একটু একটু করে নড়ছে সামনের পোকাটা পেছনের পায়ের উপর ভর করে টিকটিকিটা ধীরে ধীরে আগাচ্ছে , আমি শুয়ে শুয়ে দেখছি টিকটিকিটাকে, যদিও আমার ভেতরে খুব তীব্র ইচ্ছা হচ্ছে পোকাটাকে সরিয়ে দিতে। সরালাম না। কেন জানি আমার কিছুই করতে ইচ্ছে করছেনা , শুধু দেখে যাওয়া ছাড়া। যদিও দেখে যাওয়া কোন কাজের আওতায় ফেলা যায় কিনা তা আদৌ জানিনা ?খুব গরম চা খেতে ইচ্ছে করছে কিন্তু কে দেবে ? তার চেয়ে আর একটু শুয়ে থাকি ।রাত্রে ঘুমান এক কথায় ছেড়েই দিয়েছি,সারা রাত জুড়ে বাবার হাঁপানির কাশি। আজ কাল কেন জানি স্বপ্ন ভাল দেখিনা , শুধু ছেঁড়া ছেঁড়া কিছু অস্পষ্ট ছবি। ভাবছি এই দৃশ্যপট দিয়ে আমার ছবিটা শুরু করব । কোথায় শ্যূটিং করব এর জন্য একটা ভাল লোকেশন দেখা প্রয়োজন। আসলে লোকেশনও একটা ফ্যাক্ট এই বিষয়টা বিংকুদা বোঝেনা, আরে ভাই দেখ না রোমান পোলান্সকির কিংবা ক্লিন্ট ইস্ট উডের মুভির কি লোকেশন। আহা...
এই ভাইয়া ওঠ, ওঠ...সাত সকালে মুনিয়ার এই ডাকের অথ বাজারে যেতে হবে যেটা আমার খুবই অপছন্দের । বাথরুমে যাওয়ার পথে শুনলাম মা চিৎকার করছে, সম্ভবত আজকে চুলা জ্বালানোর কেরোসিন নেই...ধুর কোথাও শান্তি নেই, একটু যে শান্তিতে বাথরুমে যাব তারও উপায় নেই, গণবাথরুম এখন বুক। ভাবছি এই ফাঁকে একটা সিগারেট টেনে আসব, শওকত ভাইয়ের দেওয়া একটা এখনো পকেটে সকালটা সেটা দিয়েই কাটাতে হবে, এই শালা শওকত ভাই একটা লোক খালি মুভির ন্যারেশন নিয়ে ঘ্যানর ঘ্যানর । আরে শালা যে ছবির বাজেট হবে টেনে টুনে ৩০ লাখ সেইটাকে যদি ডিটেইলসে ন্যারেশন করতে যায় তাতে গ্যাঁটে কি কিছু থাকবে ? এইটা অবশ্য আতিক ভাই ও খুব বলে , নিজে যা দেখাতে চাস সেটাকে গুরুত্ব দে,কিভাবে চাস সেটাও তোর ব্যাপার শুধু মাথায় রাখবি তুই যা চাচ্ছিস সেটা ১০০% হচ্ছে কিনা। নাঃ দেরি হয়ে যাচ্ছে ...বাবু ভাই আমার অপেক্ষায় বসে আছে। কোন মতে গোসলটা সেরে বের হতেই দেখি মা মুড়ির বাটি নিয়ে বসে আছে মেজাজটাই খারাপ হয়ে গেল। রাগে মনে হল না খেয়েই বের হয়ে আসি, আরে আমি কি ইচ্ছা করলে চাকরী করতে পারিনা ঠিকই পারি আরে এসব ৯ টা - ৫ টা চাকরী করে কি আমার পোষাবে ? আরে ভাই সিনেমা একটা আট, একটা কলা !! এইসব সবাই পারেনা পারলে অই নান্টু, মন্টু সবাই পরিচালক হত। মা এইটা বোঝেনা। না খেয়েই বেড়িয়ে আসতাম, নিছক মুনিয়া শুধু বলল ভাইয়া খেয়ে যা দুপুরে রান্না কখন হবে তার ঠিক নেই। আর বাজারে গেলে একটু মাছ নিয়ে আসিস, বাবা অনেক দিন থেকেই মাছ মাছ করছিল। শেষের কথাটাই মনটা একটু খারাপ হয়ে গেল , গত ২ বছর ধরে বিংকুদার সাথে আছি এ্যাসিস্ট্যান্ট পরিচালক হিসেবে। এই মাসে হাতের অবস্থা খুব টান, আমাদের লাস্ট প্রোডাকশনটা কেচে গেছে এন টিভির প্রোগ্রাম কোঅডিনেটরের সাথে বিংকুদার বনিবনা না হওয়ায়। কিছুদিন হল এইটা নিয়ে মনটা খুব তেতে আছে, বাবাকে ডাক্তার দেখান দরকার টাকার অভাবে হচ্ছেনা, ব্যাংকে কিছু লোন আছে সেটাও শোধ দিতে পারছিনা। লাস্ট কয়েকটা নাটকের ভরাডুবির জন্য আমাদের হাতে কোনও কাজ ও নেই। বিংকুদা বসে আছে এবার সরকারের অনুদানের ছবিটা পাবে এই আশায়। বাবু ভাইকে ধরতে হবে ৫০-১০০ টাকা ধার নিতে হবে । এরা বোঝেনা আমার ছবিটা যখন হিট হবে তখন ওরকম ২০-৫০ টাকা আমার কাছে কোনও বিষয় নই। ওরা তখন দেখবে এই আনিস কি করতে পারে। ভাবছি আজ দুপুরের দিকে একটু পল্টনে যাব ওখানে আমার কিছু পুরানো বন্ধু আছে দেখি কোনও কাজ টাজ পাওয়া যাই কিনা। পল্টন থেকে একটু ধানমন্ডির দিকে আসত হবে, আজকে আবার রুশ কালচারাল সেন্টারে ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল আছে। আসলে এখন কার মুভিগুলো বড় বেশি টেকনোলজ়ি নিভর হয়ে যাচ্ছে আমি ছবির প্লটে বিশ্বাসী কিন্তু বাবু ভাই এটাতে সবসময় দ্বিমত পোষণ করে তার যুক্তি দশকের চাহিদা মেটাতে না পারলে এক সময় পুরো ইণ্ড্রাস্টি ধ্বংশ হয়ে যাবে, তখন দেখা যাবে তোমাদের মত অই দুই পয়সার আতেল মাকা সিনেমা গুলো ধুকছে আমি এর প্রতিবাদ করিনি কারণ বাবু ভাইয়ের মত টাকাজীবী মানুষের কাছ থেকে আর কিই বা আশা করা যায় ?
মাঝে মাঝে মনে হয় ধুর শুদ্ধতার চচা এর চেয়ে ভাল বাজারি নাটক সিনেমা বানায়, সহজ ফমুলা আধা কেজি মারামারির ভেতর এক মুঠো সেক্স তার সাথে এক চিমটি রোমান্স এবং সাথে একটু পারাবারিক সাস্পেন্স ,যেন একেবারে মাখন !!! কিন্তু ভাবলেই মাথায় রক্ত উঠে যায় আমি আনিস কিনা যাব অই বস্তা পচা সিনেমা বানাতে !!! দেখা যাক অনুদানটা পাওয়া যায় কিনা। আজকে বিংকুদা ফোন দিয়েছিল কালকে একটু সাংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ে যেতে হবে। এই সব মন্ত্রণালয়ে যাওয়ার কথা শুনলেই আমার গায়ে জ্বর আসে কারণ আমি তো আর সরকারী দলের নেতা নই যে আমাকে জামাই আদর করবে। তারপর ও যেতে হবে কারণ এই অনুদানের ছবিটাই আমাদের ভরসা, না পেলে দুজনকেই বিপদে পড়তে হবে।
আজ সকাল সকাল বিংকুদার বাড়ীতে এসে বসে আছি আজকে আমাদের স্ক্রিপ্টটা ঘষেমেজে ঠিক করার কথা। তবে এর ভেতরে একটা কাজ করেছি সেটা হচ্ছে , প্রথম শটের স্থান ঠিক করে ফেলেছি। আমাদের রেললাইনের পাশে যে হিজল গাছটা আছে সেটার পাশেই দূর থেকে ট্রেন আসছে সেটা লং শটে দেখান হবে আর ক্লোজ শটে মূল চরিত্র রজবের উদাসীন ভাবে হেটে আসা। সাংঘাতিক এক কম্বিনেশন, ভাবতেই আমার ভেতরটা মোচড় দিয়ে ওঠে । তীব্র আবেগে মনে হয় ভাসিয়ে দেই । “কি রে ঘুমাচ্ছিস নাকি ? ” বিংকুদার ডাকে আমার ভাসা ভাসি বন্ধ হয়। সিগারেট ধরিয়ে বিংকুদা জানিয়ে দেয় তার সারা দিনের প্ল্যান। যদিও মন্ত্রণালয়ে যাওয়ার কোন ইচ্ছেই আমার ছিলনা তবুও বিংকুদার কথামত যেতে হবে। আর আমার মনে হয় এটা আমার জীবনে একটা বড় ভুল ছিল। আমি একটা জিনিস কখনই মেনে নিতে পারিনা সেটা হচ্ছে সিনেমার নামে যা তা এ্যাবসাড জিনিস বানানো আর এটা নিয়েই কথা কাটাকাটি সচিবের পিএর সাথে আমি অবাক দেখি এই ধরনের ফালতু বিষয়ে এরা সব সময় একমত। আমার কি যে হল জানিনা মেরে দিলাম এক চড় তারপর কি হল জানিনা রাজাকারের বাচ্চা বলতে বলতে আমার উপর চড়াও হল সাংস্কৃ্তির পি এর চামচা তারপর কিভাবে দুই দিন কেটে গেছে বুঝতে পারিনি, তিন দিনের দিন যখন জ্ঞান ফিরল দেখি বিংকুদা ঘরে বসে আছে মুখের দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারলাম এই কয়েকদিন তার উপর দিয়ে অনেক ঝড় গেছে। যদিও আমার বলতে লজ্জা লাগছিল তবুও জিজ্ঞাসা করলাম বিংকুদা আমাদের সিনেমার অনুদানের কি হল ? বিংকুদা শুধু একটু কাষ্ঠ হাসি দিল আমি যা বোঝার তা বুঝে ফেললাম । “নারে হলনা !!” যদিও আমি সেটা জানতাম এত বড় ঘটনার পর আর যাই হোক অনুদান পাওয়া যায়না, তারপরও একটা ক্ষী্ণ আশা ছিল। যাহ্ সবই শেষ । এবারও হলনা, সেই শূটিং লোকেশন না কিছুই হলনা...শুধু একরাশ শূন্যতা ।
বিকেলের দিকে একটু বাইরে বের হতে ইচ্ছে হল যদিও শরীরটা খুব একটা সাপোট করছে বলে মনে হচ্ছেনা। মাঝে মাঝে মনে হয় ব্যাথতার ভারটা হয়ত বইতে পারবনা । বেচে থাকা আর মরে যাওয়ার মধ্যে আমি তেমন কোন পাথক্য দেখছিনা,যদিও মৃ্ত্যু বিষয়টার মধ্যে একধরণের রোমান্টিসিজম আছে বলে মনে হয়। তবুও এমন ক্লিশে হয়ে বেচে থাকতে ইচ্ছে করেনা। বাড়ীটাও কেন জানি নরক মনে হয় মুনিয়া টিউশনি করাচ্ছে মাকেও ঠোঙ্গা বানাতে হচ্ছে বাড়ীতে দুইজন অসুস্থ মানুষকে টানা তো চাট্টি খানি কথা নয়। নিজেকে মানুষ না বস্তা বলে মনে হয়। কিছু একটা করতে হবে, বেচে থাকতে হবে। হয়ত নিজের স্বপ্নকে বিক্রি করে। ট্রেনের লাইনটা আমাকে তীব্রভাবে টানছে আমার স্বপ্ন আমাকে টানছে দূ্র থেকে ট্রেনের হুইসেল শুনছি ,ইচ্ছে করছে না লাইন থেকে নামতে, আরো কাছে আসুক আমি শুধু অপেক্ষায় থাকি তার আলিঙ্গনের......