কান্দারগাঁও গ্রামের মেঠোপথের দুই ধারে লাউয়ের মাচা দেখে চোখ জুড়িয়ে যাবে। আর মাঠভর্তি হলুদ রঙা সরিষাগাছের দোলা দেখলে যে কারও মন দুলে উঠবে। এত সব সুন্দরের মধ্য দিয়ে কিছু দূর এগোতেই অসুন্দরের প্রতাপ চোখে পড়ল। বিকট ভট ভট শব্দে ২৪টি ড্রেজারের মাধ্যমে মেঘনা থেকে বালু তোলা হচ্ছে। ফেলা হচ্ছে ফসলের মাঠে। হলুদ সরিষার জমি হয়ে উঠছে ধূসর। এ সবই হচ্ছে সোনারগাঁয়ে অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তোলার নামে।
সোনারগাঁ উপজেলার পিরোজপুর ইউনিয়নের ১০ গ্রামের প্রায় ১২ হাজার মানুষ তিন বছর ধরে চোখে রীতিমতো সর্ষের ফুল দেখছে। তাদের ৭০০ একর ফসলি জমি বালু দিয়ে ভরাট করে ফেলছে ইউনিক প্রোপার্টি ডেভেলপমেন্ট লিমিটেড নামের একটি কোম্পানি। মেঘনা নদীতীরের আরও কয়েক শ একর ফসলি জমি ভরাটের প্রক্রিয়া চালাচ্ছে তারা।
বাংলাদেশ পরিবেশ আইন অনুযায়ী, যেকোনো আবাসন বা বড় উন্নয়ন প্রকল্পের জন্য পরিবেশগত প্রভাব সমীক্ষা (ইআইএ) করে এর অনুমোদন নিতে হয়। প্রয়োজন হয় অবস্থানগত ছাড়পত্রের। এসবের পর পরিবেশ ছাড়পত্রের জন্য আবেদন করতে হয়। এসব ছাড়পত্র পেলে তবেই মাটি ভরাটসহ অন্যান্য উন্নয়নমূলক কাজ করতে হয়।
পরিবেশ অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, ২০১১ সালে ইউনিক গ্রুপ ওই জমিতে সোনারগাঁ রিসোর্ট সিটি নামে একটি আবাসন প্রকল্প নির্মাণ শুরু করেছিল। স্থানীয় ব্যক্তিদের আপত্তি আমলে নিয়ে পরিবেশ অধিদপ্তর থেকে ওই প্রকল্পে অভিযান চালানো হয়। তখন ৫০ লাখ টাকা জরিমানা ও বালু অপসারণ করে স্থানীয় মানুষের কাছে জমি ফিরিয়ে দিতে বলা হয়। জরিমানা পরিশোধ করলেও জমি ফিরিয়ে দেয়নি ওই কোম্পানি।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে সোনারগাঁ ইকোনমিক জোন ও ইউনিক প্রোপার্টি ডেভেলপমেন্ট লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. নূর আলী প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষের (বেজা) কাছ থেকে অনুমোদন নিয়েই কাজ শুরু করেছি। তারা অনুমোদন দিলে পরিবেশ ছাড়পত্রের দরকার হয় না। পরিবেশ ছাড়পত্র লাগে শিল্পকারখানা স্থাপনের জন্য।’
তবে বেজার চেয়ারম্যান পবন চৌধুরীর সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘ইউনিক গ্রুপের নিজস্ব জমিতে সোনারগাঁ ইকোনমিক জোন করার প্রাক্-যোগ্যতাপত্র দেওয়া হয়েছে। পরিবেশের সব আইন মেনেই তাদের তা করতে বলা হয়েছে। পরিবেশের সমীক্ষা ও ছাড়পত্র ছাড়া তা করতে বলা হয়নি। কিন্তু এখন আমরা শুনতে পাচ্ছি, তারা অন্যের জমিতে এসব করছে।’
পিরোজপুর ইউনিয়নে গেলে সেখানকার কৃষকেরা প্রায় মিছিলের মতো করে এই প্রতিবেদকের কাছে আসেন। তাঁরা জানান, মাঠ থেকে ফসল তোলার জন্য তাঁরা যখন অপেক্ষা করছেন, ঠিক তখনই রাতের আঁধারে তাঁদের ফসলসহ মাঠ বালু দিয়ে ভরাট করে ফেলা হচ্ছে। মাটি ভরাটের ঠিকাদারির সঙ্গে স্থানীয় আওয়ামী লীগের বেশ কয়েকজন প্রভাবশালী নেতা জড়িত থাকায় তাঁরা এর বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে কিছু বলতে পারছেন না।
জমির মালিকেরা উপজেলা ও জেলা পরিষদের কাছে বারবার চিঠি দিয়ে প্রতিকার চেয়েছেন। পরিবেশ অধিদপ্তরের কাছে অভিযোগ করেছেন। বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতি (বেলা) থেকে অন্যের কৃষিজমি দখল ও ভরাটের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে মামলাও করা হয়েছে।
কান্দারগাঁও গ্রামের কৃষক এনায়েত উল্লাহ মোল্লা প্রথম আলোকে বলেন, ‘মাঠ থেকে সরিষা তোলার বদলে আমরা এখন চোখে সর্ষের ফুল দেখছি। আমাদের জমি ভরাট করে ফেলা হচ্ছে, আবার প্রতিবাদ করলে হত্যার হুমকি দেওয়া হচ্ছে। জমি তো গেছেই, বাড়িতেও থাকতে পারছি না।’
এ ব্যাপারে পরিবেশ অধিদপ্তরের ঢাকা বিভাগের পরিচালক মো. আলমগীর প্রথম আলোকে বলেন, ‘সোনারগাঁ অর্থনৈতিক অঞ্চলের কোনো অনুমোদন আমরা দিইনি। পরিবেশগত প্রভাব সমীক্ষা পর্যন্ত তারা করেনি। অন্যের জমি বালু দিয়ে ভরাট করায় এদের আমরা জরিমানা করেছিলাম। এখন আমাদের কাছে অভিযোগ এসেছে, তারা আবারও জমি ভরাট করছে। আমরা শিগগিরই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সহায়তায় অভিযানে যাব।’
দেশের বিদ্যমান আইন ভঙ্গ করে এবং অন্যের জমি জোর করে ভরাট করায় ২০১৪ সালে ইউনিক প্রোপার্টি ডেভেলপমেন্টের তৎপরতার বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে মামলা করে বেলা। সোনারগাঁ উপজেলার পিরোজপুর ইউনিয়নের পিরোজপুর, জৈনপুর, ছয় হিস্যা, চর ভবনাথপুর, ভাটিবন্ধ ও রতনপুর মৌজার বিস্তীর্ণ কৃষিজমি, জলাভূমি ও নিচু জমিতে অবৈধভাবে বালু উত্তোলন করে ভরাটের ব্যাপারে উচ্চ আদালতের কাছে নিষেধাজ্ঞা চেয়ে একটি রিট মামলা করা হয়।
উচ্চ আদালত ওই মামলার পরিপ্রেক্ষিতে ইউনিক প্রোপার্টিকে মাটি ভরাট বন্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে নারায়ণগঞ্জ জেলা প্রশাসন, সোনারগাঁ উপজেলা প্রশাসনসহ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দেন। জেলা ও উপজেলা প্রশাসন থেকে ইউনিক প্রোপার্টিকে একাধিকবার বালু উত্তোলন ও জমি ভরাট বন্ধের নির্দেশ দেওয়া হয়। প্রতিষ্ঠানটি তা না শোনায় আদালত অবমাননার অভিযোগ আনে বেলা।
এ ব্যাপারে বেলার প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান প্রথম আলোকে বলেন, ‘ইউনিক প্রোপার্টি ডেভেলপমেন্ট লিমিটেড রাষ্ট্রের সব নিয়ম ভঙ্গ করে এবং সরকারের নির্দেশনা অমান্য করে এখনো মাটি ভরাট চালিয়ে যাচ্ছে। আমরা আশা করি, সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগগুলো আইন অমান্যের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবে।’ [img|http://s3.amazonaws.com/somewherein/pictures/sarowar1983/sarowar1983-1486007171-5a8b692_xlarge.jpg
সুত্র: প্রথম আলো
সর্বশেষ এডিট : ০২ রা ফেব্রুয়ারি, ২০১৭ সকাল ৯:৫৯