চৌধুরী সাহেববব! আইনের থুক্কু বিজ্ঞানের হাত অনেক লম্বা! হাহা, ভীষন সিরিয়াস পোস্ট তাই একটু মজা করেই শুরু করলাম। এই পোস্টটি নানান ক্যাটাগরির - চাইলে রহস্য পোস্ট ভাবতে পারেন, আবার বিজ্ঞান/প্রযুক্তি অথবা ক্রাইম ভিত্তিক পোস্টও ভাবতে পারেন। যাই ভাবুন না কেন, আশা করি পোস্টের গল্পগুলো আপনার মন সেভাবেই ছুঁয়ে যাবে যেভাবে আমার গিয়েছে!
-----------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
১) একজন মা, একটি জানোয়ার ও আধখাওয়া সিগারেট!
দিনটি ছিল ১৯৮৫ সালের শুরুর দিন মানে জানুয়ারির এক তারিখ। অন্য যেকোন বছরের মতোই বিশ্ব আনন্দে আত্মহারা হয়ে সেলিব্রেট করে, সাদরে আমন্ত্রণ জানাচ্ছিল নতুন বছরকে। সেদিন রাতে টানিয়া ম্যাকেনলি নামের ২৩ বছরের মিষ্টি চেহারার এক নারী রেস্তোরাঁয় খেতে গিয়েছিলেন বন্ধুদের সাথে। বাবা মায়ের আদরের মেয়ে এবং নিজেও একটি ১৮ মাস বয়সী শিশুর মমতাময়ী মা ছিল টানিয়া।
নতুন বছরকে সেলিব্রেট করে অন্য অনেকে বাড়ি ফিরলেও, ফিরতে পারেননি টানিয়া। তাকে সকালে রাস্তার ধারে অর্ধনগ্ন ও মৃত অবস্থায় পাওয়া যায়। অপরাধী যৌন নিপীড়ন করে তাকে শ্বাস আটকে খুন করে।
ফ্লোরিডার পেনসাকোলা পোলিস ডিপার্টমেন্ট অপরাধীকে ধরতে উঠেপড়ে লাগলেন। টানিয়ার বন্ধু, স্বজন এবং সেদিন রাতে যার যার আশেপাশে সে ছিল সবাইকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। কিন্তু কোন কূলকিনারা করতে পারেন না তারা। কেসটি রয়ে যায় আনসলভড কেস ফাইলস এর তাকে।
এর মধ্যে অনেকগুলো বছর কেটে যায়। গাছের পাতাগুলো কখনো গ্রীষ্মের রোদে হেসে ওঠে তো আবার কখনো ভীষন শীতে জমে যায়। ছোট বাচ্চাটি যে মা ছাড়া কিছুই বুঝত না, সে মা ছাড়াই বড় হতে থাকে। মেয়েটির বাবা মার চোখের পানি শুকিয়ে যায় বিচারের আশায় আশায়। একদিকে নিরপরাধ মানুষদের গভীর ব্যাথায় কোনমতে বাঁচার চেষ্টা আর অন্যদিকে খুনী আনন্দে স্বাধীন ভাবে ঘুরে বেড়ায়। এভাবে কেটে যায় ৩৫ টি ভীষন লম্বা বছর!
রহস্যজট খোলার গল্প!
জেনেটিক জিনিওলজি এমন একটি সাবজেক্ট যা জেনেটিক এনালাইসিসকে পারিবারিক ইতিহাসের সাথে মার্জ করে। অর্থ্যাৎ, ব্যক্তির ডিএনএকে পরিবারের কারো সাথে ম্যাচ করে খুঁজে বের করে কোন মিসিং ব্যক্তিকে অথবা অপরাধীকে। এই কেসে এমনকিছুই করেন পুলিশেরা।
স্বাভাবিকভাবেই পুলিশ ক্রাইম লোকেশনের ডিএনএ স্যাম্পেল কালেক্ট করেছিলেন। বহু বছর পরে আধুনিক বিজ্ঞানের সাহায্য ঠিকপথে এগোতে থাকে তদন্ত। জিনিওলজি ডাটাবেজে ডিএনএ খুঁজতে খুঁজতে অপরাধীর কাজিনদেরকে খুঁজে পায় পুলিশ। তার সাহায্যে ধীরে ধীরে একটি ফ্যামিলি ট্রি তৈরি করেন তারা, যার মাধ্যমে একজন সন্দেহভাজন ব্যক্তি পর্যন্ত পৌঁছান।
সেই ব্যক্তি ছিল ৫৭ বছর বয়সী ড্যানিয়েল ওয়েলস। সেই ব্যক্তিই অপরাধী এমন নিশ্চয়তা পুলিশের ছিলনা তাই তারা ওয়েলসকে অনুসরণ করতে থাকেন। যখন ওয়েলস একটি আধখাওয়া সিগারেট ফেলে দেয় চলন্ত গাড়ি থেকে, সাথে সাথে পুলিশ থেমে সেটি কালেক্ট করেন। সেই সিগারেটের ডিএনএ ম্যাচ হয়ে যায় টানিয়ার শরীরে পাওয়া ডিএনএর সাথে। দ্রুতই ড্যানিয়েল ওয়েলস এরেস্টেড হয়। এরেস্ট হবার ২ সপ্তাহের মধ্যে নিজের সেলে ফাঁস লাগিয়ে আত্মহত্যায় করে ওয়েলস!
অবশেষে একটি ভঙ্গ হৃদয়ের পরিবার ও একটি সন্তান নিতে পারে মুক্তির নি:শ্বাস। দিনরাত পরিশ্রম করতে থাকা পুলিশেরা পায় স্বস্তি! আর টানিয়ার কি হয়? পুলিশ চিফ চার্লস মালেটের ভাষায় বলতে গেলে, "ইউ মে নাও রেস্ট ইন পিস টানিয়া!"
২) সপ্তদশ শতাব্দী থেকে অপেক্ষায় সেই কিশোরটি!
ম্যারিল্যান্ডে একটি পুরোন গল্প হুট করে থেমে গিয়েছিল, কিন্তু পুনরায় সেদিন শুরু হয় যেদিন মাটির নিচের ভান্ডারে - ফায়ারপ্লেসের ছাই, বোতল, পশুপাখির হাড়ের নিচে একটি কংকাল পাওয়া যায়! কংকালের বুকের দিকটায় পড়ে ছিল একটি মিল্ক প্যান যা দিয়েই সেই কবর খোড়া হয়! সেটি দেখে বিজ্ঞানীরা অনুমান করেন যে কোন এক নৃশংতার সাক্ষী এই কংকালটি! গবেষকরা উঠেপড়ে লাগেন সেই গল্পটিকে পুনরদ্ধার করতে যেটিকে বছরের পর বছর ধরে বুকে চেপে ছিল কংকাল হয়ে যাওয়া মানুষটি!
রহস্যজট খোলার গল্প!
ঐতিহাসিক এই রহস্যের কিনারা করতে ফরেনসিক নৃবিজ্ঞানীরা কংকালটির বোনস পরীক্ষা করতে শুরু করে দেন। তারা বের করেন যে ককেশীয় ১৫-১৬ বছরের কিশোর কংকালটি। ছেলেটির শিড়দাড়া ও দাঁত বাজেভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল কঠোর পরিশ্রমের ও অসুখের কারণে। সপ্তদশ শতাব্দীর দিকে বাচ্চা বাচ্চা ইউরোপিয়ান নারী ও পুরুষকে চুক্তিভিত্তিক ভাবে দাস বানাত তখনকার বড়লোক ব্যাবসায়ী বণিকেরা। সাধারণত ৪ বছর পর্যন্ত কাজ করতে হতো দাস দাসীদেরকে ঋণ শোধ করতে। কিন্তু অনেকেই তার আগেই মারা যেত অত্যাচার ও অতিরিক্ত কাজের চাপে।
ছেলেটির দেহের চারিপাশে অনেক জিনিস পাওয়া যায় যার একটি ছিল কিছু কয়েনস যা ১৬৬৪ সালের এবং একটি জানালার অংশ যাতে ১৬৬৩ সাল লেখা। জেন কক্স নামক প্রত্নতত্ত্ববিদের মতে ১৬৬৫-১৬৭৫ এর মধ্যে ছেলেটি মারা যায়। সেই সময়েই আইন পাস করে ক্রীতদাসদের অপ্রকাশ্যে দাফন করাকে নিষিদ্ধ করা হয়েছিল কেননা এমন ঘটনা তখন প্রচুর ঘটত।
কংকালের ডান হাত এমনভাবে ভাঙ্গা ছিল যাতে এটা বোঝা যায় যে মৃত্যুর আগে সে নিজেকে বাঁচানোর চেষ্টায় হাতের ব্যবহার করেছে। মালিক নিজের বাড়িতে ছেলেটিকে কবর দেন হাজারো অত্যাচারের পরে।
হয়ত চুক্তিবদ্ধ দাস হবার পূর্বে এই ছেলেটিরও একটি স্বাভাবিক জীবন ছিল, পরিবার ছিল। হয়ত সে স্বপ্ন দেখেছিল চুক্তি শেষ হবার পরে ফিরে যাবে আপনজদের কাছে। সূর্য, নক্ষত্র ও আঙ্গুলের কড়ের হিসেবে দিন গুণত আর ভাবত আর কিছু দিন! হাজারটা পরিশ্রম, অত্যাচার, মারধোর সহ্য করেও বেঁচে ছিল, অর্ধমৃত শরীরেও নিজেকে বাঁচানোর চেষ্টা করেছে প্রাণপণ। জীবনের কাছে হার মানেনি। মৃত্যুর পরে আরো লম্বা এক অপেক্ষা শুরু হয় তার। অপেক্ষা নিজের গল্পের স্বীকৃতির। ছেলেটির নাম অজানা হলেও তার গল্পটি সবাই জেনেছে, তার অপেক্ষা ফুরিয়েছে - শেষবেলার স্বস্তি হয়ে সেটুকুই নাহয় থাক!
৩) বাথটাবে মৃত ষোড়শীর ডুবন্ত স্বপ্ন, তারপরে ৩৯ বছরের অপেক্ষা!
শ্যারন শোলমায়ার! একজন ১৬ বছরের তরুণী - যে স্বপ্ন দেখতে পারত এবং স্বপ্নপূরণে পরিশ্রমও করত। ওয়েটরেস হিসেবে চাকরিরত মেয়েটি এপার্টমেন্টে থাকত। সে ভীষন রকম দায়িত্ববান ও নির্ভরযোগ্য ছিল - এতটাই যে যখন সে মাত্র একদিন কাজে আসে না, বস দুশ্চিন্তায় পড়ে যায়! সাথে সাথে শ্যারনের মাকে ফোন করে, নিজেকে মেয়েকে ভালোভাবে জানা মাও চিন্তায় পড়ে যান। এপার্টমেন্টের দিকে ছুটে যান মেয়েকে দেখতে এবং তার সাথে থাকে এপার্টমেন্ট ম্যানেজার প্যাটরিক ম্যাকেভ।
১৯৭৭ সালের ৫ ডিসেম্বরের সেই অশুভ দিনটিতে একজন মা এমনকিছু দেখেন যা কোন মা নিজের শত্রুর মেয়ের জন্যেও চাইবে না! পানিপূর্ণ বাথটাবে নগ্ন শ্যারনের লাশ! দড়ি দিয়ে তার হাত বাঁধা, ওড়নায় চোখ ও নাক বাঁধা, মুখের মধ্যে শ্যারনেরই পোশাকের টুকরো - নিথর নিষ্প্রাণ একটি দেহ। বাথটাবের পাশে পড়ে ছিল চাকু!
মেয়ে হারা মা কি করবেন কি বলবেন বুঝতে পারছিলেন না। ম্যানেজার ম্যাকেভ তাকে সামলে সাথে সাথে সল্ট লেক পুলিশ সিটিকে ফোন করেন। তারা এসে এমনকোন সাইন পান না যাতে মনে হতে পারে কেউ জোড় করে বাড়িতে প্রবেশ করেছে! দ্রুত লাশের ময়নাতদন্ত হয় এবং শ্বাসরোধে মৃত্যু হয়েছে সেটা বের করতেও পারলেও হত্যাকারী কে সেটা বের করতে পারেন না। ডিটেকটিভ শ্যারনের মুখের পোশাকের টুকরো যা দিয়ে তার মুখ চেপে ধরা হয়েছিল, সেটিকে ডিএনএ টেস্টে পাঠায় এবং বছরের পর বছর সেটি ডিএনএ স্টোরেজে বসে থাকে।
রহস্যজট খোলার গল্প!
৩৯ টা বছর শ্যারনের আত্মা এবং আপনজনেরা অশান্তিতে থাকে। অপরাধী ঠিকই ঘুরে বেড়ায় শান্তিতে, স্বস্তিতে। কিন্তু বিজ্ঞানের হাত সময়ের সাথে সাথে আরো লম্বা হয়ে যায়। পুরোন যুগে পানির মধ্যে থেকে ডিএনএ কালেক্ট করার মতো প্রযুক্তি না থাকলেও ২০০৭ এ বিজ্ঞানী ব্রুস ব্যাডলি এম ভ্যাক নামের একটি পন্থা আবিষ্কার করেন যা পানিতে ভেজা বস্তুর মধ্য থেকে ডিএনএ টেনে বের করে আনতে পারে।
ব্যাস আর কি! সেই প্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়ে ২০১৩ সালে ন্যাশনাল ডাটাবেজে থাকা একটি ডিনএর সাথে ম্যাচ পাওয়া যায় শ্যারনের সেই পোশাকে লেগে থাকা ডিএনএর। খুনীর নাম? এপার্টমেন্ট ম্যানেজার প্যাটরিক ম্যাকেভ যিনি নিজে পুলিশকে ফোন করেছিলেন শ্যারনের মৃত্যুর পরে! ২০১৭ সালের মার্চে তিনি অপরাধ স্বীকার করতে বাধ্য হন।
রাতের বেলা চাবি ব্যবহার করে এপার্টমেন্টে প্রবেশ করে ম্যাকেভ, তারপরে মেয়েটিকে চাকু দিয়ে ভয় দেখিয়ে ধর্ষণ করে। ধর্ষণের পরে নিয়ে যায় বাথরুমে, তার হাত পা বেঁধে মাথা পানির মধ্যে দিয়ে মেরে ফেলে।
৫৯ বছর বয়স হয়েছিল ম্যাকেভের যখন তাকে এরেস্ট করা হয়। শেষমেষ আসল অপরাধীকে পুলিশ খুঁজে পেলেও, তার প্রায় পুরো জীবনই স্বাধীনভাবে কেটে যায়। একে কি বলবেন? জাস্টিস ডিলেড জাস্টিস ডিনাইড নাকি পাপ বাপকেও ছাড়েনা?
ছবি ও তথ্যসূত্র: অন্তর্জাল!
সর্বশেষ এডিট : ২১ শে আগস্ট, ২০২০ রাত ৮:৪২