পৌষের কোনো এক বৃষ্টিভেজা মধ্যরাতে এদেশের এক প্রত্যন্ত গ্রামে জন্ম হয়েছিলো আমার, মায়ের কাছে শুনেছি। হঠাৎ বৃষ্টির সেই শীতের রাতে আঁতুর ঘরে মার পাশে দাইমা নামক আমার অ-দেখা এক মহিলা ছাড়া আর কেউ ছিলো না। উঠোনে রেখে দেয়া প্রয়োজনীয় সাংসারিক অনুষঙ্গ বৃষ্টির হাত থেকে বাঁচাতে দাইমা বাইরে গেলে প্রায়ান্ধকার ঘরে জন্ম হয়েছিলো আমার। জন্মেই দেখেছিলাম, আমার চারপাশে কেউ নেই- মা ছাড়া।
আজ, এই এতদিন পর- আমার চারপাশে সহস্র মানুষের ভিড়- তবু মার কাছে ফিরতেই ভালো লাগে আমার।
এভাবেই নিজের জন্মের গল্পটি শুরু করেছিলেন তিনি। মা’র সাথে প্রতিটি শিশুর একটি আত্মিক সম্পর্ক থাকে। দশমাস দশদিন যিনি একটি মানব শিশুকে গর্ভে ধারন করেছেন সেই শিশুটির সঙ্গে জন্মের পূর্বে থেকেই গড়ে ওঠে মায়ের সাথে সম্পর্ক। মায়ের কোলের যে পরম মমতা এবং সে মমতায় যে নির্মল শান্তি তা কোথাও পাবার নয়। প্রতিটি মানুষ নিঃসঙ্গ। কিন্তু গর্ভে ধারন করা থেকে শুরু করে ভূমিষ্ট হওয়া পর্যন্ত প্রতিটি মানুষের আপন এবং কাছের মানুষ একমাত্র মা। মা এমন একটি শব্দ যা সম্পর্কেরও প্রকাশ করে। মা উচ্চারিত হওয়ার পর সেই শব্দটির কোনো শেষ নেই। সম্পর্ক এখানেই। মর্মটা এখানেই। যার মমতার কোনো শেষ নেই সেই তো মা। অনন্ত মমতা। যেখানে লুকিয়ে থাকে প্রচন্ড আবেগ ও ভালোবাসা।
তেমনই এক মায়ের কোল জুড়ে ১৯৬৯ সালের ১৪ই ডিসেম্বর পৃথিবীতে এসেছেন কথাসাহিত্যিক আহমাদ মোস্তফা কামাল।
শীতের কাঁপানো রাতে হঠাৎ বৃষ্টি; কিছুক্ষণ পর থেমে যাওয়া, দাই মার দৌড়ে বাইরে চলে যাওয়া; নিঃসঙ্গ শিশুটিকে মা’র কাছে রেখে যাওয়া। প্রকৃতি এমন ঘটনা কারও সাথে ঘটায় না।
পৃথিবীতে আগমনের সময় কিছু কিছু মানুষকে প্রকৃতি বিশেষভাবে স্বাগতম জানায়। প্রকৃতির এসব আয়োজন ছিল তাঁকে স্বাগতম জানানোর জন্যই। প্রকৃতি বলেছে, তুমি বৃষ্টির মতো ধুয়ে দেবে এ পৃথিবীকে, এ সমাজকে; তোমাকে নিঃসঙ্গ করে দিলাম এই জন্য যে, জন্ম নিয়েই যাতে বুঝতে পারো সেই নিঃসঙ্গ মানুষগুলোর নিঃসঙ্গতা এবং তাদের কষ্ট; আর তুমি জোসনার আলোর মতো মায়ময় আলো দিয়ে সেই নিঃসঙ্গ মানুষগুলোকে তোমার মায়ায় আবদ্ধ করে রাখবে।
এ সবই হয়তো ছিল প্রকৃতির বার্তা। হয়তো..
শৈশব পেরিয়ে সেই শিশুটি ধীরে ধীরে হয়ে উঠেছে একাধারে একজন শক্তিধর লেখক, শিক্ষক। প্রতিটি পর্যায়ে তাঁর সফলতার ছাপ। একসময় জনপ্রিয় আবৃত্তিকারও ছিলেন। তবে এখন ছেড়ে দিয়েছেন সেচ্ছায়। তার কারণ তিনি বলেন,
একসময় আবৃত্তি করতে করতে আমি অনুভব করলাম আবৃত্তির চেয়ে আমার কাছে বড় হয়ে উঠলো দর্শকের হাততালি। আবৃত্তি করার সময় যতটানা আবৃত্তিতে মগ্ন থাকতাম তার চেয়েও বেশী আমার মাথায় থাকতো আমাকে ভালো আবৃত্তি পাঠ করতে হবে কারণ আমাকে হাততালি পেতে হবে। ওয়ান্স মোর ওয়ান্স মোর শুনতে হবে। সেই সময় আমি অনুভব করলাম হাততালির বিষয়টাই আমার কাছে মূখ্য হয়ে উঠলো। আমার কাছে মনে হতে শুরু করলো আমি হাত-তালি পাওয়ার জন্য আবৃত্তি করি। কিন্তু হাত-তালির বিষয়টা হচ্ছে এরকম, অর্থাৎ তাৎক্ষণিক যে প্রাপ্তিটা তা একসময় হারিয়ে যায়। যত তাড়াতাড়ি সাফল্য আসে, তত তাড়াতাড়ি সে অর্জনটা হারিয়ে যায়। ঠিক তখনই আমি শক্ত সিদ্ধান্তটি নিলাম, যে আমি লিখব নাকি আবৃত্তি করবো। এবং তখন আমি নিজেকে বোঝালাম আমি কোন তাৎক্ষণিক সাফল্য চাই না। আমি লিখে যেতে চাই এবং আমি জানি লেখার যে পথ সেটা অনেক দীর্ঘ। কিছু পেতে অর্থাৎ লেখক হিসেবে নিজেকে দাঁড় করাতে হলে দীর্ঘদিন অপেক্ষা করতে হয়। হয়তো বা জীবনকালে অনেকে কিছু পানও না। এবং আমি সেভাবেই নিজেকে তৈরী করলাম এবং লেখা শুরু করলাম।
এই অসাধারণ অবৃত্তিকার ধীরে ধীরে নিজেকে গড়ে তুললেন একজন লেখক হিসেবে। প্রথম উপন্যাস আগুন্তুক প্রকাশিত হয়েছে ২০০২ সালে। বেশকয়েকটি ছোট গল্পগ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। তার মধ্যে ঘরভরতি মানুষ অথবা নৈঃশব্দ পেয়েছে বাংলা ১৪১৩ সানের সৃজনশীল শাখায় প্রথম আলোর বর্ষসেরা বইয়ের পুরষ্কার। এবং যে দীর্ঘ পথ তিনি অতিক্রমের কথা বলেছেন সেই দীর্ঘ পথের সময় হচ্ছে ১৮ বছর।
এমনই এক অসাধারণ লেখক একজন অসাধারণ শিক্ষক। শিক্ষকতা করছেন ইন্ডিপেন্ডেন্ট ইউনিভার্সিটি, বাংলাদেশে।
একজন শিক্ষক হিসেবে তিনি যতটানা গম্ভীর ঠিক ততটা হাস্যজ্জল মানুষ একজন লেখক হিসেবে।
তাঁর শিক্ষক পরিচিতি এবং সাহিত্যপরিচিতি। এ দুটি জগতের সাথে পরিচয় হয়েছে তাঁর শিক্ষার্থীদের। আর তাই তাঁর একজন ছাত্র হিসেবে আমি সব-সময় বলি, সদ্য কৈশর পেরিয়ে যখন আমরা অপরিচিত এক বাস্তবতার সামনে দাড়িয়ে তখন সেই বাস্তবতার মোকাবেলা করার সাহস জুগিয়েছেন যেই মানুষটি সেই মানুষটির নাম, আহমাদ মোস্তফা কামাল। শুধু শিক্ষাদানই নন তিনি আমাদের নিয়ে গেছেন এক সপ্নের জগতে এবং সাথে সাথে সেই সপ্নের যৌক্তিকতাও তুলে ধরেছেন। আর তাই ধীরে ধীরে তিনি যেন হয়ে উঠেছেন আমাদেরই একজন।
হঠাৎ আমরা তাকে আবিস্কার করলাম নতুন এক রুপে। বাংলাদেশের এক নতুন যুগের সাহিত্যিক। বিষয় বা উপকরনের নির্দিষ্ট গন্ডিতে যিনি নিজেকে আবদ্ধ করে রাখেননি। তিনি তার ছাত্র ও পাঠক সকলের জন্য তৈরী করতে পেরেছেন বহুমাত্রিক এক জগত।
এই বহুমাত্রিক জগতের স্রষ্টা আহমাদ মোস্তফা কামালের আজ শুভ জন্মদিন। তাঁর প্রতি রইলো জন্মদিনের শুভেচ্ছা। তাঁকে শুভেচ্ছা জানিয়ে একরামুল হক শামীম ভাই গতকাল একটি পোষ্ট দিয়েছেন। সেই পোষ্টে মন্তব্য দিতে গিয়ে তিনি বললেন,
এই দিনটি ঘটা করে পালন করা হয়ওনা কখনো। শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবসের শোক আর কালিমা মাখা এই দিনে কি জন্মদিনের উৎসব হয়? তবু, কাছের মানুষ ও বন্ধুরা এইসব যুক্তিবুদ্ধির চেয়েও ভালোবাসার আবেগে নিজেদের মতো করে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানায়।
এই দিনটি কলঙ্কিত হবে তা প্রকৃতি জানতো আর তাই দুবছর আগে এমন এক শিশুকে পৃথিবীর বুকে স্বাগতম জানিয়েছে যে শিশুটি হয়তো সেই কলঙ্গ, জাতির সেই মেধাশূণ্যতা বৃষ্টির মতো ধুয়ে মুছে নিয়ে যাবে। কয়েকটি তাজা প্রাণ পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছে আর আপনাকে দিয়ে গেছে সেই প্রাণশক্তি। যে শক্তি আপনি কলমে ধারণ করে চলেছেন।
আজ শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস। সালাম জানাই সে সকল বুদ্ধিজীবীদের যাদের কলমকে ভয় পেয়ে একদল দালালচক্র তাদের নির্মমভাবে হত্যা করেছে। শ্রদ্ধা জানাই সে মাদের যারা বাংলার এই মহান সন্তানদের গর্ভে ধারন করেছেন। যুগ যুগ ধরে মহামানবদের আমরা স্বরণ করে চলি কিন্তু সেই রত্ন গর্ভা মাদেরও স্বরণ আমরা করি না। রত্নগর্ভা মাদের কথা পৃথিবীর ইতিহাসে থেকে যায় অজানা। ইতিহাসে অজানা সেই মাদের আমি শ্রদ্ধা জানাই। স্যালুট জানাই।
সর্বশেষ এডিট : ১৪ ই ডিসেম্বর, ২০০৮ রাত ১০:১৯

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




