-----------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
রেজাল্ট আনার দিন!
বাংলা সিনেমায়!
অভাবিনী দুঃখিনী মা যার লিপস্টিক আনতে নেলপলিশ ফুরায় "নো মেকআপ মেকআপ লুক" নিয়ে দাড়িয়ে আছেন। তার চোখে কাজল, মুখে কয়েক কেজি ফেস পাওডার, ঠোঁটে লিপস্টিক, আইব্রো আঁকানো! খোপা করা চুলগুলো জেনে বুঝে স্টাইল করে শুধু একদিকে পজিশন নিয়ে পেকেছে। গ্লিসারিন আর ফেস পাওডার এক হয়ে আটা হয়ে গলে পড়ছে মুখ দিয়ে।
নিজের মৃত স্বামীর ছবির দিকে তাকিয়ে, কাঁদতে কাঁদতে বলছেন, "ওগো, আজ তোমার ছেলের রেজাল্ট দেবে, ও নিশ্চই ফার্স্ট হবে! তুমি দেখে নিও!"
মৃত স্বামী কনফিউজড হয়ে ভাবছেন, আবার বউ ভবিষ্যৎ দেখতে পায় সেটা তো বেঁচে থাকাকালীন জানায় নি! ধোঁকা!
ওদিকে মায়ের ৪০ বছর বয়সী কলেজ স্টুডেন্ট ছেলে!! লিপস্টিক মেখে রেজাল্ট আনতে গিয়েছিল। রেজাল্ট দেখা মাত্রই পুরো কলেজ মানুষের সামনে "মা মা" করে চিল্লানো শুরু করে, এবং পুরোটা পথ চিল্লাতে চিল্লাতেই বস্তির বাড়িতে এসে মায়ের পা ছুঁয়ে সালাম করে জানায়, "মা আমি সাইন্সে বিএ পাস করেছি! ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট হয়েছি, এই দেখ পেপারে আমার ছবি!"
মা ছেলেকে বলেন, "আমি জানতাম বাবা, আমি জানতাম!"
বাস্তব জীবনে!
মায়ের অগোছালো চুল কোনভাবে হাত খোপা করা, মুখে পাওডারের লেশ নেই। হালকা ঘেমে আছেন।
ঘর ঝাড়ু দিতে দিতে মনে মনে বিড়বিড় করছেন, "আল্লাহ রেজাল্ট আনতে গেছে বদের হাড্ডিটা, সারাবছর পড়াশোনা করেনা, তবুও তুমি কোনভাবে পাশটা করিয়ে দিও!"
ওদিকে বদের হাড্ডি জ্যাম, গরম, ভীড়ের সাথে যুদ্ধ করে কয়েক যুগ পরে বাড়ি ফেরে এবং তার রেজাল্টের কথা মনেও থাকেনা। এসেই মায়ের কাছে ঠান্ডা পানি চায়।
মা পানি দিতে দিতে রেজাল্ট জানতে চাইলে, ছেলে জানায়, "ওহ! মা আমি ৩.৮ পেয়েছি!"
মা খুশি হয় ছেলে পাশ করেছে জেনে, ছেলের মাথায় হাত বোলাতে যাবে আদর করে এমন সময়ে ফোন আসে পাশের বাড়ির ভাবীর! সেই ভাবী কথায় কথায় জানান যে তার ছেলে পেয়েছে ৩.৮০১!
ইহা শুনিয়া মায়ের সকল খুশি গায়েব! ছেলের চৌদ্দগুষ্টি উদ্ধার করতে করতে তিনি খুন্তি আর জুতা নিয়ে ছেলের পিছে -----
কাউকে সাহায্য করা!
বাস্তব জীবনে:
একটি বাচ্চা মেয়ে রোদে মাথা ঘুরে পড়ে যাচ্ছিল। চায়ের দোকানে বসে থাকা যুবক ছেলেটি দৌড়ে ধরে ফেলল তাকে, মেয়েটিকে বসালো বেঞ্চে, চা মামাকে বলে মেয়েটিকে ঠান্ডা পানি খাওয়ালো। এর মধ্যে টুকটাক আলাপে ছেলেটি জানল মেয়েটি ক্লাস ৫ এ পড়ে, স্কুল থেকে বাড়িতে ফিরছিল, নাম সুমি। কিছুক্ষন পরে মেয়েটি একটু ঠিক অনুভব করতে থাকে। তখন ছেলেটি তাকে রিকশা ঠিক করে দিল।
সুমি যাবার সময়ে মিষ্টি হেসে বলল, "থ্যাংকস ভাইয়া!"
ছেলেটি বলল, "ব্যাপার না, এরপর থেকে ভালো করে খেয়ে বের হবে, আর ছাতা নেবে সাথে। যে গরমম!"
মেয়েটি মাথা নাড়িয়ে সালাম দিয়ে চলে গেল।
দোকানে বসা অন্য কাস্টমারেরা ছেলেটিকে ভালো কাজের জন্যে বাহবা দিল।
বাংলা সিনেমায়:
একটি বাচ্চা মেয়ে মাথা ঘুরে পড়ে গিয়ে রাস্তার কোনে থাকা বড় পাথরে গিয়ে বাড়ি খেল, সাথে সাথে তার মাথা ফেটে রুহআফজা থুক্কু রক্ত পড়তে থাকে । মুহূর্তেই ঈদের ট্রেইনের সমান ভীড় হয়ে গেল মেয়েটির চারিপাশে। তামাশা উপভোগ করা মানুষগুলোকে টপকে মেয়েটির কাছে পৌঁছে গেলেন আমাদের নায়ক। নায়ক সাহেব মেয়েটিকে কোলে নিয়ে কোন ধরণের যানবাহনের সহায়তা না নিয়ে!!! দৌড়াতে দৌড়াতে হাসপাতালে গেলেন।
নায়ক হাসপাতালে ঢুকেই চিৎকার করতে করতে বলে, "ডাক্তার সাহেবববব, কোথায় আপনি! জলদি ওর চিকিৎসা করুন, খুব রক্ত বেড়োচ্ছে!"
এক রুম থেকে বের হয়ে ডাক্তার মেয়েটিকে চেক করে ঘাবড়ে গেলেন, বললেন, "এটা পুলিশ কেস! পুলিশ আসার আগে ট্রিটমেন্ট শুরু করা যাবেনা।"
নায়ক ভয় পেয়ে গেল, যদি পুলিশ আসিবার পূর্বে রোগীটি মারা যায়?
নায়ক ডাক্তারের কলার চেপে ধরল, পাশে দাড়িয়ে থাকা নার্সের ট্রে থেকে ইনজেকশন নিয়ে ডাক্তারের দিকে তাক করে বলল, "এই ডাক্তারের বাচ্চা ডাক্তার, জলদি চিকিৎসা শুরু কর, পুলিশ আসতে আসতে যদি মেয়েটার কিছু হয় তোকে ছাড়বনাআআ!"
নায়কের ধমকিতে চিকিৎসা শুরু করার পূর্বে ডাক্তার সাহেব একটি জ্বালাময়ী প্রশ্ন করলেন, "মেয়েটি আপনার কে হয়?"
রোদের দিনে হুট করে বজ্রপাত শুরু হয়ে গেল, আকাশে চার চারটি বজ্রপাত হবার পরে আবেগঘন কন্ঠে নায়ক বলল, "ও আমার বোন, আদরের ছোট বোন!" (জ্বী হ্যাঁ ছবির নামও তাই, "আদরের ছোট বোন")
মেয়েটির প্রচুর রক্ত দরকার। অপারেশন থিয়েটার থেকে বেড়িয়ে ডাক্তার চিন্তিত মুখে বললেন, "রেয়ার ব্লাড গ্রুপ কিভাবে ম্যানেজ করা যায়!"
ব্লাড গ্রুপ ম্যাচ করবে কিনা সেই বিষয়ে কোন চিন্তা না দেখিয়ে বীর নায়ক বলে দিলেন, "আমার শরীরের সকল রক্ত নিয়ে হলেও ওকে বাঁচান!"
সাকসেসফুল অপারেশন শেষে, কাজল, লিপস্টিক, আইশ্যাডো, দুল, চেইন, ফ্রক সবকিছু অখ্যত অবস্থায় থাকা বাচ্চা মেয়েটি বলল,
"ভাইয়া, ডাক্তার আংকেল বলল, তুমি আমার জীবন বাঁচিয়েছ!"
নায়ক বলল, "কি বললি তুই? কি বললি আবার বল!?
মেয়েটি বলল, "ভাইয়া ভাইয়া ভাইয়া!"
আবারো দুটি তিনটি বজ্রপাত হলো এবং নায়ক মেয়েটিকে জড়িয়ে ধরে "বোন আমার" বলে কাঁদতে থাকল।
(কয়েক সিন পরে জানা যাবে যে আসলেই মেয়েটি নায়কের হারিয়ে যাওয়া বাবা মায়ের সন্তান! )
কলেজের প্রথম দিন:
বাংলা সিনেমায়:
সুন্দরী নায়িকা আইশ্যাডো, আইলাইনার, লিপস্টিক, ব্লাশ অন, ফলস আইল্যাশেস, লিপগ্লস, ফেস পাওডার, মাশকারা, নেলপলিশ, জুয়েলারী, ফেক কার্লি হেয়ার, শর্ট ড্রেস পড়ে, হাই হিল পড়ে - একটি চিকন ডায়েরী বুকে জড়িয়ে কলেজে এসেছে নিজের একদল বান্ধবীদের নিয়ে! ডায়েরীতে পড়ার কোন কথা নেই, সে নায়কের সাথে যেসব গান গাইবে তা লেখা। তার বান্ধবীরা কেউ বেশি বয়স্ক আবার কেউ বেশি পিচ্চি, কেউ বেশি মোটা, কেউ বেশি চিকন। তবে একটা ব্যাপার কমন, গ্রুপের কাউকেই কলেজ স্টুডেন্ট মনে হচ্ছেনা (#ক্রিয়েটিভিটি আনলিমিটেড!)
নায়িকাকে দেখামাত্র ভিলেন প্রেমে পড়ে যায় এবং নায়িকাকে বলে, "সুন্দরী একা নাকি!?"
সুন্দরী নায়িকা বলে, "নাহ সাথে স্যান্ডেলও আছে," বলেই স্যান্ডেল দিয়ে ভিলেনকে চড় মেরে হিল পায়ে ঠকঠক শব্দ করতে করতে চলে যায়।
একই দিনে নায়ক নায়িকার ধাক্কা লাগে। ভদ্র ও শিক্ষিত মানুষের মতো "সরি" না বলে এ বিষয়টিকে কেন্দ্র করে দুজনে নোংরা ভাবে ঝগড়া করে ওয়ার্ল্ড ওয়ার বাঁধিয়ে দেয়। একে অপরের ক্লাস, পারিবারিক শিক্ষা, স্ট্যাটাস নিয়ে খোঁটা দেয়। ঝগড়ার এক পর্যায়ে হুট করে নায়ক একদল বন্ধুকে নিয়ে গান ও নাচ শুরু করে দেয়।
ওহ সুন্দরী, বলো না গো সরি! (কোরাসে সরি সরি সরি)
এক ধাক্কায় মনে দিলাম ঠাঁই তোমায়, ওগো পরী! (পরী পরী পরী)
নায়িকাও কিছুক্ষন বিরক্তির অভিনয় করে, পরে সুর মিলিয়ে গান গাইতে শুরু করে
ওগো মনের মানুষ, বললাম তোমায় সরি! (সরি সরি সরি)
আমিই তোমার ডানাকাটা পরী (পরী পরী পরী)
প্রতিবার সরি ও পরী বলার জায়গাগুলোতে নায়ক ও নায়িকার বন্ধু ও বান্ধবীরা একে অপরের সাথে দল বেঁধে লাফিয়ে লাফিয়ে নাচের চেষ্টা করতে থাকে।
ওদিকে ভিলেন ভাবতে থাকে, শুধু একা নাকি জিজ্ঞেস করায় থাপ্পড়! আর ওদিকে নায়ক বড়লোকের অহংকারী মেয়ে বলে গালি দিয়ে, জোর করে কোলে তুলে নাচার পরে নায়িকা প্রেমে পড়ে যায়! দ্যা ব্যাড বয় অফ আওয়ার মুভি থিংকস, "গুড গাইজ একচুয়ালী ডাজন্ট উইন দ্যা রেস!"
বাস্তব জীবনে:
কাজল, ফেসপাওডার, লিপস্টিক দিয়ে, সুন্দর করে চুলগুলোকে গুছিয়ে মেয়েটি বাবার ঠিক করে দেওয়া রিকশায় রওয়ানা দেয় প্রথমদিনের কলেজে। কলেজে যেতে যেতে তার সকল মেকআপ গলে যায় সূর্য মামার কল্যাণে, আর চুলগুলো বাতাসে অগোছালো হয়ে যায়।
এই অবস্থায় তার দেখা হয় বড় ভাই (ভিলেনের) সাথে।
বড় ভাই: "নাম কি?"
মেয়েটি: "মিহ মিহ মিহ লি!"
বড় ভাই: তোতলাচ্ছ কেন? ভয়ের কিচ্ছু নেই!
মেয়েটি: জ্বি জ্বি ভাইয়া।
বড় ভাই: তো কোথাকার আমদানি?
মেয়েটি: "বগুড়া!"
বড় ভাই: আচ্ছা বগুড়ার কি বিখ্যাত? দই, তাই না? কালকে আমাদের সবার জন্যে দই আনবে। ঠিক আছে?
মেয়েটি মাথা নেড়ে সম্মতি জানায়।
বড় ভাই: এখন যাও ঐ বটগাছে কতগুলো পাতা আছে গুণে এসো।
মেয়েটি বাধ্য হয়ে গুণতে চলে যায়।
সেখানে পরিচয় হয় আরেকটি নতুন ছেলের সাথে যে নিজেও পাতা গোণায় ব্যস্ত। পাতা গুণতে গুণতে দুজনের পরিচয় হয়। তবে পরিণয় হয়না কেননা ছেলেটি শান্ত, মেয়েটি লাজুক। পুরো কলেজ নেচে গেয়ে বেড়ানো তো দূরের ফোন, ফেসবুক চাইবার সাহসও কারোর নেই।
সেদিন পাতার গোণার মধ্যেই মৃত্যু হয় একটি "হলেও হতে পারত" প্রেমের!
-----------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
শেষ কথা: এমন প্রচুর ঘটনা আছে যা নিয়ে লেখা যায়, তবে লেখা বড় করতে চাইনি তাই কয়েকটি দৃশ্য দিলাম। সবার ভালো লাগলে আরো পর্ব করব।
সবচেয়ে জরুরী কথা, বাংলা সিনেমার গল্পগুলো একটু বেশি অবাস্তব, রং মাখানো তবে অনেককে প্রচুর বিনোদন দিয়ে গিয়েছে যুগ যুগ ধরে। তাই সিনেমার সাথে জড়িত কারো প্রতি কোন অসম্মান প্রদর্শন করে এই রম্য লেখা হয়নি। মৃতপ্রায় সিনেমা ইন্ডাস্ট্রি আবারো জেগে উঠবে সেই কামনায় শেষ করছি।
ছবিসূত্র: অন্তর্জাল!
সর্বশেষ এডিট : ২৬ শে আগস্ট, ২০১৯ সন্ধ্যা ৬:৪৬