ফটোঃ এডবি স্টক
অনেক কাল আগের কথা। তখন গ্রাম আর শহর বলতে তেমন তফাৎ ছিল না। ধোপাগিরি তেমন চালু না থাকলেও চলছিল। তো এক ধোপা বাস করত সেইরকম এক গ্রামে।
ধোপার রোজগার ভাল ছিল, লোকেরা তার কাপড় ধোয়ার প্রশংসা না করে পারত না। আর ধোপাও ছিল খানিকটা পয়সা লোভী।
ধোপার কাজে সাহায্য করতো এক বুড়ো গাধা। গাধাটি ছিল অন্য পাঁচটা গাধা থেকে আলাদা। সে এক চামচ বেশি বুঝতো। ঘোলা জল পছন্দ করতো না। আর এই গাধাটির সাথে কেমন করে যেন ধোপা কথাও বলে ফেলত। অবশ্য তা গ্রামের লোকেরা খেয়াল করত না তেমন একটা।
তো, এক ভরদুপুরে সেই গাধা দেখল তার মালিক বেশ আরাম করে রুটি খাইতেছে। সে আহ্লাদ করে মালিককে বললো- আমারো খুব খিদে পেয়েছে।
- তো আমি কি করবো?
- এক খানা রুটি
মালিক তো রেগে একেবারে আগুন। বললো, আমার রুটির ওপরেও নজর রাখিস? গাধা কোথাকার? মালিক ধপাস ধপাস করে বাড়ি কয়েক দিয়ে তাকে পাঠিয়ে দিল মাঠের ঘাস আর নদীর জল খেতে।
গাধা বিড়বিড় করে মাঠের দিকে পথ চলতে লাগল।
- আমার মনে হচ্ছে গাধা হইয়া জন্ম নেওয়াটাই পাপ। পাজী মালিক? আমাকে এত খাঁটান দেয় আর এক টুকরো রুটিও আমার কপালে জুটতে দেয় না? আর আজকাল মানুষেরাও একজন আরেকজনকে গাধা বলে গালাগাল দেয়! ছিহঃ
গাধা নিজকে প্রবোধ দিতে ব্যর্থ হয়। শেষমেষ নিজেকে গাধা হিসাবে মানতে পারে না। ঘাষ খেয়ে কেবলমাত্র নদীর জলে সে মুখ দিতে যাবে এমন সময় শোনা গেল মালিকের হাঁক- এই গাধা গেলি কোথায়?
গাধা ইচ্ছে মত শাপ দিতে দিতে যেই পানি খেতে গেল তো দেখল স্থির পানিতে কাপড় ধোয়ার পানি এখনো যায় নি। কেমন যেন ময়লা গন্ধ তার নাকে লাগছে। সে আবার মালিককে অভিশাপ দিতে লাগল আহাঃ দু ফোটা জলও আমার কপালে জুটবে না?
গাধাটি কাপড় বহন করতে করতে মালিকের দিকে আঁড়চোখে দেখল। মালিক কেমন যেন বে-খেয়ালী হয়ে আছেন দেখে কোমর দুলিয়ে দিল কয়েক গাঁট কাপড় ফেলে। সাথে সাথে মালিক তাকে ধপাস ধপাস করে লাটি দিয়ে দিল গদাম। মনে মনে অপারগ গাধা আবারো মালিককে ইচ্ছেমত গালি দিতে থাকল যতক্ষণ সে বাড়ি পর্যন্ত না পৌছল।
ধোপা মালিকটি কাপড়ের গাট্টি নামাতে নামাতে গাধাকে তিরস্কার করে বলল- আজ রাতে তোকে আর খাবার দেব না গাধার বাচ্চা গাধা। যাঃ ভাগ এখান থেকে।
গাধা কাকুতি মিনতি করে বলল- মালিক দয়া করুন আমাকে। আমাকে না খাইয়ে মারবেন না। একটু দয়া করুন।
- না তোকে আজ কোন খাবার দেওয়া যাবে না। ভাগ আমার সামনে থেকে।
গাধা ঠায় দাঁড়িয়ে থাকল। আর মালিক কাপড়গুলি নিয়ে ঘরে চলে গেল। এইদিকে বুড়ো গাধার মাথায় অন্য বুদ্ধি চলে আসল। সে হাঁটতে হাঁটতে পাশের বাড়ি চলে গেল। সেখানে এক বাচ্চা গান শিখছিল। ওস্তাদ প্রতিবেশি বাচ্চাকে শেখাচ্ছিলেন গান।
পুর্ণিমা রাতে এই গান গাইবে-
"পুর্ণিমা রাতে, গগনে উঠিল চাঁদা"
বুড়ো গাধার কাছে গান জিনিসটা খুব ভাল লাগে। সেও বলে ওঠলো "পুর্ণিমা রাতে, গগনে উঠিল চাঁদা"। এইদিকে শিষ্যকে শেখাতে শেখাতে বিরক্ত হইয়া ওস্তাদ বলে ওঠলেন-
তোর চাইতে এই গাধাটাও ভাল গাইতে পারে।
সে কথা শুনিয়া ছাত্র ঘর থেকে বের হইয়া গাধার পাছায় দিল এক লাত্থি। গাধাটি দুঃখে ক্ষোভে আবার হাটা শুরু করল।
উপর্যুপরি অপমানিত বোধ করায় আজকে আর বাড়িতে না ফিরতে মনস্থির করল অসহায় বুড়ো গাধা। সে ঐ ছেলেকে একশোবার অভিশাপ দিতে দিতে মাঠ পেরিয়ে বনের দিকে পথ চলল।
ধীরে ধীরে পথ চলতে চলতে গিয়ে সন্ধার দিকে যখন বনে পৌছল তখন সে দেখল এক শেয়াল ধীরে ধীরে বন থেকে বেরুচ্ছে। শেয়ালের সামনে পড়াতে সে জানতে চাইল বনে পর্যাপ্ত খাবার পাওয়া যায় কি-না।
হাসতে হাসতে শেয়াল বলল তবে আমি গ্রামের দিকে ছুটছি কেন?
- না মানে বলছিলাম বনে তো আর পাজি মনুষ্য থাকে না। হয়ত ওখানে ইচ্ছেমত খাবার খাওয়া যাবে।
- আরে নাহঃ গাধা মিয়া। বনে কিচ্ছু নাই উল্টা বাঘের পেটে ক্ষিদে থাকলে তোমারেও খাইয়া ফেলবে।
হায়ঃ হায়ঃ বলিস কি-রে? তাইলে তো ঐদিকে আর যাওয়া যাবে না। ভাবছিলাম গ্রামে বেগার খাটতে খাটতে যে জীবন পার করতেছি উহা বনে গেলে ভাল হইয়া যাইবে। কিন্তু একি?
- শুনো মিয়া, তোমারে আমি ভাল করে চিনি। তোমার পতিবেশি আছে না? ওর ক্ষিরাই ক্ষেত আছে। চলো, ওখানে গিয়া ইচ্ছামত খাওয়া যাবে।হু।
গাধার মাথায় কোনদিনই এই বুদ্ধি আসেনি যে কৃষকের শস্য, সবজি এইগুলা খাওয়া যায়। শেয়ালের কথায় গাধা যেন রীতিমত নাচতে শুরু করে আরকি।
শেয়াল তাকে নিয়ে চলল ক্ষিরাই ক্ষেতে। মনের সুখে দুজন শস্য খেতে লাগল। বিশেষত গাধা গোগ্রাসে যেন গিলতে লাগল। যখন দুজনেরই পেট মোটামুটি ভরপুর তখন গাধা ডাকল-
- ও শেয়াল ভাই। খাওয়া কি শেষ হয় নাই?
- নাঃ আরো কয়েক আইটেম চেক করে নি।
- ভাল। এই সুযোগে আমি গানটি গেয়ে নিই।
- না না না,গাধা ভাই। কোন গান চলবে না। ক্ষেতের কোনায় যে ছোট্ট ঘর দেখা যায় ওখানে চৌকিদার থাকে। সে জেনে ফেললে দুই জনেই মাইরপিট খাওয়া লাগবে।
- না ভাই, আমি অতো শত বুঝি না। আমার গান গাওয়া শুনে সে দেখবি আরো কয়েকখানা শস্য উপহার দিবে। স্বয়ং ওস্তাদ আমার গানের প্রশংসা করে আর এই চামচা চৌকিদার আর কি? হেঃ
শেয়াল বহুত বুঝিয়ে সুজিয়ে গাধার গান গাওয়া থামাতে চেস্টা করল। কিন্তু গাধার এক কথা, আমি প্রমাণ পাইয়াছি আমার গানের গলা ভাল। তুই বনে থাকা শেয়াল উহার বুঝবি কি?
অগত্যা শেয়াল তার লেজ গুটিয়ে পলায়ন শুরু করল আর এইদিকে গাধা ঢোল হয়ে বসে ক্ষিরাই ক্ষেতের মাঝে হেঁড়ে গলায় চেঁচানো শুরু করল।
গ্রামের বহু লোকের ঘুম গেল ভেঙে। এর মধ্যে আবার ক্ষিরাই চুরি করে খাওয়া। চৌকিদার থেকে শুরু করে গ্রামের বেশ কয়েকজন যুবক লাটি দিয়ে গদাম দিতে দিতে তাকে নিয়ে এল ধোপার বাড়িতে।
ধোপা দেখল গাধা মহাশয় খুব বেশি করে পিটানি খেয়ে ফেলেছে আর এর কান্ড কুকীর্তি শুনে ধোপা মহাশয়ের মেজাজ গেল আরো চরমে। মনে স্থির করলেন আজ এই গাধাটাকে জ্যান্ত মাটি চাপাই দেওয়াই হবে উচিত শাস্তি। উহার বয়স বেশি হইয়া গেছে, আর কাম দিব না। খালি উল্টাপাল্টা করতে থাকবই। এই জম্মে উহার আর শিক্ষে হবে না।
সর্বশেষ এডিট : ১৭ ই এপ্রিল, ২০২২ সন্ধ্যা ৭:১৮