ঈদে বাড়ি ফিরতে না ফিরেতই কাকু শোনালেন, তোমাকে নিয়ে আমাদের অনেক প্রত্যাশা। ভালো কিছু কর, তারাতারি কর। আমি কেবল শুনে যাই।
বিকেলে আরেক কাকা ডেকে নিয়ে গেলেন চাচী আমাকে দেখবে বলে। তাদের বিয়ের ১৪ বছর পর চাচীর সাথে প্রথম পরিচয় (তারা বছরে যে কোন একটা ঈদে বাড়ি আসেন। আমি বহুবছর কোন ঈদেই যাইনি)। কাকা বললেন, ও (চাচী) ফেসবুকে তোর সেমিনারের নিউজ পড়ছিল। আমি দেখে বললাম, তুমি কি চেন সে কে। চাচী না বললে, কাকা বলে, ও আমাদের ছেলে। বাড়ি আসার পর থেকেই চাচী বারবার কাকাকে বলছে সেই ছেলেকে দেখবে।
ঈদ শেষ। পর দিন সকালে চুপি চুপি বের হলাম ঢাকায় আসব বলে। চাচাতো ভাইরা সব খাসি জবাই করে গোল হয়ে বসে আছে। তাদের সামনে ধরা দেব না বলে আমি দ্রুত পায়ে হাঁটি। এক ভাতিজা চিল্লান দেয় মেহেদী কাকা চলে যাচ্ছে। চাচী দৗড়ে এসে রাস্তার মাঝখানে জড়িয়ে ধরেন। চাচীকে না দেখে কোথায় চলে যাচ্ছ বাবা (দেশে ফেরার পর তার সাথে প্রথম দেখা)। কতোবছর পর তরে দেখছি বলতো বলে কেঁদে ফেলেন তিনি। আমি তাকে জড়িয়ে ধরে চাচী, চাচী বলি। টেনে বাড়িতে নিয়ে আসেন, একটা চেয়ারে বসান। ভাবীরা ঘিরে ধরে। একজন চিল্লায়, মানুষ এতো সীমার হয় কি করে। কি করে হয়, হে। সামনে দিয়ে চলে যাচ্ছ, একটু না বলে। বড় হলে বুঝি ছেলেরা এমনই হয়। হে,,, আমি হাসি। ভাবিদের অনেকেই আমার মতো অতিথি। বছরে একবার কি দুইবার শ্বশুর বাড়িতে আসেন বেড়াতে।
এবার আমি উঠি। চাচার বাড়ি থেকে নিজের বাড়ি আর ফিরে যাইনা। ঢাকার পথ ধরি। আসতে আসতে আম্মার মুখটা মনে পড়ে। আমার বোকা মা। ঈদের দিন সন্ধ্যায় বিদ্যুৎ চলে গেলে তিনি একটা হাত পাখা নিয়ে আসেন আমার সামনে। আমি ধমকাই এইটুকু গরমে আমার কিছু হয় না। আপনার রুমে যান। তিনি বাতাস করতে করতে আলাপ জমানোর চেষ্টা করেন। অমুকের ছেলে বিয়ে করেছে, তমুকের মেয়ের ঘরে আর একটা বাচ্চা হয়েছে। আমি শুধু শুনি।
কথায় কথায় জানতে চান, একটা সরকারী চাকরি কি পাওয়া যায় না! আমি আবারও হাসি। আম্মা কি বুঝতে পারে আমার হাসির অর্থ? মনে হয় না। তবে আমি ঠিকই বুঝি, বাতাস করার ছলে তিনি ছেলের সাথে আরও কিছুক্ষণ গল্প করতে চান। আরও কিছু কথা হয়তো বলতে চান। বুড়া মায়ের দু:খ দুর্দশরা কথা, সুখের কথা। তার অন্য ছেলেমেয়েদের কথা। অসুস্থ আব্বা কিছু বলেন না আজকাল, আগেও খুব একটা বলতেন না। আব্বারটা-আম্মারটা, দুটাই আম্মা বলেন।
আমি যতবার গ্রামে ফিরি ততবারই নষ্টালজিয়া পেয়ে বসে, ভাবি যদি থেকে যেতে পারতাম চির জীবনের জন্য! আবার ঠিকই সব কিছুকে পেছনে ফেলে ফিরে আসি মিথ্যে কথার জঞ্জালে ভরা ঢাকা শহরে। যে শহর সকাল-সন্ধ্যা খাটুনির বিনিময়ে আমাকে দু’বেলা খেতে দেয়। কাজে এক আনা ছোট ভুল হলে ১৬ আনা বড় বড় কথা শোনায়। তবু আমি এই শহরের ছুটে আসি। কেউ কি কোনদিন জানবে, হৃদয়টা রেখে আসি কুমিল্লার আড়ালিয়া নামক গ্রামটাতে। মায়ের আঁচলে, চাচীর আদরে আর ভাবিদের খুঁনসুটিতে ভরা প্যান্ডোরার বাক্সে। বিধি তুমি কি বলতে পার, আর কোনদিন, কোনভাবে কি ফেরা হবে সেই গ্রামে? যেখানে আমার জন্মের খবর শুনে দৌড়ে গিয়ে আজান দিয়েছিল জেঠা। হবে কি ফেরা? সেই মানুষদের কাছে, যারা রিকশায় চড়লে ভাড়া নিতে চায় না, হেসে বলে বছরে দুয়েকটা মাত্র দিন পাই তোমারে। কিসের ভাড়া, যাও যাও। যে গ্রামে এমন সব মানুষ থাকে যারা আমার অসুস্থতার খবর শুনলে রোজা রাখে। আমি কি আর কোনদিন তাদেরই একজন হয়ে ফিরতে পারব? শুধু একটা দিনের জন্য তাদের কাছে ছোট্টবেলাকার তাদের সেই ছোট্ট ছেলেটি হয়ে! সেই ছেলেটি, যেই ছেলেটিকে তারা শিক্ষা নামক অসভ্যতার মেলায় হারিয়ে ফেলেছিল যুগেরও বেশি সময় আগে। যেই ছেলেটি বাজারি মানুষ হওয়ার প্রতিযোগিতায় জিতবে বলে মনুষত্ব্য বিকিয়ে দিয়েছে পানির দরে।
মাত্র একটা দিনের জন্য হবে কি আর ফেরা তার? মাত্র একটা দিন!
সবাইকে ঈদের শুভেচ্ছা। জগতের সকল প্রাণীর মঙ্গল হোক।
সর্বশেষ এডিট : ২৫ শে আগস্ট, ২০১৮ রাত ৯:৩৯