নূরজাহান বেগম।বয়স আনুমানিক ৫০-৬০ বছর হবে। দেশের বাড়ি রংপুর। আমার এক পরিচিত জনের বাসায় কাজ করেন।ওই বাসায় গেলে আমাকে কেন জানি না নূরজাহান বেগম অনেক আদর করেন। আমারও ওনার আদর পেতে মন্দ লাগে না।আমি ওনাকে খালাম্মা বলে ডাকি। কুরবানির ঈদের কয়েকদিন আগের কথা। আমি ওই বাসায় গেলাম। আমাকে বললেন, “বাবা বাড়ি যাবেন কবে?” আমি বললাম, “কুরবানির ৪-৫ দিন আগে যাব”। ওনার কাছে জানতে চাইলাম,উনি যাবেন কবে। আমাকে বললেন, কুরবানির ঈদের পরে যাবেন। আমি বললাম, রোজার ঈদের সময়ও তো ঈদের পরেই গেলেন। পরিবারের লোকদের সাথে ঈদ করতে মন চায় না খালাম্মা? আমার কথা শুনে উনি আবেগে আপ্লুত হয়ে গেলেন। আমার কাছে ওনার জীবনের কথার ঝাপি খুলে নিয়ে বসলেন। উনি অনর্গল বলে গেলেন আর আমি শুনতে থাকলাম। কারন শোনা ছাড়া আমার আর কিইবা করার আছে?
নূরজাহান বেগম প্রায় ৩৫-৪০ বছর যাবত ঢাকা শহরের বিভিন্ন বাসা বাড়িতে কাজ করেন। বিয়ের আগে বাসা বাড়িতে বাঁধা কাজ (ফুল টাইম কাজ করাকে বাঁধা কাজ বলে) করতেন। বিয়ের পর ছুটা বুয়া হিসেবে কাজ করেছেন। আর এখন এই শেষ বয়সে আবার বাঁধা কাজ করছেন। ওনার স্বামী মারা গেছেন। তিন ছেলে আর দুই মেয়ের সবাই বিয়ে করেছে। অনেক গুলো নাতি নাতনী আছে। কিন্তু ওনার কোথাও জায়গা হয়নি।উনি মাসে ৩০০০ টাকা বেতন পান যার পুরোটাই বাড়িতে ছেলে-মেয়েদের জন্য পাঠিয়ে দেন।আমি ওনার কাছে জানতে চাইলাম, যে ছেলে-মেয়েদের কাছে আপনার জায়গা হল না তাদের জন্য টাকা পাঠান কেন? আমার কথা শুনে উনি তো পুরাই অবাক! ছেলে-মেয়ে ছাড়া ওনার আর আছে কে!! তাদের জন্যই তো সারাজীবন এত দুঃখকষ্ট সহ্য করে চলেছেন। তারা ভাল থাকুক, এটাই চান।
আমি বললাম, তা অবশ্য ঠিকই বলেছেন!
কথার শেষের দিকে নুরজাহান বেগম আর কথা বলতে পারছিলেন না। তার দুই চোখ গড়িয়ে জল পড়ছিল। আমিও কিছু বলছিলাম না। নুরজাহান বেগম কেঁদেই চলেছেন। আর আমি রথিন্দ্রনাথ রায়ের গাওয়া “তোরে দয়াল আমি বলবো কেন বল? সারা জীবন ফেলবি যদি আমার চোখের জল” গানটির কথা ভাবছিলাম......
আমি জানি যত দিন শরীরে শক্তি আছে নূরজাহান বেগম এভাবেই কাজ করে যাবেন। সন্তানদের টাকাও পাঠাবেন। পরিবারের লোকদের সাথে ঈদ করতে পারবেন না। সকালে আরাম করে একটু ঘুমাতে পারবেন না। রাত ছাড়া গোসল করার সময় পাবেন না। মালিকের বাসায় সবার খাওয়া শেষ হলে খেতে যাবেন। রাতে নাতি নাতনীদের পাশে রেখে ঘুমাতে পারবেন না, কিংবা আদর করে নিজের পানের বাটা থেকে নাতিদের একটু পানও খাওয়াতে পারবেন না।একসময় যখন শরীরে আর কুলাবে না, দেশের বাড়ি চলে যাবেন। গিয়ে বউদের লাথি গুতা খেতে খেতেই একদিন ভবলীলা সাঙ্গ করবেন।
নুরজাহান বেগমের কথা ভেবে, আমার সামনে হটাত করে বাংলাদেশের প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেত্রীদের ঘন ঘন সৌদি আরব গমনের হেতু উন্মোচিত হল। বছরে দুই একবার ওমরা করার কারন বুঝতে পারলাম। একজীবনে দয়াল তাদের এত বেশি দয়া করেছেন যে, দয়ালের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশের জন্য বছরে একবার দুইবার নয়; তাদের উচিত প্রতি মাসে অন্তত একবার সৌদি আরব গমন করা......
সর্বশেষ এডিট : ০৪ ঠা অক্টোবর, ২০১৫ দুপুর ২:২৩