আমি গ্রামের পোলা। দেখেছি বরষার হাজারও রঙ! ২২ বছরের জীবনে কত বর্ষা এলো আর গেলো! বরাবরের মত এ বছর শ্রাবণ মাসে বর্ষাকাল যখন যাই যাই করছিল একদিন তুমুল ধারায় বরষা নেমে এসেছিলো-আমাদের ঢাকা ইউনিভার্সিটি ক্যাম্পাসে। অর্থনীতির পণ্ডিত অধ্যাপক,আমাদের সুশীল স্যার ‘ইকোনমিক্স অফ হেলথ কেয়ার’ কোর্সের ক্লাশ নিচ্ছিলেন। সবসময় আমি সুশীল স্যারের ক্লাশে পূর্ণ মনোযোগ দেই। কিন্তু সেদিন বাইরে অঝোর ধারার বরষা দেখে কিছুতেই ক্লাশে মন বসছিল না।
স্যার ক্লাশে ‘হেলথ ইনস্যুরেন্স’ পড়াচ্ছিলেন, আর আমি লেকচার খাতায় লিখছিলাম রবীন্দ্রনাথের একটি গান!
“মেঘের পরে মেঘ জমেছে,আঁধার করে আসে।
আমায় কেন বসিয়ে রাখ একা দ্বারের পাশে।”
মনে মনে রাগ করছিলাম বরষার উপর!আমার যে বরষায় ভিজতে ইচ্ছে করছে! কি দরকার ছিল এমন করে নামার! বরষায় আমার সাথে ভিজবে, এমন কে আছে ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে? আমি কদম জড়ায়ে দিব কার খোঁপায়? জলভরা মল চত্বরে আমি নাচবো কার সাথে?ছলকে ছলকে যখন বিজলী চমকে উঠলেকে জড়িয়ে ধরবে আমায়?
ক্লাশ শেষ।এদিকে বরষা আর তুমুল বেগে বেড়েই চলতেছিল। নিজেকে খুব অসহায় মনে হচ্ছিলো! ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে আসার পর নিজেকে এতটা নিঃসঙ্গ কখনো মনে হয়নি! ভাবলাম বরষাকে আজ একটা উচিত শিক্ষা দেব! আমার মন খারাপ করেছিস! আজ আমি একাই নামবো তোর মাঝে! নিশ্চয়ই তাতে তোর মন খারাপ হয়ে যাবে!
পাঁচতলা থেকে গুটি গুটি পায়ে নামলাম। ভেবেছিলাম প্রিয় বন্ধু সাইফ আর ইকবাল হয়ত পিছু নিবে! কিন্তু না, নিল না। অপরাজেয় বাঙলার পাশ দিয়ে যখন হাঁটছিলাম,অবাক হয়ে দেখলাম আমার পিছু নিয়েছেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ! আমার সাথে হেঁটে হেঁটে উনিও মলচত্বর গেলেন! আমি বললাম, “গুরু, আমাকে একটা গান শোনান না!”
উনি গেয়ে উঠলেন,
“আজ শ্রাবণের আমন্ত্রণে,
দুয়ার কাঁপে ক্ষণে ক্ষণে,
ঘরের বাঁধন যায় বুঝি আজ টুটে” ।
আমি শুনলাম। মুগ্ধ হলাম।ততক্ষণে আমরা ভিসি চত্বর হয়ে টিএসসির পথ ধরেছি। উনি বললেন, “সরদার, তুমিও একটা গাওনা!”আমি বললাম, ‘ঠিক আছে”।
“ওগো বৃষ্টি আমার চোখের পাতা ছুয়ো না,
আমার এতো সাধের কান্নার দাগ ধুয়ো না,
সে যেন এসে দেখে,
পথ চেয়ে তার কেমন করে কেঁদেছি”
আমার গান গাওয়া শেষ হতে হতে আমরা লাইব্রেরীর কাছে পৌঁছে গেছি।দেখলাম,রবীন্দ্রনাথের মন খারাপ ! আমাকে বললেন, “আমি আসার পরও তুমি তার পথ চেয়ে বসে আছো? ঠিক আছে, আমি চলে যাচ্ছি!” আমি তাঁকে বাঁধা দিলাম না।তিনি চলে গেলেন। আমি সমাজ বিজ্ঞান বিল্ডিঙের সামনে এসে যখন পৌঁছলাম, হটাত চমকে উঠলাম! দেখি, রিক্সার মধ্যে গুটিসুটি মেরে বসে আছেন শফিক চাচা!
শফিক চাচা আমাকে দেখেই বললেন, “মামা আপনে বৃষ্টিতে ভিজছেন!” আমি বললাম, “হ্যাঁ,মামা। ভাল লাগছে ভিজতে।” উনি বললেন, “আপনের তো জ্বর আসবে!” আমি বললাম,“ না মামা, আমি গ্রামের পোলা।কিচ্ছু হইব না! আপনে থাকেন।”
মসজিদের পাশ দিয়ে আমি শাহবাগের রাস্তা ধরলাম। দেখলাম, পাশ দিয়ে এক জুটি হেঁটে যাচ্ছে আর তাদের সাথে হেঁটে যাচ্ছেন রবীন্দ্রনাথ! তিনজনে একসাথে গেয়ে চলেছেন,
“যা না চাইবার তাই আজি চাই গো,
যা না পাইবার তাই কোথা পাই গো!”
আমি এবার রাগ করলাম,রবীন্দ্রনাথের উপর! বললাম, “দেখেছেন, আপনি থাকার পরও কেন আমার মন খারাপ হয়েছিল?”
আমি হন হন করে হেঁটে চললাম। হটাত, পেছন থেকে ডাক শুনতে পেলাম! “ মামা,দাঁড়ান! আমিও আইজ বৃষ্টিতে ভিজুম” । যা ভাবছিলাম, তাই।শফিক চাচা! আমাকে বললেন, “ওডেন। রিক্সায় ওডেন।” আমি নিঃশব্দে উঠলাম।শফিক চাচা হুড খুলে দিলেন।শফিক চাচা রিক্সা চালাচ্ছেন। আমি বসে আছি। উপরে আকাশ কেঁদেই চলেছে। শফিক চাচা কাজী নজরুল ইসলাম এভিনিউ হয়ে দোয়েল চত্বরের দিকে যাচ্ছেন।
বাংলা একাডেমীর পাশে গিয়ে শফিক চাচা একটা গান ধরলেন,
“আমার সোনা বন্ধুরে, তুমি কোথায় রইলারে,
যদি না পাই তোমারে, জীবন যাইব বিফলে”
শফিক চাচার জন্য আমার মায়া লাগলো। ভাবলাম, নিশ্চয়ই লোকটার মনের ভিতর লুকানো কোন কষ্ট আছে। যা আমার কাছে কোন দিনও বলেন নাই। ভাবলাম, জিজ্ঞাসা করি। আবার ভাবলাম, না দরকার নাই। মানুষের তো এমন অনেক কষ্টই থাকে, যা তার কোন আপনজন তার কাছে জানতে চায় না। অথবা সে বলে না!
আমাদের রিক্সা কার্জন হল, শহীদ মিনার হয়ে ফুলার রোডে চলে এলো। স্বাধীনতার সংগ্রামে হুমায়ূন আহম্মেদ কে দেখে তার লেখা আরেকটা গানের কথা মনে পড়ল। ভাবলাম, শাওন কাছে থাকলে তার কাছে হুমায়ূন আহম্মদের প্রিয় ওই গানটা শুনতে চাইতাম।
"যদি মন কাঁদে,
তুমি চলে এসো, চলে এসো
এক বরষায়………।
এসো ঝর ঝর বৃষ্টিতে
জল ভরা দৃষ্টিতে
এসো কোমল শ্যামল ছায় ।
যদিও তখন আকাশ থাকবে বৈরি
কদম গুচ্ছ হাতে নিয়ে আমি তৈরি ।
উতলা আকাশ মেঘে মেঘে হবে কালো
ছলকে ছলকে নাচিবে বিজলী আরো
তুমি চলে এসো, চলে এসো
এক বরষায়…………….
নামিবে আঁধার বেলা ফুরাবার ক্ষণ
মেঘ মাল্লা বৃষ্টিরও মনে মনে ।
কদম গুচ্ছ খোঁপায়ে জড়ায়ে দিয়ে
জল ভরা মাঠে নাচিব তোমায় নিয়ে
তুমি চলে এসো, চলে এসো
এক বরষায়……………
যদি মন কাঁদে
তুমি চলে এসো, চলে এসো
এক বরষায়……………."
রিক্সা এসে আমার হলের গেটে থামল। আমি নামলাম। সিঁড়ি বেয়ে বেঁয়ে উপরে উঠছিলাম। আর ভাবতে ছিলাম, আচ্ছা আমার জীবন কি শফিক চাচার মতই বিফলে গেলো ?
কিন্তু দেখলাম, না। আমার জীবন বিফলে যায়নি ।
আমার জন্য হয়ত কারো মন খারাপ হোল না,আমার কাছে না হয় কেউ গান শুনতে চাইল না, আমি হয়ত বরষায় কারো হাত ধরে হাঁটতে পারলাম না, আমি হয়ত জলভরা মাঠে কাউকে নিয়ে নাচতে পারলাম না,আমি হয়ত কারো খোঁপায় কদমগুচ্ছ জড়ায়ে দিতে পারলাম না... তাই বলে কি আমার জীবন বিফলে যাবে?
আমার তো শফিক চাচা আছেন। যিনি আমার সাথে সত্তর বছর বয়সেও বৃষ্টিতে ভিজতে চান। আমার তো রবীন্দ্রনাথ আছেন। যিনি নিজের মুখে আমাকে গান শোনাতে চান।আর। আমার তো বরষা আছে। যাকে আমি গান শুনাই। আর সে তো ক্লান্তিহীন ভাবে শুনেই চলে আমার অতি যত্নে গাওয়া সেই গান, শুনেই চলে............... ..................
সর্বশেষ এডিট : ২০ শে অক্টোবর, ২০১৫ দুপুর ২:৫৭