সকাল থেকেই আমেনার মনটা ভাল লাগছেনা, কি যেন একটা অস্বস্তি হচ্ছে।কালকে ও ওয়েস্টার্ণ ইউনিয়নে টাকা পাঠানোর পর থেকে একটা টেনশন কাজ করছে, টাকাগুলো কি ঠিক মত পৌঁছাবে। সাত পাঁচ ভাবতে ভাবতে বেলা গড়িয়ে ১০ টা বাজে আমেনা আবার কাজে মন দেয়।কাজ বলতে শেখের বাড়ীতে ঘর দোয়ার মোছা এবং রান্নার কাজে সাহায্য করা।প্রথম প্রথম ওর খুব কষ্ট হত এই রকম গরম আবহাওয়া তারপরে রান্না ঘরে কাজ আমেনা হাপিয়ে উঠত। যদিও আমেনা পদ্মা পাড়ের মেয়ে ছোট থেকেই প্রকৃ্তির সাথে এক প্রকার লড়াই করেই টিকে আছে তবুও ছায়া ঘেরা বরইচরা গ্রামের সাথে ধূ ধূ মরুর শহর রিয়াদের কোন তুলনা চলেনা।
বরই চরার কথা ভাবলেই আমেনার বুকটার মধ্যে হু হু করে ওঠে। কি সব দিন ছিল !! আব্বা তখন ধানের চাতালে কাজ করত সারাদিন পর আব্বা বাড়ীতে আসলে সে কি আনন্দ , চার ভাই বোন মিলে হুটোপুটি খেলা। আব্বার কাঁধে চড়া, শীতের ভেতর সকালে আম্মার হাতের পিঠা খাওয়া , কোথায় সেসব দিন। সষে ফুলের ক্ষেতে সারাদিন মান ঘুরে বেড়ান। আমেনা, আমেনা, জুয়ানের ডাকে আমেনা সম্বিত ফিরে পায়। জুয়ানা ফিলিপিনো সেও এসেছে ভাগ্য তাড়িত হয়ে আমেনার মতই। প্রথম প্রথম জুয়ানা আমেনাকে অনেক সাহায্য করেছে,কি সব দিন গেছে । “আমি তখন সদ্যই এস এস সি পরীক্ষা দিয়েছি একদিন হঠাৎ করেই আব্বার চাতাল থেকে খবর এল আব্বা অসুস্থ আমি আর আম্মা দৌড়ে গিয়ে দেখি আব্বা বেহুশের মত গোঙ্গাচ্ছে ।ভ্যান ঠিক করে নিয়ে গেলাম ঈশ্বরদী হাসপাতালে ডাক্তার দেখলেন বললেন রাজশাহী নিয়ে যেতে কিন্তু কে নিয়ে যাবে, হাতে তখন টাকা বলতে আম্মার আঁচলে বাধা পঞ্চাশ টাকা । আব্বা বাড়ীতে ফিরে আসে তার বাম অংশ অচল হয়ে যায়। আব্বার ধানের চাতালে কাজটা চলে যায়। বাড়ীতে মা,ছোট দুইটা বোন আর একটা ভাই , আস্তে আস্তে সবই বিক্রি হয়ে যায় গরু, নানার দেওয়া আম্মার সোনার চুড়ি সব কিছুই আর তার সাথে আমার স্বপ্ন। এলাকার বড় ভাইয়ের পরামর্শে কাজ নিই গার্মেন্টস এ মনের ভেতরে একটাই চিন্তা মানুষ করতে হবে আমার ভাই বোন গুলোকে । ঈদের ছুটিতে বাড়ী যায় গিয়েই অবাক হয় আম্মা আমার বিয়ে ঠিক করে রেখেছে তারই এক ভাইয়ের ছেলের সাথে আমি বুঝে ওঠার আগেই বিয়েটা হয়ে যায়। প্রথম থেকেই আমি লক্ষ্য করতাম আমার চাকরীটা কেন জানি ও সহ্য করতে পারত না, বিভিন্ন কথা প্রসঙ্গে আমাকে অপমান করত। তারপর একসময় শুরু হ ল যৌতুকের জন্য বিভিন্ন অজুহাতে নির্যাতন , মেনে নিতাম বা মেনে নিতে হত আমার পরিবার আমার বাবার কথা চিন্তা করে। একবার মনে করলাম চাকরিটা ছেড়েই দিই,ঠিক তার কিছু দিনের মধ্যেই আবিস্কার করলাম আমার জীবনের সবচেয়ে বড় ধাক্কা আসলে আমার স্বামী একজন নারী প্রাচারকারী এবং সে অন্য এক মহিলাকে বিয়েও করেছে। এক সময় মনে হল আত্মহত্যা করি কিন্তু অনেক দেরি হয়ে গেছে , আমার ভেতরে বাস করছে আরেকটা শরীর। জানিনা কি হল তিন দিন অজ্ঞান হয়েছিলাম “।
আজকের আকাশটা কেমন যেন গুমোট হয়ত বৃষ্টি হবে, বাংলাদেশের মত বৃষ্টি। বৃষ্টিতে ভিজতে খুব ইচ্ছে করে। বিপ্লবদা বলত বৃষ্টি হচ্ছে ঈশ্বরেরর চোখের জল,ঈশ্বর যাকে ভালবাসেন তাদের মনের কষ্টগুলো তিনি বৃষ্টির পানিতে ধুয়ে দেন। আরও অনেক কথা বলতেন তিনি, আমি তখ ন ১০ম শ্রেণীর ছাত্রী। আমাদের পাড়ার সান্ধ্য স্কুলের সামনে কখনও কখনও দেশ রাজনীতি নিয়ে কথা বলতেন, বলতে বলতে তার চোখ চকচক করে উঠত, লন্ঠণের আলোয় আমরা দেখতাম এক স্বপ্নালু মানুষকে ।কেমন মায়া মায়া চেহারার একজন মানুষ, আমার খুব ইচ্ছে হত বিপ্লবদা আমার হাত ধরুক।কিন্তু সেটা আর হয়ে ওঠেনি একদিন সকালে উঠে শুনি চারেদিকে হৈচৈ মিরকামারীর চরে নাকি র্যাব এক চরমপন্থীকে হত্যা করেছে সবার সাথে আমিও যাই , গিয়ে দেখি আমাদের প্রিয় বিপ্লবদার ক্ষত বিক্ষত লাশ । আমি বুঝতে পারিনা চরমপন্থী কে বিপ্লবদা নাকি তারা যারা তাকে অসহায় ভাবে হত্যা করল।
এই হতচ্ছাড়া দেশে বৃষ্টির আশা করে লাভ নেই । কবে যেতে পারব আবার দেশে জানিনা, পার্সপোটটা রেখে দিয়েছে ঐ হারামজাদা দালাল। আমার ছেলেটাও নাকি খুব
বৃষ্টি ভালবাসে ।কতদিন ওকে দেখিনা । খুব দেখতে ইচ্ছে করে মনে চায় ওকে ধরে চুমোয় চুমোয় ওর মুখটা ভরে দেই। কিছুই ভাল লাগেনা , সন্ধ্যার একটু আগে ঝুম বৃষ্টি আসে । মোবাইল হাতে নিয়ে ফোন করতে থাকি বোন সেলিনার নাম্বারে রিং হয় ফোন ধরে টগর, আমার জান আমার টগর , হ্যালো হ্যালো বলতে থাকে টগর আমি কথা বলতে পারিনা , আমি বলতে পারিনা বাবারে আমি তোর মা, তোকে ছাড়া থাকতে আমার বুকটা ফেটে যায়রে বাজান। কিছুই বলতে পারিনা শুধু কান্না ছাড়া। ১০ বাই ৬ ফুট ঘরে আমার কান্না ধুয়ে যায় রিয়াদের তপ্ত বৃষ্টিতে।
সর্বশেষ এডিট : ২০ শে জানুয়ারি, ২০১২ রাত ৮:৫৫