৮১০ মিলিয়ন ভোটারের সংখ্যাধিক্য ভোটে নিরঙ্কুশ ক্ষমতা নিয়ে দিল্লীর মসনদে বসতে যাচ্ছেন বহুল আলোচিত অথবা সমালোচিত নরেন্দ্র মোদি। তাকে নিয়ে যতটা আগ্রহ আছে ঠিক ততটাই আবার শঙ্কাও আছে। আগ্রহ বা আশঙ্কা যতটা ভারতে ঠিক ততটা ভারতের বাইরেও। আগ্রহ হল তিনি যে “উন্নয়নের মডেল” দেখিয়ে ক্ষমতায় বসছেন বা বসতে যাচ্ছেন, সেই মডেলটার স্বরূপটা কিরকম তা নিয়ে। আবার আশঙ্কা হল, তিনি এমন একজন বিতর্কিত ব্যক্তিত্ব যার হাতে বলা যায় হাজারো মুসলমানের রক্তের দাগ লেগে আছে, সেই ব্যক্তি যদি ভারতের মত বহুত্ববাদী একটি দেশের প্রধানমন্ত্রী হন তাহলে তিনি কি তাঁর দেশের আদি বহুত্ববাদ ধরে রাখতে পারবেন? নাকি আবার সাম্প্রদায়িক হাঙ্গামা সৃষ্টি হবে? মানমোহন জমানার মার্কিনদের সাথে পারমানবিক চুক্তি, যে চুক্তি তাঁর দল বিজেপির চরম বিরোধিতার মুখে সম্পন্ন হয়েছিল, তাঁর ভবিষ্যত কি হবে?
এবারের নির্বাচন বিশেষ কিছু কারনে ভারতের অন্যান্য নির্বাচন থেকে আলাদা। মনে রাখতে হবে এবারই যে প্রথম বিজেপি ক্ষমতায় আসল তা কিন্তু নয়, এর আগে অটল বিহারী বাজপেয়ীর নেতৃত্বেও ভারতে বিজেপির সরকার ছিল। বাজপেয়ীর আমলে বিজেপির সরকার একটি কোয়ালিশনকে নেতৃত্ব দিয়েছিল বিধায় আমরা বিজেপির কোন বিশেষত্ব তেমন প্রবল আকারে দেখতে পাইনি। তবে বিজেপির নাম তোলা হলেই একধরনের উগ্র সাম্প্রদায়িক চিত্র ভেসে ওঠে, বাজপেয়ী সরকার তা দূর করতে তেমন কোন বিশেষ পদক্ষেপও নিতে পারেননি। অধ্যাপক ইমতিয়াজ আহমদের ভাষায়, বিজেপি যেহেতু একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়েছে সেহেতু মোদি এবার রাষ্ট্র পরিচালনায় অনেক সংযমী ও কোশলী হবেন। তাঁর যেহেতু অন্য কোন শক্তির উপরে নির্ভর করতে হবেনা সেহেতু তিনি ভারতের সঙ্খ্যালঘু সম্প্রদায় বিশেষ করে মুসলমান সম্প্রদায়ের সাথে সম্পর্কোন্নয়নের একটি বিশেষ সুযোগ পাবেন। মোদি নিশ্চয়ই মনে রাখতে চাইবেন যে, এবারের নির্বাচনে তাঁর সাম্প্রদায়িক চরিত্রের চাইতে বেশীই গ্রহনযোগ্যতা পেয়েছিল তাঁর অর্থনৈতিক দর্শন। ভোটারদের বিশাল যে তরুন অংশটি তাকে যে ভোট দিয়েছেন তাতে কোন সন্দেহ ছাড়াই এটা ধরে নেয়া কর্তব্য যে, তিনি তাঁর সাম্প্রদায়িক নেতিবাচক পরিচয়কে তাঁর ইতিবাচক “গুজরাট উন্নয়ন মডেল” তাঁর ক্যারিশম্যাটিক নেতৃত্ব, বিশেষ কোন পরিবারের সদস্য না হওয়া, ব্যাবসায়ীদের আস্থা অর্জনে সক্ষম হওয়া, কংগ্রেসের সীমাহীন দূর্নীতি, ইত্যাদি বিষয় দ্বারা আড়াল করতে চেয়ে সফল হয়েছেন।
মোদির বিরুদ্ধে সবচেয়ে গুরুতর অভিযোগ হল তিনি গুজরাটে মুসলিম বিরোধী দাঙ্গায় উসকানী দিয়েছেন ও তা দমনে বিশেষ কোন পদক্ষেপ নেননি। মূলত তাঁর এইধরনের ভূমিকার কারনেই তিনি একজন সাম্প্রদায়িক নেতা হিসেবে পরিচিত, কেহ কেহ অবশ্য তাকে হিটলারের সাথেও তুলনা করতে যান। তাঁর এই বিশেষ ধরনের বৈশিষ্টের জন্যেই তিনি মুসলমান সম্প্রদায়ের কাছে একজন শঙ্কার বিষয়বস্তু। কিন্তু আমাদের দেখতে হবে ৯২ সালের দাঙ্গার সময়ে কেন্দ্রে ছিল নরসীমা রাওয়ের নেতৃত্বাধীন কংগ্রেস সরকার। কিছুদিন আগে প্রকাশিত এক তথ্যে দাবী করা হয়েছে যে, গুজরাটে যে দাঙ্গা হবে তা আগে থকেই পরিকল্পনা করা ছিল, একদল প্রশিক্ষিত বাহিনী অন্যান্য প্রদেশ থেকে নিয়ে আসা হয়েছিল, এবং এই তথ্যটা তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী নরসীমা রাও জানতেন। বলা হচ্ছে, গুজরাটে দাঙ্গার চরম উত্তেজনাকর মুহুর্তে প্রধানমন্ত্রী নরসীমা রাও পুজায় বসেছিলেন। তাঁর সহকারীকে নির্দেশ দেয়া ছিল তাকে যাতে কেউ বিরক্ত না করে। দাঙ্গা নিয়ন্ত্রনে চলে আসলে তাঁর একজন দেহরক্ষী তাকে কানে কানে কিছু বলায় তিনি পুজো শেষ করে উঠে যান। এসব ঘটনা কংগ্রেসের সংশ্লিষ্টতাকেই প্রমান করে। বস্তুত, বিশ্বের ধর্মনিরপেক্ষতার মডেলের দাবীদার ভারতের ধর্মনিরপেক্ষতায় যথেষ্ঠ ত্রুটি রয়েছে। সমাজে ধর্মনিরপেক্ষতা প্রতিষ্ঠা করা না গেলে রাষ্ট্রে তা করতে গেলেই সাম্প্রদায়িক সঙ্ঘাত বাধে। কারন রাষ্ট্রকে ধর্মনিরপেক্ষ করার সিদ্ধান্তটি যিনি নিবেন তিনিও তো কোন না কোন ধর্মের অনুসারী হবেন। ভারতের রাজনীতিতে যখন যেই ক্ষমতায় থাকুকনা কেন সবার মাঝেই আমরা একটি বিশেষ ধরনের প্রবনতা দেখতে পাই যে, মুসলিমদের দমন বা তাদের স্বার্থ ক্ষুন্ন করতে সবাই এক জায়গায় থাকেন। কোন বিশেষ বিশেষ দল তাদেরকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেন।
বৃহত্তম গনতন্ত্রের দাবীদার ভারতে স্বাধীনতার পরে বেশীর ভাগ সময়ে ক্ষমতায় থাকা কংগ্রেসের অভ্যন্তরে গনতন্ত্র প্রচলিত নেই। একটি গুরুতর প্রশ্ন থেকেই যায় যে, যার দেহের অভ্যন্তরে গনতন্ত্র শক্তিশালী নেই তাঁর হাতে এতবড় একটি গনতন্ত্র কতটা বিকশিত হতে পারে? কংগ্রেসের রাজনীতি হল অভিজাত কেন্দ্রিক। অন্যদিকে বিজেপির ক্ষেত্রে চিত্রটি সম্পূর্ন উল্টো, তাদের রাজনীতি কোন পরিবারক কেন্দ্রিক নয়। নরেন্দ্র মোদি যিনি তাঁর তরুন বয়সে পিতার সাথে চা বিক্রী করতেন, নিঃসন্দেহে তা ভারতের তরুন প্রজন্মের সামনে এক বিশাল দৃষ্টান্ত হিসেবে উপস্থাপিত হয়েছে। সর্বোপরি তাঁর কংগ্রেসের লজ্জাজনক হার ও মোদির বিজয় যেন গনতন্ত্রেরই বিজয়।
বলা হচ্ছে তাকে সামনে ঠেলে দিয়ে আর এস এস সমাজে এক ধরনের ইঞ্জিনিয়ারিং করার চেষ্টা চালাচ্ছে। নরেন্দ্র মোদির অতীতের দিকে তাকালে দেখতে পাই জাতপাতের কড়া শাসনে ঘেরা ভারতে তিনি ছিলেন একজন নিম্নবর্নের মানুষ। ফলে সমাজের নিম্ন শ্রেনীর সার্বিক অংশগ্রহন ঘটায় অন্তত এই একটি নির্বাচনে জাতপাতের নোংরা খেলার বাইরে ছিল। তাছাড়া তাকে এ নির্বাচনে নিম্নবর্নের মানুষের অধিকার ও চেতনার প্রতীক হিসেবে ধরে নির্বাচনী প্রচারনা চালানো হয়েছে।
আলী রিয়াজ ও ইমতিয়াজ আহমেদের বিশ্লেষন অনুযায়ী মোদিকে যারা এ পর্যায়ে এনেছেন সে কর্পোরেট মালিকগন, যাদের দরকার একটি স্থিতিশীল বাজার তারা তাদের স্বার্থের জন্যেই মোদির হাতকে সাম্প্রদায়িক অস্থিতিশীলতার দিকে যেতে দিবেন বলে মনে হয়না। যেহেতু ৩০ বছর পরে এই সর্বপ্রথম কোন একক একটি দল নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে মসনদে অধিষ্ঠিত হতে যাচ্ছে সেহেতু তিনি তাঁর সামনে থাকা নিজের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করা আর তাঁর প্রতিশ্রুত উন্নয়নের বারোটা বাজিয়ে এত সুন্দর সূযোগ নষ্ট করতে চাইবেন না। সমালোচক বা বিশ্লেষকদের একটি নির্দিষ্ট জায়গায় থেমে গিয়ে পরিস্থিতি কোন দিকে যাচ্ছে তা পর্যবেক্ষন করতে হয়, নইলে মিসগাইডেড হবার সম্ভাবনা থেকে যায়। কিন্তু মোদির ক্ষেত্রে মনে হচ্ছে আগামী পাঁচ বছরে কি কি গুরুত্বপূর্ন সিদ্ধান্ত নেয়া হতে পারে তার সবই আগাম বিশ্লেষণ করে বলে দেয়া হচ্ছে। নিঃসন্দেহে মোদির সর্বপ্রথম দায়িত্ব হবে তাঁর প্রতিশ্রুত উন্নয়নকে বাস্তবে রূপ দেবার পাশাপাশি তাঁর সম্পর্কে নেতিবাচক প্রচারনা ও ধারনা সম্মন্ধে ত্বরিত ব্যবস্থা নেয়া, নইলে তাঁর মূল কাজ পরবর্তীতে অনেক কঠিন হয়ে যেতে পারে।