২০০৮ সালের নির্বাচনের আগে থেকে এ পর্যন্ত রাজনৈতিকভাবে সবচেয়ে বেশি যে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হয়েছে তাহলে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার। এ নিয়ে জল্পনা কল্পনারও শেষ নেই। আর সবচেয়ে করুণ বিষয় এই যে, এখন এই যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নিয়ে হচ্ছে আওয়ামীলীগ, বিএনপি-জামায়াত রাজনীতি।যেটা হওয়া উচিত ছিল বাংলাদেশের সমস্ত মানুষের প্রাণের দাবিতে,সেটা আজকে হয়ে উঠছে রাজনীতির ট্রাম্প ফ্যাক্টর। অনেকেই মনে করছে আওয়ামীলীগ তার ক্ষমতা নিরংকুশ করার জন্য যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চাচ্ছে, আর ঠিক একই কারণে বিএনপি চাচ্ছেনা বিচার হোক। তারপরেও এটা অবশ্যই স্বীকার্য যে এই বিচারের ক্ষেত্রে অন্য রাজনৈ্তিক দলদের তুলনায় আওয়ামীলীগ বেশি আন্তরিক। তারপরও প্রশ্ন থেকে যায়, আওয়ামীলীগ কেন একবার ক্ষমতায় থাকা কালে কোন টুঁ শব্দটি করলনা ? এমনকি ক্ষমতার লোভে তারা এইসব ঘৃণিত যুদ্ধাপরাধীদের সাথে হাত পর্যন্ত মিলিয়েছে!
আন্তর্জাতিক যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রসজ্ঞঃ
বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠণ নিয়ে বিএনপির মহাসচিব দেলোয়ার বলেছেন, ৭১ এর যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ফৌজিদারি আইনেই হতে পারে সেক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনাল করার কোন প্রয়োজন নেই। এটা যে উদ্দেশ্য প্রণোদিত কথা তা বুঝতে আমাদের সমস্যা হয়না, কারণ আমাদের প্রচলিত ফৌজিদারি আইনে যুদ্ধাপরাধীদের অপরাধের মাত্রা অনুযায়ী শাস্তি হয়না। কারণ ফৌজিদারি আইনে যে শস্তির বিধান সেটা হচ্ছে Individual অপরাধের ক্ষেত্রে আর যুদ্ধাপরাধ হচ্ছে একটা সমগ্র জাতির বিরুদ্ধে অপরাধ। আর এটা বুঝতে পেরেই ১৯১৯ সালে প্যারিস এ পীস কনফারেন্স এর সময় কমিশন অফ রেসপন্সেবিলিটির দ্বারা প্রথম আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনাল গঠণ করা হয়। আর এই আন্তর্জাতিক ক্রিমিনাল কোর্টের সংগাতে বলা হচ্ছেঃ"The International Criminal Court (commonly referred to as the ICC or ICCt) is a permanent tribunal to prosecute individuals for genocide, crimes against humanity, war crimes, and the crime of aggression"। তো দেলোয়ার হোসেন কি অস্বীকার করতে পারেন যে গোলাম আযম, নিজামী, সাঈদী, কাদের মোল্লা তারা এই কাজ গুলো করেননি। অনেকেই আবার গলা বাড়িয়ে বলেন শেখ মুজিবুর রহমান যখন নিজেই ক্ষমা ঘোষণা করে গেছেন তখন আওয়ামীলিগের এই বিচার উদ্দেশ্যপ্রণোদিত তাদের জন্য বলি দয়া করে, সাধারণ ক্ষমা ঘোষণার সরকারি প্রেসনোটটা একটু পড়ুন সেখানে স্পষ্ট বলা হয়েছে “"ধর্ষণ, খুন, খুনের চেষ্টা, ঘরবাড়ি, জাহাজে অগি্নসংযোগের দায়ে দণ্ডিত ও অভিযুক্তদের ক্ষেত্রে ক্ষমা প্রদর্শন প্রযোজ্য হবে না" “। আমরা জানি যে, দালাল আইনে আটক ছিল মোট ৩৭ হাজারেরও বেশি লোক। এর মধ্যে ছাড়া পেয়েছিল ২৬ হাজার। ১১ হাজারের বেশি লোক ক্ষমার অযোগ্য অপরাধের দায়ে আটক ও বিচারাধীন ছিল। তারা মুক্তি পায় মুজিবুর রহমানের মৃত্যুর পর ১৯৭৫ সালের ৩১ ডিসেম্বর দালাল আইন বাতিলের পর। তাহলে এখন প্রশ্ন হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধ কোন দলের ছিলনা, হতে পারে আওয়ামীলীগ তার নেতৃত্ব দিয়েছে কিন্তু এটা তো ছিল আপামর বাঙ্গালীর তবে আজ কেন ৪০ বছরেও এদের বিচার হলনা, এটা কি শুধু আওয়ামীলীগের দায় না আমাদের ? সবচেয়ে দুঃখজনক হলেও সত্য আমরা বাঙ্গালীরা খুব দ্রুত ইতিহাস ভূ্লে যায় এবং ইতিহাস থেকে শিক্ষা গ্রহণ করিনা।
যাই হোক শেষ পর্যন্ত গত সপ্তাহে আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনাল যাত্র শুরু করেছে , যেটা হওয়া উচিত ছিল আরো আগে’। আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনাল এর ইতিহাস ঘেটে দেখা যায় আজ থেকে ১৪৬ বছর আগে ১৮৬৪ সালে জেনেভা কনভেনশনে, এরপর ১৮৯৯, ১৯০০, ১৯১৯ এবং তারপরে ১৯৩৯ সালে ইউরোপে অনুষ্ঠিত বিভিন্ন কনভেনশনে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্য আন্তর্জাতিক উদ্যোগ গ্রহণের বিষয়ে আলোচনা ও সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।
ইতিহাসে দেখা যায়, ১৪৭৪ সালে হাগেনবাখের স্যার পিটারকে যুদ্ধাপরাধের জন্য মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছিল। ১৮১৫ সালে ভিয়েনা কংগ্রেস পরাজিত ফরাসি সম্রাট নেপোলিয়নকে অপরাধী ঘোষণা করে ব্রিটিশ সরকারের হাতে তুলে দিয়েছিল এবং শাস্তি স্বরুপ নেপোলিয়নকে সেন্ট হেলেনা দ্বীপে নির্বাসন দেওয়া হয়েছিল। তবে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রসঙ্গটি সবার গোচরে আসে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর জার্মানির ন্যুরেমবার্গে ১৯৪৫ সালে নাৎসি যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্য যখন মিত্র দেশগুলো 'ইন্টারন্যাশনাল মিলিটারি ট্রাইব্যুনাল' গঠন করে তখন। এ ট্রাইব্যুনালই 'ন্যুরেমবার্গ ট্রাইব্যুনাল' নামে ইতিহাসখ্যাত। এর পাশাপাশি জাপানি যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্য গঠিত হয় 'টোকিও ট্রাইব্যুনাল'। পৃথিবীতে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নিয়ে এত কিছু হয়ে যাচ্ছিল কিন্তু তা নিয়ে নীরব ছিল বাংলাদেশ, তার চেয়েও দুঃখজনক তৎকালীন শাসকরা এই সব যুদ্ধাপরাধীদেরকে বিভিন্ন সুযোগ প্রদানে ব্যস্ত ছিল। আমার তো সন্দেহ হয় যে, যদি শহীদ জননী জাহানার ইমাম এই বিচারের প্রসঙ্গ না তুলতেন তবে বোধ হয় কখনই জাতীয় ভাবে এ বিচারের কথা আসত না।
গত ১লা জুলাই তে বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবী এবং কলামিস্ট বদরুদ্দীন উমর কালের কন্ঠে তাঁর কলামে বলেছেন, ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময় যে সব অবাঙ্গালীর উপর নির্যাতন, জুলুম হয়েছে তার বিচার হওয়া উচিত, আমিও একমত যে বিচার হওয়া উচিত কিন্তু বাঙ্গালীর সেই অপরাধ আর যুদ্ধাপরাধীদের অপরাধ কি এক করে দেখা যায় ? কারণ যুদ্ধের সময় যাদের মা, বোন কে বেইজ্জত করা হয়েছে খুন করা হয়েছে ভাইকে, সন্তানকে তাঁরা যদি প্রতিহিংসা পরায়ন হয়ে কাউকে আঘাত করে তার সাথে ঠান্ডা মাথায় একটা জাতি ধ্বংসকারীদেরকে কি একই কাতেরে ফেলা যায় ??
একজন বাঙ্গালী এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্ভাসিত হওয়া একজন মানুষ হিসেবে চাইব এইসব ঘৃণিত যুদ্ধাপরাধী তথা মানবতাবিরোধীদের বিচার হোক, আর এটাও প্রার্থনা করব এই বিচার নিয়ে কোন ভাবেই যেন রাজনীতি না হয়, কারণ আমরা জানি যুদ্ধাপরাধী শুধু আজ আর জামায়েতের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই , ভোল পাল্টে সেই সব হায়েনার দল আজ ঢুকে পড়েছে আওয়ামীলীগ এবং বিএনপির মধ্যেও। এই জন্য আওয়ামীলীগ, বি এনপি আপনাদের কাছেও অনুরোধ জানাই প্রকৃ্ত অপরাধীদের বিচার করতে একে অপরকে সাহায্য করুন, মিথ্যা প্রপোগান্ডা ছড়িয়ে সাধারণ মানুষ কে বিভ্রান্ত না করে প্রকৃ্ত সত্য তুলে আনুন।
তথ্য সূ্ত্রঃ একাত্তরের যুদ্ধাপরাধ এবং যুদ্ধাপরাধীদের বিচার-শাহরিয়ার কবির, যুদ্ধাপরাধ এবং জেনেভা কনভেনশন:প্রেক্ষিত বাংলাদেশ - আইজ্যাক রবিনসন ও জাভেদ হাসান মাহমুদ, উইকিপিডিয়া।
সর্বশেষ এডিট : ৩১ শে জুলাই, ২০১০ সকাল ১১:২৮