এই পোস্টটি মূলত নতুন সিরিজ আসার আগমনী বার্তা। আবার একদিক দিয়ে দেখলে আমার জীবনে প্রবাসের আগমনী বার্তাও বটে।
আমি সাধারণত কোন সিরিজ শুরু করলে শেষ করতে পারিনা। সেজন্যেই হয়ত ছোট্ট একটা সিরিজ আনা - যদিও এটা শেষ করতে পারবনা কিনা জানিনা। সবসময় বিদেশে যাবার পরে কি হলো সেসব নিয়ে লেখা হয়েছে, দেশে জীবন কেমন কেটেছে সেসব নিয়েও লিখেছি। কিন্তু বিদেশে যাবার পথে কতসব ইন্টারেস্টিং ঘটনা ঘটেছে সেসব শেয়ারই করা হয়নি। প্রবাসের পথে মানে মফস্বল থেকে ঢাকা এবং সেখান থেকে প্লেনে করে নানা দেশ পেড়িয়ে কানাডায় যাবার জার্নিটা ছিল ভয়, দু:শ্চিন্তা, উত্তেজনা, যন্ত্রণা, আনন্দ, অস্বস্তি, অজানার! জীবনের খুব কম অভিজ্ঞতাই এত আবেগের মিশেল হয় - কেননা সাধারণত আমরা কোন ব্যাপারে খুশি হই অথবা দুঃখ পাই। কিন্তু দেশ ছেড়ে বিদেশে যাবার ব্যাপারটায় পাওয়ার আনন্দ এবং ছেড়ে যাবার বেদনা দুটোই কড়া পরিমানে থাকে। সাতরঙ্গা আবেগের এক অদ্ভুত রোলার কোস্টারে যাত্রার পূর্বে সবাই সিটবেল্ট টাইট করে বেঁধে নিন।
-----------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
কাঠফাটা রোদে সবাইকে পাখা বেচে বেড়ানো রুগ্ন লোকটি দরদরে করে ঘামছে। একটা ছেড়া ও ময়লা জামা পরা কিশোর ছোটদের রঙিন ছবিওয়ালা অ আ শেখার/গল্প/ছড়ার বই ফেরি করতে করতে একনাগাড়ে বলে চলেছে "লেখাপড়া করে যে গাড়িঘোড়া চড়ে সে!" অতিরিক্ত গরমে অন্য একটি বিশাল গাড়ির বাচ্চাটা কেঁদে কেঁদে উঠছে। তারই বয়সী আরেক বাচ্চা ভারী একটি বাক্সে নানা ধরণের চকলেট, লজেন্স, চুইংগাম, ছোট্ট চিরুনী বিক্রি করে বেড়াচ্ছে খালি পায়ে। কন্দ্রনরত বাচ্চার মা সেই শিশুটির কাছ থেকে বেশ কিছু চকোলেট কিনে নিল। তেল দেওয়া দুই বেণী করা, ফুল ফুল ফ্রক পড়া মেয়েটির হাত থেকে আধখাওয়া আইসক্রিম হুট করে পড়ে গেল আর সে ছলছল চোখে নিজের বাবার দিকে তাকাল। অভাবী বাবা কটমট চোখে তাকাল মেয়ের দিকে কিন্তু রাগ ধরে রাখতে না পেরে আবারো কুলফিওয়ালাকে ডাক দিল।
ভীড়ের মাঝের মানুষদের জীবনের ছোট ছোট গল্পগুলো খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে ভালো লাগে। নানা রকম মানুষের ভিন্ন গন্তব্যের আলাদা পথগুলো থেমে গেছে এই এক জায়গায়। বিত্ত আর অভাবের কত গল্প থাকে একেকটি ফেরিঘাটে!
প্রতিবার ঢাকায় যাবার সময়ে মনে অন্যরকম আনন্দ থাকে। দাদার বাড়ি - নানার বাড়ি সব সেখানেই। এত বেশি মজায় সারাটা দিন কেটে যায় যে নিজেদের মফস্বলের বাড়িতে ফিরতে ইচ্ছে করেনা। কিন্তু জীবনে এই প্রথমবার মনে হচ্ছে গাড়িটা উল্টোদিকে নিয়ে ঘরের দিকে যেতে। কিচ্ছু ভালো লাগছেনা। আর কোনদিন মফস্বলের নীড়ে ফেরা হবেনা। স্কুলের বন্ধু ও টিচারদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে এসেছি। আামাকে ফ্রি চকলেট দেওয়া দোকানদার চাচুটাকেও জানানো হয়ে গেছে। চুরি করে দুধ খেতে আাসা বিড়ালটাও জেনে যাবে আর দুধ না পেয়ে।
মা বলেছে - অনেক দূরের তুষারদেশে যাব আমরা। মা আমাকে যতটা আনন্দ নিয়ে জানিয়েছে আমি ততটাই ভীতি ও ব্যাথা নিয়ে তাকিয়েছি। নিজের পরিচিত মানুষজন ছেড়ে ভিনদেশে যাব - ওখানে সবকিছু নাকি আলাদা। বাংলায় কেউ কথাও বলেনা। আমি তো অন্যকোন ভাষা জানিওনা। কিন্তু আমাকে নাকি ওখানকার স্কুলে পড়তে হবে - এটা কিভাবে সম্ভব? আমি কিচ্ছু বুঝতে পারবনা, আমার রোল নাম্বার সবার পেছনে থাকবে আর পড়া না পারার কারণে আমাকে পুরো ক্লাস দাড় করিয়ে রাখবে। দেশের টিচারদের পছন্দের আমি ওখানে ফেল করা ছাত্রী হয়ে যাব। পেপারে বড় বড় করে শিরোনাম আসবে "কানাডায় গিয়ে দেশের নাম ডোবাল এক ইংলিশ না জানা ছাত্রী!" নতুন স্কুলের সহপাঠীরা আমাকে ক্ষেপাবে "ফেল্টুস ফেল্টুশ"। দেশে আত্মীয় স্বজনের রোল নাম্বার কত? প্রশ্নের উত্তরে গদগদ হয়ে ওঠা আমি আর কাউকে মুখ দেখাতে পারবনা। এসব ভাবতে এত গরমের মধ্যে এক্সট্রা ঘেমে উঠলাম।
আহারে! আমার নানা নানী, দাদা দাদী, খালা খালু, ফুফা ফুপি, কাজিন ব্রাদার সিস্টার - ওদের আর দেখতে পাবনা? ওদেরকে ঘিরে কতশত সুন্দর স্মৃতি ভেসে উঠছে চোখের সামনে।
"ওরা আমাদের যেতে দেবে?" এমন প্রশ্নের জবাবে বাবা বলেছিল, "ধুর বোকা, ওরা কেন আটকাবে? ওরা এই খবরে অনেক খুশি। তোর দাদী আর নানী তো ফোন করে করে সবাইকে খবর করছে। উন্নত দেশে যাচ্ছি ব্যাপারটাই আলাদা, বুঝলি?"
কিছু না বোঝা আমি আস্তে আস্তে মাথা ওপরে নিচে নামালাম। আমার একটা আশা ছিল দাদা দাদী আমাকে যেতে দেবে না দূরদেশে, বাবার বুঝ দেওয়ায় সেই আশা দপ করে নিভে গিয়েছিল। বাবা মায়ের সিরিয়াসনেস দেখে ভেতরে ভেতরে অদৃষ্টকে যেন দেখে ফেলেছিলাম, জেনে গিয়েছিলাম আমরা বিদেশে যাচ্ছিই, কোনকিছু এটাকে আটকাতে পারবেনা!
হাজারটা মন খারাপের মাঝে একটা ব্যাপার ভেবে মনে হালকা একটু স্বস্তি বয়ে গেল। নেক্সট কয়েক মাস একটানা ওদের সাথে থাকার সুযোগ পাব। বিদেশে যাবার আগে বেশ কিছু এমন কাজ আছে যেটা নাকি ঢাকাতেই করতে হবে। সেসব কাজ সারতে এবং আপনজনদের সাথে কিছু সময় কাটাতেই আগে আগে ঢাকায় যাওয়া।
গাড়ি ফেরি পার হয়ে অনেক দূর চলে এসেছে। একটু আগে রোদ থাকলেও এখন মিষ্টি একটা হাওয়ায় শরীরের ক্লান্তি যেন মিটতে শুরু করেছে। হালকা একটু মেঘেই প্রকৃতির অন্যরূপ! গাড়ির খোলা জানালার পাশে বসে একদৃষ্টে বাইরে তাকিয়ে ছিলাম। প্রচন্ড বাতাস চোখে লেগে কেমন যেন একটা তন্দ্রার ভাব এলো। আর হুট করে একটা চেহারা এবং ভাবনা মনে ভেসে উঠল - আচ্ছা, বিদেশে চলে গেলে তো ওর সাথে আর কখনো দেখা হবেনা!
এতকিছুর মাঝে সেই একজনের কথা মনে পড়ায় নিজেই চমকে উঠলাম। বেশ কিছু সময় আগে প্রথম একটি ছেলেকে ভালো লেগেছিল। একদিন বিকেলে হাঁটতে বেড়িয়েছিলাম নানুর সাথে, তখনই মায়াবী চোখ আর হাসির একজনকে দেখেছিলাম ক্ষানিকের জন্যে। পরে আর কখনো দেখা হয়নি যদিও অনেকদিন পর্যন্ত বাইরে গেলেই দোকানে, রাস্তায় খুঁজতাম চেহারাটা। তাকে জাস্ট আরেকবার দেখার ইচ্ছে ছিল। কখনো খুঁজে না পেয়ে কৌতুহল বেড়ে গিয়েছিল তার ব্যাপারে। হয়ত সে কারণেই দেশ ছাড়বে এমন খবরে তার কথা আবারো মনে পরল। এসব ভাবতে ভাবতে নিজেকেই বোকা মনে হলো, দেশে থাকলেও তো দেখা হতোনা। এত কোটি মানুষের ভীড়ে কিভাবে দেখা হবে আর দেখা হলেই বা কি করার আছে?
নিজের বুঝ দিতে দিতে অনেকটা পথ পেড়িয়ে ঢাকায় চলে এলাম এবং ক্লান্ত শরীর আর মনে দাদার বাড়িতে প্রবেশ করেই বাড়ির আবহাওয়া দেখে অবাক হয়ে গেলাম.......
-----------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
পাঠকের জন্যে কুইজ: দাদার বাড়িতে গিয়ে অবাক কেন হলাম?
সঠিক উত্তর এবং উত্তরদাতার নাম পরের পোস্টে যোগ করে দেওয়া হবে।
ছবিসূত্র: অন্তর্জাল!
সর্বশেষ এডিট : ০৮ ই আগস্ট, ২০২০ রাত ৮:১৯