ভূমিকম্প কিংবা সুনামি হলে যেমন হঠাৎ করে সব ভেঙে-চুড়ে ধ্বংস হয়ে যায় তেমন এক ধ্বংসলীলা মানুষের মনোজগতেও হয়। যখন দিনের পর দিন লালন করা বিশ্বাস, মূল্যবোধ, ভালোলাগার বোধগুলো কোন এক শক্তিশালী ধাক্কায় এক নিমিষে টলে যায় তখন মনে হতে থাকে নিজের ভেতরে এতদিনের গড়ে ওঠা এক নগর যেন তার সব ইতিহাস নিয়ে তলিয়ে যাচ্ছে। নিজের ভেতরের সেই ধ্বংসস্তূপের মধ্যে নতুন নগর সভ্যতার সৃষ্টি খুব কম মানুষই করতে পেরেছে। বাকিরা দিশেহারা নাবিকের মত শুধুই একটুকরো জমিনের আশায় অপেক্ষায় করে গেছে। আমি কোন দলে পড়ব তা বলার সময় এখনো আসেনি। যদিও আমি দিশেহারা নাবিকের মতই খুঁজে চলছি কোন এক ইউটোপিয়ান সাম্রাজ্য। শেষ পর্যন্ত কি খুঁজে পাব আর কি পাবনা তা হয়তো সময়ই একদিন বলে দিবে।
একটি শিশু যখন এক অপার্থিব মায়ার জগত ছেড়ে যখন এমন এক জগতে এসে পড়ে যেখানে বেঁচে থাকার অর্থ মানেই এক নিষ্ঠুর প্রতিযোগিতায় অংশ নেওয়া তখন অনেক কিছুই মেনে নিতে কষ্ট হয়। ছোটকাল থেকেই সারভাইবের নামে তাকে শেখানো হয় সমাজের কিছু প্রচলিত নিয়ম কানুন। পূর্বপুরুষদের বিশ্বাসের কিছু বীজ তার উর্বর মস্তিষ্কে এমন ভাবে রোপণ করে দেওয়া হয় যেন ধীরে ধীরে তা এক বৃক্ষ হয়ে ওঠে। আমিও ব্যাতিক্রম কেউ ছিলাম না। আমি অনেক আদর যত্নেই বেড়ে উঠেছিলাম। তবে সেই ছোটকাল থেকেই আমার খুব অবাক হওয়ার স্বভাব ছিল। যেমন যে বয়সে রাস্তায় হাঁটতে গিয়েও ভয় পেতাম সে বয়সে যখন দেখতাম আমার বয়সি কেউ রাস্তা ঘাটে শ্রম দিচ্ছে, এমনকি ছোট একটা শরীর নিয়ে কি অবলীলায় রিক্সা চালিয়ে যাচ্ছে। এমন এক দৃশ্য দেখে একদিন খুব হিংসা হয়েছিল আমার। সেদিন মনে মনে প্রায় ঠিকই করে ফেলেছিলাম যে, যেভাবেই হোক একদিন আমাকে রিক্সাচালক হতে হবে! এমন অনেক কিছুই আমার হতে ইচ্ছা করত। আমার মনে হত আমার বয়সি সেসব শ্রমজীবী শিশুরা আমার চেয়ে অনেক স্বাধীন এবং আনন্দে জীবন যাপন করে। সবকিছু পেয়েও নিজেকে কেমন যেন বন্দি মনে হত। যদিও তারপর আরেকটু বড় হয়েই আমি অনেক কিছুই বুঝে ফেলেছিলাম।
একদিনের কথা খুব স্পষ্টভাবে মনে আছে। রেল স্টেশনে বসে আছি। সেখানে আমার বয়সী এক পরিচিত ছেলে ছিল। তার সাথে অনেক কিছু নিয়েই কথা হচ্ছিল। যেমন কমিক্সের কোন চরিত্র পছন্দ! কার শক্তি বেশী! টিপু সুলতান থেকে শুরু করে শচিনের ব্যাটিং কিছুই বাদ যাচ্ছিল না। হঠাৎ করে দেখলাম আমাদের বয়সেরই আরেক ছেলে মাথার উপর দুইটা ব্যাগ আর হাতে একটা বস্থা নিয়ে এক লোকের পিছে পিছে দৌড়াচ্ছে। আমি মুগ্ধ হয়ে সে ছেলের দিকে তাকিয়ে ছিলাম। এই লিকলিকে শরীরে এত শক্তি সে পেল কোথায়! তার জন্য আমার খুব মায়া হচ্ছিল। আমি আমার বন্ধুকে বললাম, ওদের অনেক কষ্ট। দেখ, আমরা কত আরামে আছি। অথচ ওরাও মানুষ, আমরাও মানুষ। কিন্তু আমরা যে বয়সে পড়ালেখা করছি, কমিক্স পড়ছি কিংবা শচিনের মত ক্রিকেটার হওয়ার স্বপ্ন দেখছি সেই একই বয়সে এই ছেলে কুলিগিরি করছে। কিন্তু কেন? বন্ধুকে বলতে সে খুব স্বাভাবিক ভাবে বলল এই ছেলেত কুলিই হবে। কারন সে পূর্ব জন্মে পাপ করেছিল। যারা অনেক পাপ করে তারা আবার পরের জন্মে গরিব হয়ে জন্ম গ্রহন করে। তাকে নাকি তার বাবা এসব কথা বলেছে। আমি বললাম তুমি হাস্যকর কথা বলছ। এমন কিছু হতেই পারেনা। সে বলল যেহেতু তার বাবা বলেছে তাই সেটাই ঠিক। ভাবলাম এই বিষয় নিয়ে আমার বাবার সাথেও কথা বলতে হবে। একদিন বাবাকে বললাম আচ্ছা কেউ কেউ এত গরিব হয় কেন যে তাদের বাচ্চাদের কাজ করে ক্ষেতে হয়। এসব কি পাপের ফল? নাকি অন্য কিছু। বাবা মুচকি হেসে বলেছিলেন এই বয়সেই এসব চিন্তা মাথায় ঢুকে গেছে! আরেকটু বড় হলে এসব প্রশ্নের জবাব নিজেই বুঝে যাবি! আমিও মনে মনে ভাবতাম আমাকে বড় হতে হবে। অদ্ভুত সব প্রশ্নের জবাব আমাকে খুঁজে বের করতেই হবে।
হঠাৎ করেই একদিন খুব পড়ার অভ্যাস হয়ে গেল। পাবলিক লাইব্রেরীতে ভর্তি হয়ে গেলাম। স্কুলে খুব ভালো ছাত্র ছিলাম। কিন্তু পড়ালেখায় ক্ষতি হতে পারে এই অজুহাতে কেউ আমাকে লাইব্রেরী যেতে নিরুৎসাহিত করেনি। বরং বাবা মায়ের উৎসাহে আমার আগ্রহ আরো বেড়ে যায়। একদিন সুকান্তের এক ছড়া পড়লাম। ছড়ার নাম পুরনো ধাঁধা।
বলতে পার বড়মানুষ মোটর কেন চড়বে?
গরীব কেন সেই মোটরের তলায় চাপা পড়বে?
বড়মানুষ ভোজের পাতে ফেলে লুচি-মিষ্টি,
গরীবরা পায় খোলামকুচি, একি অনাসৃষ্টি?
বলতে পার ধনীর বাড়ি তৈরি যারা করছে,
কুঁড়েঘরেই তারা কেন মাছির মতো মরছে? ধনীর মেয়ের দামী পুতুল হরেক রকম খেলনা,
গরীব মেয়ে পায় না আদর, সবার কাছে ফ্যালনা।
বলতে পার ধনীর মুখে যারা যোগায় খাদ্য,
ধনীর পায়ের তলায় তারা থাকতে কেন বাধ্য?
'হিং-টিং-ছট্' প্রশ্ন এসব, মাথার মধ্যে কামড়ায়,
বড়লোকের ঢাক তৈরি গরীব লোকের চামড়ায়।।
একদম আমার মাথার মধ্যে ঘুরপাক খাওয়া প্রশ্নগুলো নিয়ে কি অসাধারন এক ছড়া লিখে ফেলেছেন কবি সুকান্ত।
একদিন মাক্সিম গোর্কী নামক এক লেখকের আমার ছেলেবেলা নামক এক বই পড়া শুরু করলাম। যতই পড়তে থাকলাম ততই মুগ্ধ হচ্ছিলাম। মনে হচ্ছিল নতুন কোন এক রাজ্যে আমি ঢুকে পড়েছি। আমার অনেক প্রশ্নের উত্তর পেয়ে যাচ্ছিলাম। মনে হচ্ছিল সেই স্টেশনে দেখা কুলির শৈশব এই বইয়ের পরতে পরতে মূর্ত হয়ে উঠেছিল। বাবা বলল এত মনোযোগ দিয়ে কি পড়ছিস, দেখি! বইয়ের নাম দেখে বলল এইত খুঁজে পেয়েছিস! এখন দেখবি অল্প সময়েই অনেক বড় হয়ে যাবি! হাসি মুখেই সে কথাগুলো বলেছিল। কিন্তু আমি বুঝতে পারছিলাম আমি কৈশোরের ঘোর ভেঙে কঠিন বাস্তব এবং নিষ্ঠুর এক জগতের মুখোমুখি হচ্ছি। অনেক কিছু জানার এক অদম্য ইচ্ছা আমাকে আচ্ছন্ন করে ফেলছিল!
চলবে
সর্বশেষ এডিট : ১৩ ই নভেম্বর, ২০১৫ রাত ৯:১৩