somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

মা,আমার মা...

১১ ই ডিসেম্বর, ২০১৫ বিকাল ৩:০২
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

আমি তখন মিশনারি স্কুলে পড়ি। সম্ভবত নার্সারি অথবা কেজি ওয়ানে।আমাদের ক্লাশ শুরু হত সকাল সাতটায়।আমার বড় আপা আমাকে স্কুলে দিয়ে আসতেন। তো একদিন স্কুলে গেলাম।আমাদের ক্লাশ নিতে আসলেন ঊষা চ্যাটার্জি,আমার বড়ই প্রিয় এক দিদিমণি।দিদিমণি আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন, “মাসুম, কি খেয়ে আসছ?” আমি উত্তর দিলাম, “দিদিমনি, পান্তা ভাত খেয়ে আসছি!” দিদিমণি আমাকে আর কিছুই বললেন না।

আমাদের মিশনারি স্কুলে তখন প্রতিমাসে একবার করে গার্ডিয়ান সম্মেলন হত। যথারীতি ওই মাসেও গার্ডিয়ান সম্মেলন হল। আমার মা সেই সম্মেলনে উপস্থিত হলেন। সেখানে স্কুলের ছাত্রদের সমস্ত গার্ডিয়ানদের সামনে দিদিমণি আমার মাকে দাড় করালেন। মায়ের কাছে জানতে চাইলেন কেন মা আমাকে পান্তা ভাত দিয়া সকালের নাশতা করিয়ে স্কুলে পাঠিয়েছেন!
মা বাড়িতে এসে আমাকে কিছুই বলেন নাই। তবে ভীষণ কেঁদেছিলেন! মা কেন সেদিন অমন করে কেঁদেছিলেন তা আমি তখন বুঝতে পারিনি। তবে হ্যাঁ, এখন বুঝি।

তখনকার দিনে অভাবের সংসার ছিল আমাদের। অনেকগুলো মানুষ ছিলাম পরিবারে। আব্বার একার পক্ষে আমাদের সকলের সকল চাহিদা পূরণ করা সম্ভব ছিল না। মায়ের মধ্যে খুব আক্ষেপ কাজ করত।কারন তাঁর ছেলেমেয়েরা সবাই পড়া শোনা করে কিন্তু তিনি তার সন্তানদের প্রয়োজনীয় অনেক চাহিদাই পূরণ করতে পারতেন না।উপায়ন্তর না দেখে, স্বামীর দিকে না তাকিয়ে নিজেই চেষ্টা করলেন কি করে আমাদের সকল চাহিদা পূরণ করা যায়।
একজন অশিক্ষিত মহিলা কি করে নিজেকে স্বাবলম্বী করে গড়ে তুলেছিলেন-ভাবতে অবাক লাগে।হাঁস-মুরগী-গরু-ছাগলের খামার করেছেন,নকশী কাঁথা সেলাই করেছেন। অতি পরিশ্রমের সেই পয়সা আমাদের পড়াশোনার পেছনে খরচ করেছেন।একটা পয়সাও নিজের জন্য সঞ্চয় করেননি।নিজের পেছনে খরচ করেননি।
তখনকার সময়ে সরকারি প্রাইমেরি স্কুলে ‘খাদ্যের বিনিময়ে শিক্ষা’ কার্যক্রম চালু ছিল। কিন্তু সতত নুন-লংকার জন্য সংগ্রামরত আমার মা, আমাকে চাল পাবেন কিংবা উপবৃত্তি পাবেন সেই আশায় সরকারি প্রাইমেরি স্কুলে ভর্তি করাননি! কষ্ট করে অর্জিত পয়সা খরচ করে আমাকে মিশনারি স্কুলে পড়িয়েছেন। কারন মিশনারি স্কুলে পড়ালেখার মান ভাল!
আজকে যখন পেছনের দিকে ফিরে তাকাই, ভেবে অবাক লাগে একজন স্বশিক্ষিত মানুষ কতটা সচেতন ছিলেন পড়ালেখার মান নিয়ে! আমার মাকে কেউ যদি জিজ্ঞেস করে আপনার ছেলে কোন ক্লাশে,কোন সাবজেক্টে পড়ে? আমার মা বিব্রত বোধ করেন। কারন তিনি বলতে পারেন না তার ছেলে কোন ক্লাশে পড়ে! তিনি শুধু জানেন তার ছেলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে!
আমি জীবনে যত মানুষ দেখেছি।আমার মায়ের মত কাউকে দেখিনি।একজন অতি সাধারণ,খেঁটে খাওয়া,গ্রাম্য বাঙালি মুসলমান মা। গুছিয়ে সবার সামনে কথা বলতে পারেন না।দামি একটা শাড়ি পড়তে চান না। ভাল কিছু রান্না হলে খেতে চান না। হয়ত বাংলাদেশের সকল দরিদ্র মায়েরাই এমন। কারো কাছে কোন ডিমান্ড নাই।কিন্তু নিজে অনবরত সাপ্লাই দিয়েই চলেন। তারপরও একুইলিব্রিয়াম।রিসোর্সের ম্যাক্সিমাম ইউটিলাইজেশন।হাইয়েস্ট সেটিসফেকশন।
পড়ালেখা শেষের দিকে। আব্বা,ভাইয়া সবার জিজ্ঞাসা পড়ালেখা শেষ হইতে কতদিন বাকি! মায়ের কোন জিজ্ঞাসা নাই। কারন কি জানেন? বললাম না, কোন ডিমান্ড নাই-শুধু সাপ্লাই!
বেশি বড় করব না লেখাটা।তবে ভেবে পাচ্ছি না মায়ের কোনটা রেখে কোনটা বলব। সব কথা বলতে গেলে একটা বই-ই তো তাহলে লিখতে হবে! যাই হোক,গতকাল ফোনে মায়ের সাথে আমার কথোপকথন দিয়েই শেষ করব লেখাটি।
“মাঃ বাবো( মা আমাকে বাবো বলেন) তোর কি চোখ উঠছে?
আমিঃ কই নাতো।তোমার হটাত এটা মনে হল কেন?
মাঃ মুই(আমি) আইজ স্বপ্নে দেখলাম, তুই চোখ দিয়ে তাকাইতে পারস না!তোর দুই চোখ লাল হইয়া গেছে! হারাদিন তোর মোবাইল বন্ধ আছিল ক্যান? অনেকবার ফোন করছি।
আমিঃ আচ্ছা মা,তুমি কি কোনদিনও আমাকে নিয়ে ভাল একটা স্বপ্ন দেখো না?তুমি রাতে ঘুমানো বাদ দিয়া দেও। খালি খারাপ স্বপ্ন, আর খারাপ স্বপ্ন! না, আমার কিছু হয় নাই। ভাল আছি।
মাঃ রাগ করিস না বাবো। তুই বাড়ি আবি কবে? আমাগো বড় রাওয়াডা(মোরগ কে বরিশালে রাওয়া বলে) জবই কইরা তোর জন্য ফ্রিজে রাখছি।
আমিঃ ওইটা রাখার কি দরকার। তোমরা খেয়ে ফেল।
মাঃ না। তুই দেশি রাওয়া খাইতে পছন্দ করস। রাইখ্যা দিছি।তুই আইলে হেরপর খামু!

আমি আল্লাহ্‌র কাছে কিছুই চাই না।শুধুমাত্র একটা জিনিস চাই। আমার মৃত্যুটা যেন আমার মায়ের পরে হয়। কেন জানেন? আমি যদি আমার মায়ের আগে পৃথিবী ছাড়ি, আমি জানি আমার মায়ের কি অবস্থা হবে। আমার মা এই কষ্ট সইতে পারবেন না... সত্যি, আমাকে ছাড়া আমার মা, এই গ্রহে বড়ই খারাপ থাকবেন.........

সর্বশেষ এডিট : ১১ ই ডিসেম্বর, ২০১৫ বিকাল ৩:০২
০টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

প্রজাতির শেষ জীবিত প্রাণ !

লিখেছেন অপু তানভীর, ১৩ ই মে, ২০২৪ সকাল ১০:৫১



বিবিসির একটা খবর চোখে এল সেদিন । উত্তরাঞ্চলীয় সাদা গন্ডার প্রজাতির শেষ পুরুষ গন্ডারটি মারা গেছে । তার নাম ছিল সুদান । মৃত্যুর সময় তার বয়স ৪৫। বিবিসির সংবাদটা... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাংলাদেশে সবচেয়ে ক্রিয়েটিভ এবং পরিমার্জিত কনটেন্ট ক্রিয়েটর মধ্যে সে একজন ।।

লিখেছেন সেলিনা জাহান প্রিয়া, ১৩ ই মে, ২০২৪ সকাল ১১:৩৯



আপনারা কতজন Umma Kulsum Popi চেনেন, আমি ঠিক জানি না। আমার পর্যবেক্ষণ মতে, বাংলাদেশে সবচেয়ে ক্রিয়েটিভ এবং পরিমার্জিত কনটেন্ট ক্রিয়েটরদের একজন হলেন উনি। যদি বলি দেশের সেরা পাঁচজন কনটেন্ট... ...বাকিটুকু পড়ুন

হাদিস অস্বীকার করে রাসূলের (সা.) আনুগত্য সম্ভব

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ১৩ ই মে, ২০২৪ দুপুর ২:৪৯



সূরাঃ ৪ নিসা, ৫৯ নং আয়াতের অনুবাদ-
৫৯। হে মুমিনগণ! যদি তোমরা আল্লাহ ও আখিরাতে বিশ্বাস কর তবে তোমরা আনুগত্য কর আল্লাহর, আর আনুগত্য কর রাসুলের, আর যারা তোমাদের... ...বাকিটুকু পড়ুন

=কবিতাগুলো যেনো এক একটি মধুমঞ্জুরী ফুল=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ১৩ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৪:২০



©কাজী ফাতেমা ছবি
মনের মাধুরী মিশিয়ে যে কবিতা লিখি
কবিতাগুলো যেনো আমার এক একটি মঞ্জুরী লতা ফুল,
মনের ডালে ডালে রঙবাহারী রূপ নিয়ে
ঝুলে থাকে কবিতা দিবানিশি
যে কবিতার সাথে নিত্য বাস,
তাদের আমি... ...বাকিটুকু পড়ুন

পোষ্ট যদি ক্রমাগতভাবে ০, কিংবা ২/১'টি মন্তব্য পেতে থাকে, বুঝবেন যে, সোনাগাজী সেমি-ব্যানে আছে!

লিখেছেন সোনাগাজী, ১৩ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৫:২৭



আপনার পোষ্ট যদি ক্রমাগতভাবে ০ কিংবা ১'টি মন্তব্য পেতে থাকে, তখন খোঁজ নিলে দেখবেন যে, সোনাগাজী সেমি-ব্যানে আছে!

কোন বিষয়ের উপর অনেক মানসম্পন্ন পোষ্ট লিখলেও সামুতে আপনি... ...বাকিটুকু পড়ুন

×