somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

হৃদি ভেসে যায় অলকানন্দা জলে

০৮ ই জুন, ২০১৭ দুপুর ১২:২৩
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



উত্তর ভারতের হিমালয় সিরিজের অন্য পর্বগুলো

প্রচন্ড ঝাকুনিতে বাসের ছাদে মাথা ঠুকে গেল আর চিৎকার করে উঠলাম, “ওরে বাবারে! গেছিরে!!” জানালার ধারে বসে থাকা সাধু বাবা ইয়া মোটামোটা চোখ তুলে আমার দিকে তাকিয়ে বললো, “এই তুমি বাঙ্গালী?” বাপরে! গলার কি আওয়াজ। মনেহচ্ছে যেন কোন সিংহ গর্জন করে উঠলো।


এই পর্বটি উৎসর্গ করা হলো সামুর একজন আপাদমস্তক কবি অদৃশ্য মানব কে। হে অদৃশ্য মানব, আমি আপনাকে খুবই মিস করি।


ভোর পাঁচটার সময় বাসখানা যখন দেখলাম তখন আমার একেবারে আক্কেল-গুড়ুম। এটাকে অবশ্যই বাস বলা যায় না, এমনকি মিনিবাসও বলা যায় না। নাকবোচা একটা জীপগাড়িকে লেজ ধরে টানলে যা হয় এরকমই উদ্ভট একটা ইঞ্জিনচালিত বাহন। তার মধ্যে আমার সীটটা হচ্ছে সবচেয়ে খারাপ, একেবারের শেষের সারিতে পাচটি সীটের মাঝখানেরটিতে। অর্থাৎ দুপাশের দুটো জানালা থেকে দুজন করে দূরে।

ভারতের উত্তরাখন্ডের একটি বিখ্যাত পাহাড়ি ধর্মীয় শহর উত্তরকাশী থেকে পৃথিবীর একটি বিখ্যাত মন্দির কেদারনাথে যাবো। কেদারনাথ মন্দিরটি হিমালয়ের কোলে ১২,০০০ ফুট উচুতে অবস্থিত। ২০১৩ সালের প্রলয়ঙ্করী বন্যায় কেদারনাথ মন্দিরের প্রাঙ্গন ও এর আশেপাশের কমপক্ষে ৬০ টি গ্রাম পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে গিয়েছিলো। মারা যায় ৬ হাজারেরও বেশি মানুষ, নিখোঁজ ২৫ হাজারের বেশি। শুধুমাত্র কেদারনাথ মন্দিরটা অলৌকিক ভাবে রক্ষা পায়। প্রচন্ড বন্যার তোড়ে প্রায় দোতলা সমান বড় একটা পাথর এসে আটকে পড়ে মন্দিরের পিছনে, সেই পাথরটাই মন্দিরের মুল কাঠামোকে টিকিয়ে রাখে। এই প্রলয়ঙ্কারী প্রাকৃতিক দুর্যোগটিকে নিয়ে প্রায়ই ন্যাশনাল জিওগ্রাফি ও ডিসকভারি চ্যানেলে বিভিন্ন ডকুমেন্টারি প্রদর্শিত হয়।


যাই হোক, উত্তরকাশী থেকে রওনা দিয়েছি শ্রীনগরের উদ্দেশ্যে। এই শ্রীনগর কাশ্মীরের রাজধানী শ্রীনগর নয়, এটা হচ্ছে উত্তরাখন্ড রাজ্যের গাড়োয়াল বিভাগের সবচেয়ে বড় শহর এবং একদা গাড়োয়াল রাজ্যের রাজধানী শ্রীনগর।


বাস খুড়িয়ে খুড়িয়ে চলেছে। পাহাড়ে উঠছে তো উঠছেই। এর যেন কোন শেষ নেই। আবার যখন নামছে তো নামছেই। পাশেই তেহেরি ড্যাম। গঙ্গা নদীকে এখানে আটকে রাখা হয়েছে। কয়েকঘন্টা ধরে চলেছি তো চলেছিই। তবু এই ড্যাম শেষ হচ্ছে না। আহারে, কতো বিপুল পরিমাণ পানি এখানে ধরে রাখা হয়েছে!


সাধুবাবা আমার সাথে গল্প জুড়ে দিলো। তাকে বললাম যে আমি বাংলাদেশ থেকে এসেছি। এটা শুনেই তিনি বাচ্চাদের মতো খুশি হয়ে গেলেন। তিনি শুনেছেন যে বাংলাদেশ পৃথিবীর সবচাইতে সুন্দর দেশ। এত্তো সবুজ! একবার তিনি নাকি পশ্চিমবঙ্গের ভগবানগোলা-লালগোলা সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশ দেখেছিলেন। আহা কি সুন্দর। বাংলাদেশের মাটি দেখলেই নাকি পূণ্য হয়। তার খুবই ইচ্ছা বাংলাদেশে আসার। আচ্ছা সাধু-সন্ন্যাসীদের কি অন্যদেশে যেতে কোন অনুমতি লাগে? তার এই ছেলেমানুষি কথায় হো হো করে হেসে উঠলাম। আমার ক্যামেরায় বাংলাদেশের কতোগুলো ছবি ছিলো। সাধুবাবা সেগুলো খুবই আগ্রহের সাথে দেখতে লাগলেন।


আমাদের গল্পে আকৃষ্ট হলেন আরেক ভদ্রলোক। জিজ্ঞাসা করলেন আমরা বাংলায় কথা বলছি কিনা। বললাম যে হ্যা, আমরা যে ভাষাতে কথা বলছি এটা বাংলা। এটা শুনে তিনি বললেন যে বাংলা হচ্ছে পৃথিবীর সবচেয়ে দ্বিতীয় শ্রুতিমধুর ভাষা। প্রচন্ড পরিমানে অবাক হলাম, এরকম কোন তথ্য সত্যিই আমি জানতাম না। ভদ্রলোক আরো বললেন যে পৃথিবীর সবচেয়ে শ্রুতিমধুর ভাষা হচ্ছে ফ্রেঞ্চ, আর তারপরেই বাংলা। নিজের পরিচয় দিলেন তিনি। তার নাম Aanad Siaegh Rana. তিনি হচ্ছেন উত্তরাখন্ডের সিপিআই এর সাধারণ সম্পাদক। এতো অবাক হলাম। একটি রাজ্যের একটি রাজনৈতিক দলের সাধারণ সম্পাদক কিনা লোকাল বাসে চলাচল করছে। এটা তো আমাদের দেশে একেবারেই অসম্ভব।


সাধুবাবার সাথে আমি বাংলাতে যেসব কথা বলি আনন্দ সাহেব গভীর মনোযোগের সাথে সেগুলো শোনেন। তারপর সেই কথাগুলো হিন্দিতে তাকে অনুবাদ করে দিতে হয়। আমার হিন্দির দৌড় অবশ্য শিয়ালের মতো হুক্কাহুয়া টাইপের। আনন্দ সাহেব তারপর সেগুলো এক নেপালী যাত্রী আর এক মহারাষ্ট্রীয় যাত্রিকে ভালো হিন্দীতে শোনাচ্ছেন।


আনন্দ সাহেবের সাথেও বিভিন্ন বিষয় নিয়ে গল্প হচ্ছে। তিনি বললেন যে তিনি তসলিমা নাসরিনের লজ্জা বইটির অনুবাদ পড়েছেন। তাকে জানালাম যে এই বইটা পড়ার সৌভাগ্য আমার হয়নি কারণ এই বইটা বাংলাদেশ ব্যান্ড করা হয়েছে। তিনি তসলিমাকে নিয়ে কিছুটা বিষেদাগার করলেন, তসলিমার দ্বিমুখী নীতির সমালোচনা করলেন। বললেন, তসলিমা বাংলাদেশের হিন্দু সংখ্যালঘুদের অত্যাচারের বিপক্ষে সোচ্চার অথচ ভারতের মুসলমান সংখ্যালঘুদের অত্যাচারে কোন কথা বলে না। আনন্দ সাহেবকে বললাম যে তসলিমা আসলে বাংলাদেশের মূল ধারার লেখক না।


আনন্দ সাহেব এই প্রথম কোন বাংলাদেশি দেখলেন। আমাকে বললেন, চলো আমি তোমাকে এখানকার প্রেসের সাথে মিট করিয়ে দিই। তুমি এখানকার রেডিওতে বাংলাদেশ সম্পর্কে কিছু বলবে। তার এ প্রস্তাব আমার জন্য প্রচন্ড পরিমানে বিব্রতকর। বিনয়ের সাথে আমি তার এই প্রস্তাব প্রত্যাখান করলাম।


দুপুর দুইটার দিকে বাস শ্রীনগর শহরের কাছাকাছি এসে থামলো। এখানে অনেক লোক নেমে গেল। সামনে জানালার ধারে সীট খালি হওয়ায় আমি সেখানে গিয়ে বসলাম। আনন্দ সাহেবও পেছনের সীট ছেড়ে আমার পাশে এসে বসলো। তারপর জানালা দিয়ে হাত বের করে বাইরে দেখিয়ে বললো, ওই যে অলকানন্দা।


অলকানন্দার কথা ভাবলেই আমার চোখের সামনে একটা মেয়ের ছবি ভেসে ওঠে। মেয়েটার গোলাকার মুখ, টানাটানা চোখে কাজল দেয়া। কপালে বড় একটা টিপ। পরনে কমলা-সাদা তাঁতের শাড়ি। পুরোহাতার সাদা ব্লাউজ। পায়ে আলতা আর নূপুর। সবুজ ঘাসের মধ্যে চুপটি করে বসে আছে সে। ভঙ্গিতে আবেদনের চাইতে স্নেহময়তা বেশি রয়েছে। শুধু একটা বিষয় নিয়েই কনফিউশনে থাকি, তার খোপায় জবা ফুল নাকি গোলাপ ফুল! আমার মনেহয় জবাফুলেই অলকানন্দাকে বেশি মানাবে।


কিন্তু এখন আমি অলকানন্দা নদীর দিকে আমি অবাক চোখে তাকিয়ে আছি। জীবনে দুটো নদী দেখার প্রচন্ড পরিমানে শখ ছিলো, তার একটা হচ্ছে অলকানন্দা। ব্যাপারটা আমার এখনো ঠিক বিশ্বাস হচ্ছে না। এই সেই বিখ্যাত নদীটা! আনন্দ সাহেবকে বললাম, বাংলাতে অলকানন্দাকে নিয়ে লেখা আছে। তিনি খুবই অবাক হলেন। বললেন, দয়াকরে আমি তাকে সেই লেখাটার কিছু অংশ শোনাতে পারি কিনা। আরো একবার বিব্রত হলাম। জানালাম লেখাটা যে কি তা আমি একেবারেই মনে করতে পারছি না।


অলকানন্দাকে আরো কাছ থেকে দেখেছিলাম। দেবপ্রয়াগে, যেখানে সবুজ কিশোরী অলকানন্দা কিছুটা ঘোলাটে ভগিরথীর সাথে সঙ্গমরত। তাদের এই সঙ্গম থেকেই সৃষ্টি হয়েছে পৃথিবীর সবচাইতে বিখ্যাত নদী গঙ্গা। তবে সবচাইতে কাছাকাছি গিয়েছিলাম বদ্রীনাথ মন্দিরের কাছে। ছোট্ট একটা নদী অথচ তার কি বিপুল স্রোত। পুরো এক বিকাল জুড়ে নদিটির একটি নির্জন অংশে বসেছিলাম। ভালোলাগার অসাধারণ কিছু মুহূর্ত। প্রিয় একটা নদীর কাছে প্রিয় কিছু সময়। অলকানন্দাকে একেবারেই আমার নিজস্ব সম্পত্তি মনে হয়েছিলো।


অলকানন্দার উৎসস্থল নন্দাদেবী, ত্রিশূল ও কামেট শৃঙ্গের বরফগলা জল। জায়গাটা অলকাপুরী নামে পরিচিত। হিন্দু শাস্ত্র অনুযায়ী অলকানন্দার দুপাশ ঘেঁষে পারিজাত, কল্পবৃক্ষ, মন্দার, সন্তানক আর হরিচন্দন নামক বৃক্ষের বন বিদ্যমান। আর নদীর তীরে সুরভি গাভী, ঐরাবত নামক হাতি, আর উচ্চেশ্রবা ঘোড়া চড়ে বেড়ায়। মাথার ভিতর কেমন যেন রোখ চেপে গেছে, ইনশাল্লাহ জীবনে একবার হলেও অলকাপুরীতে যাবো।


অলকানন্দাকে নিয়ে লেখাটা শেষ পর্যন্ত খুঁজে পেয়েছি। জয় গোস্বামীর লেখা একটা কবিতা।


অতল, তোমার সাক্ষাৎ পেয়ে চিনতে পারিনি বলে
হৃদি ভেসে গেল অলকানন্দা জলে
করো আনন্দ আয়োজন করে পড়ো
লিপি চিত্রিত লিপি আঁকাবাঁকা পাহাড়ের সানুতলে
যে একা ঘুরছে, তাকে খুঁজে বার করো
করেছো, অতল; করেছিলে; পড়ে হাত থেকে লিপিখানি
ভেসে যাচ্ছিল–ভেসে তো যেতই, মনে না করিয়ে দিলে;
–’পড়ে রইল যে!’ পড়েই থাকত–সে-লেখা তুলবে বলে
কবি ডুবে মরে, কবি ভেসে যায় অলকানন্দা জলে।।
সর্বশেষ এডিট : ০৮ ই জুন, ২০১৭ বিকাল ৩:০৩
১৭টি মন্তব্য ১৮টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আমিও যাবো একটু দূরে !!!!

লিখেছেন সেলিম আনোয়ার, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:২২

আমিও যাবো একটু দূরে
যদিও নই ভবঘুরে
তবুও যাবো
একটু খানি অবসরে।
ব্যস্ততা মোর থাকবে ঠিকই
বদলাবে শুধু কর্ম প্রকৃতি
প্রয়োজনে করতে হয়
স্রষ্টা প্রেমে মগ্ন থেকে
তবেই যদি মুক্তি মেলে
সফলতা তো সবাই চায়
সফল হবার একই উপায়।
রসুলের... ...বাকিটুকু পড়ুন

যে দেশে সকাল শুরু হয় দুর্ঘটনার খবর দেখে

লিখেছেন এম ডি মুসা, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৮:১১

প্রতি মিনিটে দুর্ঘটনার খবর দেখে অভ্যস্ত। প্রতিনিয়ত বন্যা জলোচ্ছ্বাস আসে না, প্রতিনিয়ত দুর্ঘটনার খবর আসে। আগে খুব ভোরে হকার এসে বাসায় পত্রিকা দিয়ে যেত। বর্তমানেও প্রচলিত আছে তবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমাদের দাদার দাদা।

লিখেছেন নাহল তরকারি, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৮:৫৫

বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১, ০৮ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী।

আমার দাদার জন্মসাল আনুমানিক ১৯৫৮ সাল। যদি তার জন্মতারিখ ০১-০১-১৯৫৮ সাল হয় তাহলে আজ তার বয়স... ...বাকিটুকু পড়ুন

জেনে নিন আপনি স্বাভাবিক মানুষ নাকি সাইকো?

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:১৮


আপনার কি কারো ভালো সহ্য হয়না? আপনার পোস্ট কেউ পড়েনা কিন্তু আরিফ আর হুসাইন এর পোস্ট সবাই পড়ে তাই বলে আরিফ ভাইকে হিংসা হয়?কেউ একজন মানুষকে হাসাতে পারে, মানুষ তাকে... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। মুক্তিযোদ্ধা

লিখেছেন শাহ আজিজ, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:২১



মুক্তিযুদ্ধের সঠিক তালিকা প্রণয়ন ও ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা প্রসঙ্গে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক বলেছেন, ‘দেশের প্রতিটি উপজেলা পর্যায়ে মুক্তিযোদ্ধা যাচাই বাছাই কমিটি রয়েছে। তারা স্থানীয়ভাবে যাচাই... ...বাকিটুকু পড়ুন

×