে মা তুলসী পুজা দিচ্ছে । দাওয়ায় বসে বাবা হুক্কাতে গড়গড় আওয়াজ তুলে বেশ আয়েস করে টান দেয় ।সজল লাল নীল কাগজে ঘুড়ি বানায় উঠানে বসে । প্রজাপতির মত ছুটে এসে জড়িয়ে ধরে চার বছরের ছোট্ট শিখারানি । আধো আধো সুরে বলে "দাদ্দা , শীত লাগে কোলে নেউ -চল রোদ পোহাই , পাটকাঠি দিয়ে কাঁচা রস খাই !" নাটাই ঘুড়ি রেখে পরম স্নেহভরে শিখারানিকে কোলে তুলে নেয় সজল । রোদ পোহাতে থাকে সে স্বর্গীয় আনন্দে । কিন্তু আজকে রোদটা এত কড়া কেন ! চোখে লাগে , ভীষণ চোখে লাগে ! চোখের উপরে হাত দেয় সজল । পিছনে বেশ জোরে কেউ লাথি মারে ।
-"ঐ হারামি এহনো ঘুমাইতেছোস নাক ডাইকা ! উঠ হালার পুত !" খুব কষ্টে চোখ মেলে তাকায় সজল । দেখে মাতবর টর্চের আলো ফেলেছে চোখে ।
- "কাকা অহন তরিতো সকাল হয় নাই ..." ঘুম জড়ানো কন্ঠে বলে সে । রেগে যায় মাতবর -
-"উঠ পান্তা খাইয়া বাইর হ ।হালার পুত একটা কাম যদি ঠিকমত করে , খালি খাওন আর ঘুম" গজগজ করতে করতে চেয়ার নিয়ে বসে উঠানে ।
-"হ সব কাজ আপনে করেন ! আপনের ঘুমও নাই খাওনও নাই । খালি আছে পেডের বিতরে শয়তানি বুদ্ধি !" সজল আপন মনে কথাগুলো বলে আর হাতমুখ ধোয় চাপকলের ধারে । তারপর চটের চাদরটা জড়িয়ে নেয় গায়ে ।
মুত্তালিবের প্রতিদিন সকালে একগ্লাস ইসুবগুলের সরবত খাবার অভ্যাস । আজ সরবতের স্বাদ হয় অন্যরকম , যা খেতে খারাপ লাগেনা রাজাকার মাতবর মুত্তালিবের । সজল তার নির্ধারিত এক সানকী পান্তা , দুইটা কাঁচা মরিচ আর লবন প্রতিদিনের মত খেতে শুরু করে । পান্তায় হাত দিতেই মনে হল আঙ্গুল গুলি অবশ হয়ে গেছে। কোন দিকে না তাকিয়ে ,অন্যরকম এক তৃপ্তিতে গপগপ করে খাওয়া শেষ করে । তারপর দাদীকে সালাম করে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেলে ।
-"দাদী আমারে মাফ কইরা দিও " বুড়ী হাসে । বলে-
-" ক্যা রে মুখপুরা ? শশুর বারি যাইতে আসোস আর আইবি না !? " কিছুই বলে না সজল ।
সজল বহুদিন পর মায়ের গায়ের গন্ধটা পায় দাদীর গা থেকেই । চোখ মুছে নেয় বাম হাতের চেটো দিয়ে তারপর রওনা দেয় গঞ্জের দিকে । তাল গাছের পাতার ফাঁকে কুয়াশা ভেদ করে উকি দেয় সূর্য । টপটপ করে ঝরে পড়ে গাছের পাতায় পাতায় জমে থাকা শিশির । সজল কিছু শিশির হাতে নিয়ে মেখে নেয় ফাঁটা ঠোঁটে-মুখে । তারপর তাকায় আকাশের দিকে । খুব বড় করে একটা নিশ্বাস নেয় । গায়ের জোর দিয়ে ভ্যান চালায় । রাস্তার মাঝখানে কিছু শিশু শুঁকনো পাতা জ্বেলে আগুন পোহায় । সজল বেশ ধীরে ধীরে ভ্যান থামায় । প্রতিটা শিশুর হাতে তুলে দেয় কিছু কাপড় । আবার সামনে এগিয়ে যায় গুন গুন করে গান গাইতে গাইতে -"মোরা একটি ফুলকে বাঁচাব বলে যুদ্ধ করি ........." আজ নিজেকে অনেক হাল্কা মনে হচ্ছে । যেতে যেতে আনন্দ সুখানুভূতিতে এভাবেই সব কাপড় বিলায় গ্রামের মানুষের মাঝে । তারপর উঠে পড়ে চলন্ত মালবাহী ট্রেনে । মুক্তিযুদ্ধের দীর্ঘ একযুগ পরে কিছুটা মুক্তির স্বাদ নিয়ে অন্যকোন মুত্তালিবের সন্ধানে এক অজানার পথে...! এবার আর গুন গুন করে নয় । কন্ঠটাকে রুদ্ধশ্বাসে আকাশের বুকে ভাসিয়ে দিয়ে গলা ছেড়ে গায়- "পূর্ব দিগন্তে সূর্য উঠেছে রক্ত লাল , রক্ত লাল , রক্ত লাল........." ট্রেন ছুটে চলে দুর্বার গতিতে , গানেরই ছন্দে--- ঝিকঝিক---ঝিকঝিক---ঝিকঝিক---।


ছবি গুগুল থেকে নেয়া।






সর্বশেষ এডিট : ১৪ ই ডিসেম্বর, ২০১৬ সকাল ৯:৫৯
২টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ব্যবহারে বংশের পরিচয় নয় ব্যক্তিক পরিচয়।

লিখেছেন এম ডি মুসা, ২৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১০:১৫

১ম ধাপঃ

দৈনন্দিন জীবনে চলার পথে কত মানুষের সাথে দেখা হয়। মানুষের প্রকৃত বৈশিষ্ট্য আসলেই লুকিয়ে রাখে। এভাবেই চলাফেরা করে। মানুষের আভিজাত্য বৈশিষ্ট্য তার বৈশিষ্ট্য। সময়ের সাথে সাথে কেউ কেউ সম্পূর্ণ... ...বাকিটুকু পড়ুন

মহিলা আম্পায়ার, কিছু খেলোয়ারদের নারী বিদ্বেষী মনোভাব লুকানো যায় নি

লিখেছেন হাসান কালবৈশাখী, ২৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:০৯



গত বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল প্রাইম ব্যাংক ও মোহামেডানের ম্যাচে আম্পায়ার হিসেবে ছিলেন সাথিরা জাকির জেসি। অভিযোগ উঠেছে, লিগে দুইয়ে থাকা মোহামেডান ও পাঁচে থাকা প্রাইমের মধ্যকার ম্যাচে নারী আম্পায়ার... ...বাকিটুকু পড়ুন

জানা আপুর আপডেট

লিখেছেন আরাফআহনাফ, ২৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:৫৭

জানা আপুর কোন আপডেট পাচ্ছি না অনেকদিন!
কেমন আছেন তিনি - জানলে কেউ কী জানবেন -প্লিজ?
প্রিয় আপুর জন্য অজস্র শুভ কামনা।



বি:দ্র:
নেটে খুঁজে পেলাম এই লিন্ক টা - সবার প্রোফাইল... ...বাকিটুকু পড়ুন

বন্ধুর বউ কে শাড়ি উপহার দিলেন ব্যারিস্টার সুমন। বাটার প্লাই এফেক্ট এর সুন্দর উদাহারন।

লিখেছেন নাহল তরকারি, ২৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:০৭



এক দেশে ছিলো এক ছেলে। তিনি ছিলেন ব্যারিস্টার। তার নাম ব্যারিস্টার সুমন। তিনি একজন সম্মানিত আইনসভার সদস্য। তিনি সরকার কতৃক কিছু শাড়ি পায়, তার জনগণের মাঝে বিলি করার জন্য।... ...বাকিটুকু পড়ুন

অধুনা পাল্টে যাওয়া গ্রাম বা মফঃস্বল আর ভ্যাবাচ্যাকা খাওয়া শহুরে মানুষ!!

লিখেছেন শেরজা তপন, ২৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৯:০০


দেশের দ্রব্যমুল্যের বাজারে আগুন। মধ্যবিত্তরা তো বটেই উচ্চবিত্তরা পর্যন্ত বাজারে গিয়ে আয়ের সাথে ব্যায়ের তাল মেলাতে হিমসিম খাচ্ছে- - একদিকে বাইরে সুর্য আগুনে উত্তাপ ছড়াচ্ছে অন্যদিকে নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যমুল্য... ...বাকিটুকু পড়ুন

×