১) গরু আনার দিন!
আমাদের পরিবার থেকে বেশ বড়সর একটা দলই যেত কোরবানীর হাটে। বাবা, চাচা, ফুফা, কাজিন ব্রাদাররা সবাই একটা দিন সেট করে একসাথে যেতেন। দলে গেলে বিক্রেতা ঠকাতে পারবে না সেটাই হয়ত কারণ ছিল। ছোটদের নিয়ে যাওয়া হতো কেননা বড় হয়ে ওদেরও এসব করতে হবে, তাই একটু ট্রেইনিং দেওয়া আরকি। আর ওদেরও হাটে যাবার ভীষন আগ্রহ।
দাদু বলতেন, গরু ঈদের বেশ আগেই কেনা উচিৎ, তাহলে মায়া বাড়বে তার প্রতি এবং কোরবানী ত্যাগের হলে আল্লাহর দরবারে কবুল হবে। তার কথা অক্ষরে অক্ষরে পালন করা হতো।
হাটে যাবার দিন কাজিনগুলোর কি ভাব! স্কুলে পড়ত কিন্তু এমন একটা এটিটিউড যেন পুরুষমানুষ হয়ে গিয়েছে - বাড়ির মুরুব্বী! আমাদের মেয়েদের কোন পাত্তাই দিতনা সারাদিন! বড়দের সাথে "বাজেট" আলোচনায় বসে গম্ভীর মুখে মাথা নাড়ত (এবসোলুটলি কিসসু বুঝত না )।
এক কাজিন আবার বলত, "হাত পা একটু টিপে দে রে, কাল হাটে অনেক ঘুরতে হবে!" এমন মেজাজটা গরম হতো! টিপে দেবার নামে দু চারটা কিলও দিয়ে দিতাম।
যাই হোক, একদিকে পুরো দল কোরবানীর হাটে যুদ্ধ জয় করতে বেড়িয়ে যেত। অন্যদিকে কাজিন সিস্টাররা মিলে, বাড়িতে বসে বসে পায়চারী করতাম আর গেস করতাম কেমন গরু হবে, কত বড় হবে, কি রং হবে ইত্যাদি অনেককিছু। ঈদের পুরো আনন্দটাই নির্ভর করবে গরু কেমন তার ওপরে তাই একটু পরে পরে বারান্দা দিয়ে উঁকি মারা আর গরু আসলেই চিল্লানো, "এসেছে এসেছে, ঐ যে ওটা আমাদেরই......
২) প্রিয় রমিজ চাচা!
গরু একবার আসার পরে বাড়ির বাচ্চাদের নাওয়া খাওয়া বন্ধ। এমনকি নানা রকমের দুষ্টুমি করে বড়দের জ্বালানোও বন্ধ। গরুর পিছেই পড়ে থাকত সবাই। মা, চাচীরা টেনে আনতে পারতেন না, আর আনলে গোসলের একটু পরেই সবাই আবার ভ্যানিশ!
দাদার বাড়ির সামনে বিশাল একটা উঠান ছিল। প্রথমে লম্বা বারান্দা, সেই বারান্দার দরজা খুললেই উঠান। উঠানের একপাশ ঘেঁষে গাছ আর গাছ - নানা রকম ফুল, ফল, মেহেদীরই কয়েক প্রকার গাছ। একটি কর্নারে ছোটখাট ঘরও ছিল যাতে আসবাব বলতে একটা খাট আর টেবিল ফ্যান। সেখানে রমিজ চাচা বিশ্রাম নিতেন ঈদের সিজনে। ওহ রমিজ চাচা কে সেটাই তো বললাম না।
গরুর খেয়াল রাখার জন্যে সার্বক্ষনিক একজন থাকতেন যার নাম ছিল রমিজ চাচা। খুবই পাতলা, কাঁচা পাকা দাড়ি, রুগ্ন স্বাস্থের, হাসিখুশি এক মানুষ ছিলেন তিনি। রমিজ চাচা খড়, ঘাস ইত্যাদি ব্যবহার করে গরুর জন্যে ঠিকঠাক খাবার বানাতেন। কিন্তু এসব স্বাভাবিক জিনিসে তো আমাদের বাড়ির বিচ্ছুদের ভালো লাগত না। কাজিন ব্রাদারগুলো লুকিয়ে লুকিয়ে ঘরের রান্না (ভাত, ডাল, মাছ, মাংস, চিপস) গরুকে খাওয়াতে নিয়ে যাবার প্ল্যান করত।
এখানেও ছেলে ভার্সেস মেয়ের ঝগড়া হতো। খাবার চুরি করার প্ল্যানটা আমাদের মেয়েদের ভালো লাগত না। আমাদের ক্লিয়ার লজিক ছিল, রমিজ চাচা অবশ্যই আমাদের চাচাকে জানাবেন আমাদের বাদরামীর কথা, যেহেতু তিনি ওনার লোক। আর মা চাচীরা যদি জানেন রান্নাঘরের খাবার এমন "মহৎ উদ্দেশ্যে" গায়েব হচ্ছে তাহলে আর বাঁচার উপায় থাকবেনা।
ছেলেরা বলত, রমিজ চাচাকে ম্যানেজ করে নেবে। আমরা সায় দিতাম না কেননা ওরাই যে প্রতিবারের মতো উল্টো ম্যানেজড হয়ে চলে আসবে জানতাম। আমরা শুধু দূরে দাড়িয়ে মজা দেখতাম।
যখন ওরা উল্টোপাল্টা খাবার নিয়ে যেত, রমিজ চাচা হৈ হৈ করে উঠে মানা করতেন। ওরা বোঝানোর চেষ্টা করত, গরুরও তো নানা রকম খাবার খেতে ইচ্ছে করে। ওসব খাবারের পুষ্টিগুণ নিয়ে লেকচার দিত রীতিমত। তার কথা কেউ শুনছে না দেখে চাচা শুধু একটা কথাই বলতেন, "আইচ্চা দাও, বৈকালবেলা তোমাগো চাচা আইবো, তহন.....।" উনি বাক্য শেষ করার আগেই সবগুলো পালাত!
ছেলেদের এই একটা জিনিস আমরা মেয়েরা কোনভাবেই বুঝে উঠতে পারতাম না। নিশ্চিত ফেইলড প্রজেক্ট জেনেও ট্রাই করবে! সবকিছুতে বীরত্ব দেখাতে হবে। প্র্যাক্টিক্যাল, লজিক্যাল রিজনিং এসব ওদের ডিকশনারিতে থাকেইনা। কি আজব এক নমুনা!
৩) প্রতিবেশী বাচ্চাদের সাথে তেড়িবেড়ি!
আমাদের এক প্রতিবেশী বিশাল যৌথ পরিবারে থাকতেন এবং তাদের ছিল বড় ব্যবসা। তারা বেশ সম্মানী মানুষ ছিলেন পুরো পাড়ায়।স্বাভাবিকভাবেই তাদের গরুর সাইজ আমাদের চেয়ে বড় হতো। ঐ বাড়ির বাচ্চাগুলো মাটিতে পা ই ফেলত না গর্বে। পাড়ার সবচেয়ে বড় গরুটা ওদের!
দুইজন বেশি টগরা ছিল, একটা শ্যামলা মতোন মেয়ে, সবসময় হর্সটেইল করে রাখত। আর একজন ভাইয়া (মেয়েটির কাজিন ছিল সম্ভবত), তিনি বেশ বড়ই ছিলেন আমাদের চেয়ে। তবুও মজা করতেন সবার সাথে। ওরা একটা দল নিয়ে আমাদের গরুটা দেখতে আসত আর বলত, "ওমা এটা ছাগল না গরু!?"
আমরাও তো কম যাইনা। এক কাজিন বলত, "ছাগল দেখতে হলে আয়নায় দেখ। ভালো জাতের গরুর সাইজ এমনই হয়। এখন আমরা ব্যস্ত, পরে আসিস!"
ওরা বলত, "হ্যাঁ তাতো হবেই, এই পিচ্চি গরুটাকে খাইয়ে খাইয়ে আমাদেরটার মতো মোটা করার চেষ্টা করছ না!"
কাজিন: আমাদের ফ্যামিলিতে কেউ মোটা হয়না, মোটা হলে কত রোগ হয় জানিস না!? (বলে রাখা ভালো ওদের পরিবারে সবার একটু মোটার ধাত ছিল)।
এর কোন শেষ ছিলনা, কোনদিন আমরা ওদের গরু দেখতে যেয়ে, সেই গরুর গায়ে কত দাগ, কত বিশ্রী দেখতে ইত্যাদি বলতে যেতাম। মানে পুরোই মাথা খারাপ অবস্থা।
আমি ওদেরকে ডাইরেক্টলি কখনো কিছু বলতাম না, কেননা আমার অন্য কাজিনরা ঢাকায় থাকত, দাদির বাড়িতে অথবা আশেপাশে। কিন্তু আমি বাবার চাকরির সুবাদে দূর শহরে থাকতাম, আর ঈদে যেতাম। তাই অস্বস্তি হতো পায়ে পায়ে লাগিয়ে ঝড়া করতে। আরেকটা ব্যাপার হচ্ছে, আমি শান্ত এবং ভীতু ছিলাম কাজিনদের তুলনায়। তো ওরা মারামারি কত, আমি মজা করে দেখতাম।
৪) ঈদের দিন!
খুবই ব্যস্ত একটা দিন, কোরবানীর ঈদে বড়দের মজা করার জায়গা খুব কম থাকে। পুরোটা দিনই কাজে কাজে চলে যায়।
আমাদের লম্বা একটা বারান্দা ছিল। সেটা খুব ভালোভাবে পরিষ্কার করা হতো। বাইরে থেকে একেক ব্যাচ মাংস প্রসেসড হয়ে আসত আর বাড়ির মহিলারা গোল হয়ে বসে মাংস ভাগবন্টন করতেন। আত্মীয়দের, গরীবদের ভাগ প্যাকেটে করে গ্রুপে রেখে দেওয়া হতো। দাদি গাইড করতেন সবাইকে।
এই কাজটায় আমাদের মেয়েদের স্পেসিফিক্যালি ডাক পড়া শুরু হলো যখন আমরা সবে কিশোরী হতে শুরু করেছি। শুধু এই কাজই নয়, মা চাচীরা খাবার হাতে দিয়ে টেবিলে রেখে আসতে বলতেন। মেহমান আসবে বলে ঘরে ঘরে নতুন কুশন, বেডশিট, ফুলদানী দিয়ে ঘর সাজাতে বলতেন। মোটকথা, বাড়ির কাজে আমাদেরকে সামিল করতে চাইতেন যেহেতু ভবিষ্যতে আমাদেরকেও এসব করতে হবে!
তখন আমাদের ভাব আর দেখে কে? কাজিন ব্রাদারদের বলতাম, উফফ! একটা গুরুত্বপূর্ণ কাজ আমাদের ছাড়া হয়না। কেউ কেউ তো হাটে বেড়াতে গিয়েই ঝাড়া হাত পা, আর বাকি সব জরুরী কাজ করতে করতে হাত পা সব ব্যাথা হয়ে গেল........
৫) রাতের অন্ধকারে চোখের জল!
কোরবানীর সময়ে বারান্দা থেকে জবাই দেখতে দেখতে আমরা মেয়েরা একপ্রস্থ কেঁদে নিতাম কিন্তু ছেলেরা কাঁদত না সবার সামনে। বিশেষ করে হালকা গোঁফ গজানো শুরু করেছে এমন "বড় পুরুষমানুষ!!" দের তো সবার সামনে কান্না মানায় না।
ব্যস্ত একটা দিন শেষে যখন মেহমানেরা চলে যেতেন, পুরো বাড়ি নিস্তব্ধ মনে হতো। সারাদিনের হৈ হল্লার পরে অদ্ভুত একটা নীরবতা। এই নীরবতায়, বড়দের বিশেষত বাড়ির বউদের চোখে মুখে একটা প্রশান্তি দেখতে পেতাম যেটা বলত "যাক সারাদিনের এত দায়িত্ব ঠিকভাবে পালন হলো।" অন্যদিকে ছোটদের শুন্যতা ভর করত, এতদিন যেই গরুটাকে নিয়ে মেতে ছিল সবাই, তাকে আজ চোখের সামনে চলে যেতে দেখলাম।
অন্ধকার ড্রয়িংরুমে সবাই মন খারাপ করে বসে থাকতাম। আমাদের গরুটার মায়াবী চোখের কথা মনে পড়ত, কোরবানীর দৃশ্যটা বারবার মনে ভেসে উঠত। আমরা যখন ওর এত দেখভাল করতাম, মনে একবারো আসত না যে ওকে কদিন পরেই মেরে ফেলা হবে! হাউমাউ করে কান্না আসত। গরুটাকে ভালোবেসেছি সমানে, তার চলে যাওয়ায় সবাই কাঁদতামও একই সুরে। বড়রা দেখে বলতেন, ওরা যেভাবে কষ্ট পাচ্ছে তাতে মনে হয় ওদের কোরবানীটা কবুল হবে!
ঈদের সেই একটা সময়ে, ছেলে মেয়ের দ্বন্দটা একেবারে মিটে যেত........
শেষ কথা: নিচের কথাগুলো অন্য পোস্টেও বলেছি, আবারো বলছি কেননা আমি চাই বেশি মানুষের কাছে এই কথাগুলো পৌঁছাক। এবারের ঈদ অন্যবারের চেয়ে আলাদা সেটা আমরা সবাই জানি, কিন্তু মানতে কি পারব? ভীড় থেকে দূরে থাকা, বারবার হাত স্যানিটাইজ করা, বাইরে গেলে মাস্ক/গ্লভস এর ব্যবহার ইত্যাদি সবাইকে করতে হবে - ঈদের মধ্যেও! ধর্মীয় আচারগুলো যতটা সম্ভব সোশ্যাল ডিস্ট্যান্স রেখে পালন করতে হবে। ইসলাম সরল ও সুন্দর, জীবন বাঁচানো ফরজ আমাদের ওপরে। পরিচিত হুজুরদের সাথে কথা বলে জেনে নিন ইসলামের আলোকে কিভাবে জীবনকে নিরাপদে রেখে ধর্মপালন করা যায়?
তারচেয়েও দরকারি কথা - এবারে নাহয় ঈদ শপিংটা নাই করলেন। কিছু সেভিংস হলো টাকা ও জীবনের! আত্মীয়দের বাড়ির দাওয়াত, পার্ক/চিড়িয়াখানায় বেড়ানো, ঈদ মোবারক বলে প্রতিবেশীদের সাথে কোলাকুলি নাহয় পরের বছরের জন্যে তোলা থাক? মনে রাখবেন, আপনার ভুলে শুধু আপনিই নন, আপনার আপনজন থেকে শুরু করে আশেপাশের অনেক গরীব মানুষও আক্রান্ত হতে পারেন। তাই নিরাপদে থাকুন, নিরাপদে রাখুন - সুস্থতাই হোক এবারের ঈদের লক্ষ্য। ঈদ মোবারক সবাইকে!
ছবিসূত্র: অন্তর্জাল।
সর্বশেষ এডিট : ০১ লা আগস্ট, ২০২০ সন্ধ্যা ৭:২৭