অনার করলে অনার পাবি,
ফাউল করলে ফাউল;
রুটি খাইলে আটা কিনবি,
ভাত খাইলে চাউল।
ছড়াটুকু দেখেই মনে হয় বুঝতে পারছেন ছড়াটা কার? জ্বি বাংলাদেশের বিখ্যাত ছড়াকার, জগলুল হায়দার ভাইয়ের এই বিখ্যাত ছড়াটা আমি প্রথম শুনি যেদিন তার সাথে আমার তৃতীয় সাক্ষাত হয়। প্রথম সাক্ষাত হয় আল নাহিয়ান ভাইয়ের সৌজন্যে তাঁর প্রথম বই সাইলেন্ট কল এবং আমার প্রথম বই রঞ্জিত জননী মোড়ক উন্মোচনের দিন, ৯ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৩ বইমেলায়। সেদিন তেমন কথাবার্তা না হলেও ফেসবুকে রিকুয়েস্ট পাঠিয়ে দেই সেদিনই। এরপর থেকে ফেসবুকে নিয়মিত কথাবার্তায় বুঝতে পারলাম মানুষটার মাঝে খ্যাতি থাকলেও কোন অহঙ্কার নেই। নিরেট সাধারণ মানুষদের মতোই। আজকালকার সময়ে লেখকদের ক্ষেত্রে কেউ দুই একটা বই লিখলে বা প্রকাশকদের মধ্যে দুই একটা বই প্রকাশ করলে কিংবা নতুন গায়ক দুই একটা অ্যালবাম বের করলে, অভিনেতা দুই একটা সিনেমা করলে, ডিরেক্টর অথব প্রডিউসার দুই একটা সিনেমা ডিরেকশন বা ইনভেস্ট করলেই তাদের মাঝে আকাশচুম্বী অনর্থক অহমিকা বোধ কাজ করে। অনেকটা সদ্য জাতে ওঠা রাস্তার কুকুরের নিয়মতি খাবার হাড় ছেড়ে চর্বি খোজার ব্যাপারের মতো। তার মাঝে এই ভাবটি নেই।
এরপর মাঝে একবার আহসান হাবীব স্যারের অফিসে তারই বন্ধু রতন ভাইয়ের সৌজন্যে আবার দেখা হয়। সেদিন কথায় কথায় আমরা জানতে পারি আঞ্চলিক দিক দিয়ে আমরা দুইজনই একই জায়গার। জামালপুরের। এরপর থেকে তার স্নেহের ভাগটা মনে হয় একটু বেড়েই যায়। (জুনিয়র সবার প্রতিই তার অসম্ভব স্নেহ কাজ করে। আমাকে বিশেষ ভাবার কোন কারণ নেই।) এরপর তৃতীয় সাক্ষাত হয় তার মতিঝিলের অফিসে। বড়ভাই হিসেবে আমাকে অনেক পরামর্শই দিলেন, লেখালেখি, বর্তমান সময়কার সাহিত্য, অতীতের সাহিত্য নিয়ে অনেক কথাবার্তাই হলো। কথায় কথায় এক পর্যায়ে তিনি আমাকে একটি ধাঁধা ধরলেন। পাইলটের বয়স বের করার ধাঁধা। বোকার মতো আমি সে ধাঁধার উত্তর দিতে পারিনি। ধাঁধার প্রতি আমার দুর্বলতা ছোটবেলা থেকেই। বাবা রোজ অফিস থেকে আসার পর এক একটা ধাঁধা ধরতেন, একটারও উত্তর দিতে পারতাম না। মনে মনে রাগও হতো, আবার না পাওয়ার অপমানে জেদও চাপতো কেন পারবো না! ছোটবেলায় একাধারে অনেকগুলো ধাঁধা না পারায় এক সময় ধাঁধার প্রতি আগ্রহ কমেই গিয়েছিল। এরপর হঠাৎ করেই জগলুল ভাই আমার ধাঁধা সমাধানে স্বত্তাকে জাগিয়ে তুললেন। ধাঁধা নিয়ে রীতিমত উঠে পড়ে লাগলাম। ধাঁধা সম্পর্কিত বেশ কয়েকটি বই সংগ্রহ করলাম। কিছু পারি। বেশিরভাগই পারি না। ধাঁধার উত্তরগুলো জানার পর বেশ মজা লাগতো। নিজেকে যেন নতুন করে আবিষ্কার করতে পারছিলাম। ধাঁধার নেশা এতটাই বেড়ে গেল যে, যেখানেই যাই, যাকেই দেখি, তাকেই ধাঁধা জিজ্ঞেস করি, ধাঁধা ধরতে বলি। কেউ কেউ পারেন, বেশির ভাগই পারেন না। যে কয়জনকে ধাঁধা জিজ্ঞেস করি, এদের মাঝে কেবল তিনজন মানুষ বেশিরভাগ ধাঁধার উত্তরই বের করে ফেলতে পারে। আমি আশাহত হই। মানুষের অপারগতা দেখলে মনের মধ্যে এক ধরণের বড় বড় ভাব জেগে ওঠে। নিজেকে ক্ষমতাবান মনে হয়। ক্ষমতাবানের কখনো হারতে চান না। তবে প্রিয় মানুষদের কাছে হারার মাঝেও এক ধরণের তৃপ্তি আছে। আমার চোখে দেখা এই তিনজন বুদ্ধিমান মানুষেরা হল আমার মেজো দুলাভাই এনামুল হক, আমার ফুফাতো ভাই ইমরুল কায়েস খান এবং বান্ধবী শায়লা আহমেদ রিয়া। আমি এদের প্রতি এতটাই মুগ্ধ যে বেশ কয়েকবার ভেবেছিও যে সামনের কোন একটা বই এদের উৎসর্গ করে এদের মুগ্ধ করার প্রতি সম্মান জানিয়ে।
সে যাই হোক। ধাঁধার নেশা বেশ প্রবল ভাবেই জেগে উঠেছে। ধাঁধার বই পড়ি, ধাঁধা বিষয়ক বিভিন্ন তথ্য নেটে সার্চ করি, মাঝে মাঝে নিজেই ধাঁধা বানাই। মাঝে মাঝে ক্লাস টাইমে গ্যাপ থাকলে বসে বসে ধাঁধা বানাই। ক্লাসে অফটাইম থাকলে মাঝে মাঝে আঁকিবুঁকি, মাথায় ঘুরপাক খাওয়া উপন্যাসের জন্য কিছু কথা টুকে রাখি, কিংবা ছড়া কিংবা কবিতা লিখি। ইদানিং ধাঁধাও লিখি। এসব লেখার সময় ক্লাসে আমাকে ঘিরে সবাই গোল হয়ে দাঁড়ায়। কেউ কেউ লেখার মাঝখানেই বলে এরপর কি, থেমে আছো কেন, তাড়াতাড়ি লিখ। তাদের আগ্রহে বিরক্ত হই। কিছু বলি না। ইদানিং ওদের বিরক্ত করার জন্য শোধ তোলার সিস্টেম বের করেছি। ধাঁধা বানানো হলে ওদেরকে সমাধান করতে কেউই পারে না। মানুষকে প্যাচের মধ্যে পড়তে দেখে আনন্দ পাই। উত্তর বলার পর একেকজন রীতিমত অবাক হয়ে যায়। পুরো ক্লাসে হাসির রোল পড়ে যায়। কয়দিন আগেও যারা আমাকে গুরু-গম্ভীর, অহঙ্কারী, আঁতেল মনে করতো, তারাও আস্তে আস্তে আমার প্রতি আগ্রহ বোধ করছে। আসলে কয়েকজন বাদে সবাইকেই আমি নিজের ভাই-বোনের মতো দেখি।
আমার এই রমরমা অবস্থা বেশিদিন টিকলো না। এ মাসের ২৯ তারিখ থেকেই পরীক্ষা শুরু হওয়ায়, টিচারেরা সিলেবাস শেষ করার আগেই ক্লাস টেস্ট, কুইজ টেস্ট নেওয়া শুরু করে দিয়েছে। ক্লাসের সবাই টিচারদের প্রতি বিরক্ত। অথচ টিচারেরা এ বিষয়ে যেন বেশ আনন্দিত। তারাও ক্ষমতাবান। আমাদের অসহায়ত্ব দেখে তারাও পুলকিত বোধ করেন। নিয়তিকে মেনে নিয়ে আমরা আমাদের জ্ঞানের বিরুদ্ধে পরীক্ষা দেই। কখনো ভালো করি, বেশিরভাগ সময়ই খারাপ করি। টিচারেরা পড়া বোঝানো বাদ দিয়ে চিরায়ত টিচারসুলভ বাণী দিয়ে ক্লাস ছাড়েন। আমরা যে যে যার যার মতো পড়া বুঝে নেই।
গতকাল ফার্স্ট আওয়ারে আমাদের ক্লাস ছিল না। আমি আগে ভাগেই এসে ধাঁধা বানাতে শুরু করে দিয়েছি। ক্লাসের সহপাঠীরা আস্তে আস্তে একজন দুইজন করে ক্লাসে আসতে শুরু করেছে। একজন একজন করে আসে, একজন একজন করে ধাঁধার সমাধান করতে চেষ্টা করে। ধাঁধা সমাধান করতে করতে স্যার ক্লাসে চলে আসে। স্যার আসার আগেই আমি সবাইক উত্তর বলে দেই। বরাবরের মতো তারা অবাক হয়ে যায়। আমার ভালো লাগে।
গতকাল ডিজিটাল ইলেক্ট্রনিক্স-২ ক্লাসে একটা কুইজ টেস্ট ছিল। স্যার এসে আমাদের হাতে অ্যান্সার শিট আর কুইশ্চেন পেপার দিয়ে আমাদের উপর নজরদারী করছেন। প্রশ্নগুলো সহজ ছিল। মোট ১৫টা প্রশ্ন। সময় ১৫ মিনিট। প্রতি প্রশ্নের জন্য এক মিনিট হলেও একেকটি প্রশ্নের উত্তর দিতে কম করে হলেও ৩ মিনিট করে লাগবে। আমার মাথায় কি জন্য কে জানে একটা বুদ্ধি চলে এল। ক্লাসে দাঁড়িয়ে স্যারকে বললাম,
-স্যার একটা কথা বলতে পারি?
-বলো।
-স্যার কয়েকটা ধাঁধার উত্তর পত্রিকার জন্য পাঠাতে চাচ্ছিলাম। পাঠালে প্রতিটা সঠিক উত্তরের জন্য একশো করে টাকা পাওয়া যাবে।
-হুমম, পাঠিও।
-কিন্তু স্যার, উত্তরগুলো যে খুব কঠিন, আপনি কি একটু হেল্প করবেন?
-আচ্ছা ক্লাস শেষে করে দিবো।
-স্যার এই ক্লাসের পর আর ক্লাস নেই। ক্লাস শেষেই সরাসরি প্রত্রিকা অফিসে গিয়ে উত্তর জমা দিব। আজকে দুপুর ১২টার পরই লাস্ট ডেট। আপনি যদি এখন ক্লাসের ফাঁকে একটু করে দিতেন।
স্যার বেশ হাসিমুখে আগ্রহ সহকারে আমাকে ডাকতে ডাকতে বললেন,
-আচ্ছা দাও দাও। আমার আইকিউ বেশ ভালোই।
আমি খাতায় লেখা প্রায় ৪-৫টা ধাঁধা নিয়ে গেলাম। স্যার আমার ধাঁধার উত্তর সমাধান করছেন। মাঝে মাঝে বেশ চিন্তিত ভঙ্গিতে ধাঁধার সমাধা করছেন বোঝা যাচ্ছিল। মাঝে মাঝে মাথা চুলকান, পকেট থেকে মোবাইল বের করে হয়তো বা ক্যালকুলেটর দিয়ে অঙ্ক কষছিলেন। এভাবে স্যার ধাঁধা নিয়ে প্রায় আধা ঘন্টার মতো মাথা ঘামালেন। ধাঁধাগুলোর মাঝে এরকম কিছু ধাঁধা ছিল,
“একজন লোকের দুইজন স্ত্রী। প্রথম স্ত্রীর তিনজন স্বামী আছে। সেই তিন স্বামীর মাঝে তৃতীয় জনের আবার চারজন স্ত্রী আছে। সেই চারজন স্ত্রীর মাঝে চতুর্থ জনের দুইজন মেয়ে আছে। সেই দুইজন মেয়ের মাঝে প্রথম জন হল সেই লোকের দ্বিতীয় স্ত্রী, যার দুইজন স্ত্রী আছে। প্রথম লোকটির প্রথম স্ত্রীর সাথে তার তৃতীয় স্বামীর দ্বিতীয় মেয়ের সম্পর্ক কি?”
আমরা যে এদিকে একজন একজনের কাছে জিজ্ঞাসা করে টিম ওয়ার্ক করে মিউচুয়াল আণ্ডারস্ট্যান্ডিং করে কুইজ টেস্ট দিচ্ছি স্যারের সেদিক খেয়াল নেই। কয়েকজন তো সরাসরি বই বের করেও কুইজ টেস্ট দিচ্ছে। স্যারের সেদিকেও ভ্রুক্ষেপ নেই। প্রায় আধা ঘন্টার মতো সময় নিয়ে আমরা সবগুলো প্রশ্নের উত্তর বের করে ফিসফিস করে আড্ডা দিচ্ছি। স্যারের হুশ ফিরলে তিনি বেশ বিরক্ত মুখে চিৎকার করে বললেন, “স্টপ রাইটিং। এত সময় নিলে কেন, এটা কি কুইজের রুলসের মধ্যে পড়ে? জলদি খাতা জমা দাও।” আমরা সবাই খাতা জমা দিলাম।
খাতা জমা দেওয়া শেষে স্যার আমাকে তার কাছে ডাকলেন। আমি কাছে যেতেই তিনি বেশ কড়া গলায় বললেন,
ধাঁধা বাদ দিয়ে পরীক্ষার পড়াশোনা কর। ওটাই কাজে লাগবে। ইডিয়ট!
স্যার চলে গেলেন। ক্লাসের মাঝে আমি হিরো হয়ে গেলাম। সবাই বেশ ধন্যবাদ টন্যবাদ দিয়ে যে যে যার যার মতো চলে গেল। আমি ক্লাসে বসে রইলাম। স্যারের দেওয়া কুইজের যেসব উত্তর দিতে পারিনি, সেসব সল্ভ করার আগ পর্যন্ত উঠলাম না। না পারা প্রশ্নগুলো সল্ভ করে মনে মনে ভাবলাম, আসলেই আমার এখন পরীক্ষার পড়ায় মন দেওয়া উচিৎ। নিজেকে নিয়ে ধাঁধা তো অনেক হল।
বিশেষ দ্রষ্টব্যঃ আমার আইকিউ লেভেল অতি নগণ্য। না পাওয়া জিনিসের প্রতি মানুষের আগ্রহ কাজ করে। ধাঁধার প্রতি আগ্রহ প্রবল হওয়ার কারণও সেটিই।
সর্বশেষ এডিট : ১৫ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৩ বিকাল ৩:৫১