জীবনের প্রতিটা কাজের পেছনে একটা লক্ষ্য থাকে । সেই অর্থে মঞ্চ নাটকেরও একটা উদ্দেশ্য বা লক্ষ্য আছে ,কি সেটা ? মঞ্চ নাটককে বলা হয়ে থাকে সমাজ পরিবর্তনের হাতিয়ার । সমাজ পরিবর্তনের সাথে আর যে বিষয়টি ওতপ্রোতভাবে জড়িত সেটা হচ্ছে রাজনীতি। কিন্তু এই সমাজ পরিবর্তনের ধারক হয়ে ওঠা এক দিনে হয়নি। শুরুটা সেই ১৯১৭ সালে রুশ বিপ্লবের পর থেকে,সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের সাফল্য নতুন অভিঘাত সৃষ্ঠি করেছিল তৎকালীন সাহিত্য, সঙ্গীত,চিত্রকলা, চলচ্চিত্র এবং সর্বোপরি নাটকে। অবশ্য সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত ইউনিয়নে সেই পরিবর্তনের ধারা খুব বেশিদিন স্থায়ী হয়নি এর প্রধান কারণ নাটকে রাজনীতির প্রভাব। যে নাটক স্বপ্ন দেখাচ্ছিল শোষণ মুক্ত,শ্রেনীহীন এক সমাজের তা ধীরে ধীরে পর্যবসিত হতে থাকে পার্টির প্রপোগান্ডা থিয়েটারে। আর যারা ছিলেন নিরীক্ষাবাদী তারা হয়ে যেতে থাকেন এক ঘরে তবে এই প্রবনতা শুধু নাটকে নই সব জায়গাতেই ছিল সাহিত্য, সঙ্গীত সব ক্ষেত্রেই। তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ইউরি লুব্যিমভ এবং তার তাগানকা থিয়েটারের ক্ষেত্রে। সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব যেমন পৃথিবীব্যাপী আলোড়ন সৃষ্ঠি করেছিল তারপরে বিবিধ কারণে থেমে গিয়েছিল সেই অগ্রযাত্রা কিন্তু তারপরেও তার রেশ এখনও বিদ্যমান তার কারণ শ্রেণীহীন সমাজ ব্যাবস্থার আন্তর্তাগিদ এবং এর যৌক্তিকতা। ঠিক একই ভাবে নাটকের ক্ষেত্রেও রুশ বিপ্লবের পর সৃষ্ট ধারা তার রেশ ধরে রাখে এবং আরও বেশি রাজনৈতিক সংবেদনশীল হয়ে ফিরে আসে চল্লিশ পঞ্চাশের দশকের ইংল্যান্ড, আমেরিকা, জার্মানি,আয়ারল্যান্ডের নাটকে এবং এই সময়ের শ্রেষ্ঠ প্রতিভা হিসেবে বিবেচনা করা হয় শন ওকেসি, বের্টোল্ট ব্রেখটের নাম।
বেটোল্ট ব্রেখটে শুধু নাট্যকারই ছিলেন না ছিলেন নাট্য তাত্ত্বিকও তার সরল কৌতুক মন্ডিত স্টাইলের আড়ালে লুকিয়ে থাকে গভীর তত্ত্ব। ব্রেখট যেমন আধুনিক নাটককে পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন "এপিক থিয়েটারের" সঙ্গে তেমনি ভাবে তিনি তার নাটকের সাথে যুক্ত করেছেন এ্যালিয়েনশন বা বিযুক্তিতের তত্ত্ব। রাজনৈতিক নাটককে তিনি এমন এক স্থানে নিয়ে গিয়েছিলেন যা শুধু নিছক রাজনৈতিক উদ্দেশ্য মূলক নাটক না হয়ে হয়ে ওঠে ব্যাপকও প্রভাব সম্পন্ন নাটক। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় তিনি পারি জমান আমেরিকায় এরপর ফিরে আসেন পূ্র্ব জার্মানীতে কিন্তু ১৯৫৩ সালে শ্রমিকদের মিছিল সরকার কঠোর হাতে দমন করলে আশাভঙ্গ হন ব্রেখট তার প্রতিবাদ স্বরুপ তিনি কবিতা লেখেন যা তার জীবিত দশায় প্রকাশিত হয় না। অবশেষে নাটকে হাতিয়ার করে সাম্যবাদী সমাজ প্রতিষ্ঠা করার রুপকারের মৃত্যু ঘটে ১৯৫৬ সালে। এই ধারার আরও একটি নাটকের নাম না বললে এই আলোচনা অসম্পূণ থেকে যায় সেটা হচ্ছে শন ওকেসির "দি স্টার টানস রেড"।যদিও এ নাটকটি মার্কস লেনিনের কমিউনিজম কে পুরোপুরি অনুসরণ না করার দায়ে অভিযুক্ত।
বাংলা নাটকে রাজনৈতিক প্রভাব প্রথম লক্ষ করা যায় ১৮৬০ সালে দীণবন্ধু মিত্র কর্তৃক প্রকাশিত "নীল দর্পন" নাটকে। পরবর্তীতে এটা আরও বেগবান হয় চল্লিশের দশকে গণনাট্য সংঘ প্রতিষ্ঠিত হওয়ার মধ্যে দিয়ে এবং তারা বাংলা নাটকে এক বিপুল পরিবর্তনের নেতৃত্ব দেন অভিনয় থেকে আলোক সজ্জা সব ক্ষেত্রে এবং তার উজ্জল দৃষ্টান্ত নবান্ন, ছেড়া তার, দুঃখীর ইমান সহ আরও অনেক নাটক। বাংলা নাটকের যারা কুশী লব তথা বিজন ভট্টাচার্য, তৃপ্তি মিত্র, ঋত্বিক ঘটক, তুলসী লাহিড়ী এরা সবাই ছিলেন গণ নাট্য সংঘের কর্মী।
বাংলাদেশের নাটক মূলত সক্রিয় হয় মুক্তিযুদ্ধের পর থেকে যদিও শুরুর দিকে তাদের অবস্থান রাজনৈতিক তাত্তিকদের দ্বারা সমালোচিত হয় কিন্তু পরবর্তীতে তাদের কাজের উৎকর্ষতায় এবং বিষয় বস্তুর ভেরিয়েশনে এ সমালোচনা এখন আর ধোপে টিকেনা। দেখা যাক কি ছিল আমাদের তৎকালীন নাট্যদল গুলোর চিন্তাভাবনা নাগরিক নাট্য সম্প্রদায় "নাটক প্রযোজনায় আমরা বিচিত্রতায় বিশ্বাসী। বিশেষ কোন মতবাদ বা দর্শনে আমরা বিশ্বাসী নই", বহুবচন বলেছিল "অভ্যস্ত চৈতন্যের দর্শককে নতুন ভাবে জীবন ও জগৎ সম্পকে চিন্তা ভাবনা করার ইন্ধন যোগানো "। ঢাকা থিয়েটার বলেছিল "জীবন ঘনিষ্ট হওয়ার জন্য নাটক করা "। যে পরিবর্তন এবং যে লক্ষ্য নিয়ে তারা যাত্রা শুরু করেছিল সেই জায়গাতে তারা পৌছাতে পেরেছে কিনা সেই বিশ্লেষণ এর ভার সময়ের উপর। আমি শুধু দর্শক হিসেবে বলতে পারি আজকের এই পুঁজিবাদী অপসংস্কৃতির ডামাডোলে মঞ্চনাটক একটুকরো শুদ্ধতা এবং আদ্যবধি এই চর্চা আশা জাগানিয়া।
তথ্যসুত্রঃ
১) উইকিপিডিয়া
২) থিয়েটার এন্ড পলিটিক্স- শেরিল ক্রোয়েন
৩) নাটক এবং রাজনীতি - মফিদুল হক
সর্বশেষ এডিট : ২৯ শে নভেম্বর, ২০১০ সকাল ৮:১০