- দোস্ত, দেখছিস জম্পেশ জিনিস। মামা একবার পাইলে জীবনটা ধন্য হইয়া যাইত
- হুম, তয় লগেরটা আরো সুন্দর। মামা কোন এলাকায় থাকে রে?
- আমি কেমনে কমু? আমি কি অগো কিছু লাগি নাকি?
- না, তয় এক রাইতের লাইগা পাইলে উমম
- বাম পাশেরটা আমার আর ডান পাশেরটা তোর।
- চুপ বেটা বাম পাশেরটা তোর ভাবি লাগে।
- কি? এতোদিন তো কস নাই।
- কমু কেমতে। দেখলামই তো আইজকা।
- চুপ, তুই তো আমাগো হরি কাকার মতো। বিয়া করনের মুরোদ নাই। হা হা
- দিস, তোর বউরে। বুঝাইয়া দিমু নে।
- চুপ কর বেটা হরিকাকা। মুরোদ নাই আবার বড় বড় কথা।
- তুই হরিকাকা। এতোদিনেও তো একটা জুটাইতে পারলি না।
- তুই মনে হয় খুব জুটাইছস। তুই নিজে হরিকাকা, হরিকাকা, হরিকাকা
হরিকাকা আমাদের এলাকার একজন লোকের নাম। মানুষ হিসাবে উনি ভালো কিন্তু লোকের মুখে শোনা যায় উনার আসলে বিয়ে করার মুরোদ নাই তাই উনি এখনও বিয়ে করেন নাই। তাই এই বাচ্চা পোলাপানগুলাও উনারে নিয়া মজা নেয়। উনি হয়ত সময়মতো বিয়ে করলে এদের মত উনার ছেলে থাকত।
আগে একটা সময় আমিও মজা নিতাম। একদিন দোকানে বসে এরকম ধরনের ফাজলামো করছি। অইসময় রক্ত গরম। নতুন নতুন বই হাতে নেয়া শিখেছি। বলে দিতে হবে না কিসের বই। সারাক্ষন বন্ধুবান্ধব মিলে রসের আলাপ আর রাস্তায় মেয়ে দেখলেই বিভিন্ন কথার ঝড় বইয়ে দিতাম।
একদিন বিকালে দুই বন্ধুর মধ্যে কথা হচ্ছিলো। সেই রসের আলাপ আর তখন পর্যন্ত না পাওয়া মেয়ে মানুষের সঙ্গ নিয়ে আলাপ। এর মধ্যেই হরিকাকা প্রসঙ্গ চলে আসে। হটাৎ খেয়াল করলাম কে যেনো ডাকছে। মানে আমরা যেই দোকানে বসে আছি সেই দোকানের সামনে দিয়ে একজন লোক যাচ্ছিলো। যেতে যেতে হটাৎ থমকে দাড়িয়ে আমাদের ডাকছে। হরিকাকাই দাড়িয়ে ছিলেন।
বললেন, চল নদীর পাড়ে যাই। আমরা তো ভয়ে আছি। যাকে নিয়ে মজা করছিলাম সেই আমাদের ডাকছে। কি না কি বলে আল্লাহই জানেন। ভাবতে ভাবতে নদীর পাড়ে চলে এলাম। হরি কাকাই কথা বলা শুরু করলেন। এতোক্ষন আমাদের কথাও জমাট বেঁধে ছিলো!
- তোমরা এবার কোন ইয়ারে?
- জ্বী, ফার্স্ট ইয়ারে।
- হুম, তোমাদের সাথে আসলে কখনো কথা হয় নি। আসলে এতো আত্মভোলা মানুষ আমি। তোমাদের আজকে কিছু কথা বলার জন্যে ডেকেছি। সময় আছে?
- জ্বী , আছে বলুন।
- দেখো, কিভাবে নিবে জানি না, তবে কথাগুলো বলা না খুব দরকার। লোকে আমায় ভুল বোঝে, আমার আড়ালে আমিটাকে কেউ না খোজে না। অনেকটা পার্সোনাল কথা, তবে যদি তোমাদের উপকার হয়। আর জনে জনে যেয়ে বলা সম্ভব না, তোমাদের দেখে বলতে মন চাইলো। বিরক্ত হচ্ছ নাফিস? শফি?
- না, কাকা। বলেন। আমাদের আজকে তেমন কোন কাজ নেই।
- তাহলে শুনো।আমি এখনও অবিবাহিত জানো তো?
- হুম(ঠোট টিপে হেসে)।
- কিন্তু এর কারণটা কি কেউ বলেছে?
- না। এর পিছনে আর কি কারণ থাকতে পারে?
- কারনটাই তো অনেক বড় নাফিস। তোমাদের আমার জীবনের গল্পটা বলি তাহলেই বুঝবে।
কাকা এই বলে বলতে শুরু করলেন-
আমার তখন তোমাদের মত বয়স, ওই সময় তো বুঝতেই পারো, তোমাদের মত এতো মেয়ে আমরা রাস্তায় দেখতাম না। প্রেম হত খুব কম আর সবই লুকিয়ে। একদিন সাইকেল চালিয়ে বাড়ি ফিরছি। আমরা যেখানে থাকতাম তার থেকে কিছু দূর এসে সাইকেল গেলো নষ্ট হয়ে। ঠেলে ঠেলে নিয়ে বাড়ি ফিরছি। এমন সময় যে বাড়ির সামনে দিয়ে পার হচ্ছি , সেই বাড়ি থেকে একটা মেয়ে, কিশোরী, এক দৌড়ে রাস্তায় এসে আবার ভিতরে চলে গেলো। মনে হল একটা পরী আমাকে দেখা দিয়ে আবার হারিয়ে গিয়েছে।
আমি কিছুক্ষন আনমনে রাস্তায় চলতে চলতে বাড়ি আসলাম। আবার স্বপ্নে সেই মেয়েটা হানা দিলো। চিন্তা করলাম পরের দিনই যেতে হবে ওখানে। আবার সেই একই সময়ে গিয়ে দাড়িয়ে রইলাম। এবারো একই ঘটনা ঘটত, যদি না মেয়েটির বান্ধবী তাকে এতো অল্প সময় দিতো ভিতরে যাওয়ার। এবার একটু দৃষ্টি বিনিময় হলো। আমি সত্যি বলতে চোখ ফিরিয়ে নিতে পারছিলাম না।
এরপর সেই বাড়ির সামনে আনাগোনা বারতেই থাকলো। কখন দেখা হয়, কখন হয় না। কেটে যায় বেশ কিছুদিন। এবার চিন্তা করতে থাকি আচ্ছা মেয়েটি যদি অন্য কারো হয়ে যায় আমি বাচবো কিভাবে? ওকে তো জানানো দরকার আমি ওকে চাই, কতোটা মনে প্রানে চাই। এটুকু বলে রাখি অইসময় পর্যন্ত আমি মেয়েটির নাম জানি না। একদিন সাহস করে ডেকে বললাম, এই মেয়ে তোমার নাম কি? মেয়েটি বলল, জোহরা। আমি কন্ঠটা শুনে আরেকবার বিমোহিত হয়ে গিয়ে থেমে গেলাম। এই মেয়ে তো মুসলিম। আমি এখন কি করবো? ওদিক থেকে প্রশ্ন ভেসে আসে, আপনার? আমি উত্তর দিলাম। এভাবে এক কথা দু কথায় ঘনিস্টতা বাড়তে লাগলো।
ওই সময়ের মুসলিম ফ্যামিলি কি পরিমানে রেস্ট্রিক্ট বুঝতেই পারো। তবে এই বিকাল দিকে ওদের বাড়িতে তেমন কেউ থাকতো না। তাই কেউ সন্দেহ করে নি। আরো কিছুদিন যাওয়ার পর আমি তখনও নিজের মধ্যে দ্বন্দে পরে আছি, সেইসময় মেয়েটি বলল তার বিয়ে, আগামী মাসে। আমি আর কিছু চিন্তা না করে ওর হাত খানি ধরে বললাম,
- না করলে হয় না এই বিয়েটা? চল না পালিয়ে যাই কোথাও?
মেয়েটা অবাক চোখে আমার দিকে তাকিয়ে রইল কিছুক্ষন। তারপর এক দৌড়ে ঘরের ভিতরে। আমি হাবার মত দাড়িয়ে থেকে চলে আসলাম একটু পরে।
আমার বাড়িতে আমি একটু একলা জায়গায় থাকি। কথোপকথনের সময় সেই কথাটা জোহরাকে বলেছিলাম। আমি এপাশ ওপাশ করছি, এমন সময় কে যেনো মৃদু আলো নিয়ে বাইরে দাড়িয়ে মনে হল। উঠে গেলাম। দেখি জোহরা দাড়িয়ে।আমার চোখে বিস্ময় আর ওর চোখে চিক চিক জল।
- তুমি এতো রাতে?
- আপনি কি বলে এলেন?! এরপর থেকে আপনার মুখটাই শুধু ভাসছে।
- দেখো, অইসময় কি বলেছি ভুলে যাও। আবেগের বসে বলে ফেলেছি। আর এটা কখনই সম্ভব না। আমার পরিবার পরিজন, তোমার পরিবার পরিজন আছে। একটা গ্যাঞ্জাম লাগবে
- আমি এতো কিছু বুঝি না। আপনি যেটা বলেছেন সেটা কি করতে পারবেন?
- না, এটা সম্ভব না।
- তাহলে বললেন কেনো?
- মনে হয়েছিলো তাই।
- যা মন চাইবে তাই বলে দেবেন আপনি? আর তাতে অন্যজন যে পুড়ে খাক হয়ে যাচ্ছে তারবেলায়?
- দেখো জোহরা, আমি তো বলেছি সেটা আবেগের বশে ছিলো। কিন্তু এখন আবেগ নিয়ে থাকলে তো হবে না! তোমার আর আমার বাইরে আমাদেরটাও ভাবতে হবে।
- সেই জন্যেই বলছি চলুন পালিয়ে যাই।
- কি?
- হুম, এটাই সঠিক পথ। এই ছাড়া অন্য কোন পথ খোলা নেই।
- আমি পারবো না।
- তবে আপনার স্ত্রী হিসাবে আমাকে নিন। সত্যি বলছি আপনি ছাড়া আর কাউকে স্বামীত্বে বরণ করতে পারবো না।
- না , তোমার মাথার ঠিক নেই। তুমি পাগল হয়ে গেছো জোহরা। বাড়ি যাও।
- আপনি গ্রহন না করলে আমি বাড়ি যাবো না।
- না, জোহরা বোঝার চেষ্টা কর।
- আমি কিছু বুঝবো না, আমি শুধু জানি আপনি আমায় স্ত্রীর মর্যাদাটুকু দেবেন।
আমি নিরুপায় হয়ে ভাবছি কি করা যায়। জোহরাকে অনেক কষ্টে বোঝালাম। তবে সে বলে গেলো প্রতিরাতেই সে এখানে আসবে। আমার যেহেতু কিছু করার নেই সেহেতু সেই আসবে, তার বিয়ের আগ পর্যন্ত।
বিয়ের দুইদিন আগে এসে বলল,
- আপনি তো কিছু করতে পারলেন না। আজকে অন্তত আমার কথাটা রাখবেন বলুন।
- শুনি আগে।
- না , আপনাকে রাখতেই হবে ওসব শুনি টুনি বললে শুনবো না।
- বল
- আপনি আপনাকে আমার মধ্যে ধারন করবেন?
আমি কোন উত্তর খুঁজে পাই না। হা হয়ে ওর মুখে দিকে চেয়ে আছি। কিঞ্চিৎ আলোতে ওর অবয়বটা বলে দিচ্ছে ও আসলেই আমাকে চাইছিলো। কিঙ্ককর্তব্যবিমূড় হয়ে আছি।
জোহরার সেই ডাকটা উপেক্ষা করতে পারিনি। এরপরের দিন শুনলাম পাশের বাড়িতে একজন আত্মহত্যা করেছে। বুঝতে বাকী রইলো না জোহরা নিজের ইচ্ছাটুকু পূরন করে নিয়ে পাড়ি জমিয়েছে ওপারে। আমাকে স্বামী পদটাতে রেখে দিয়েছে আজীবন।
আমি কয়েকদিনপর বাড়ি থেকে শহরে চলে আসি। কারণ ওখানে থাকা আমার পক্ষে থাকা সম্ভব হয় নি। জোহরার স্মৃতি সেইসময় থেকে এখনো আমাকে তাড়িয়ে বেড়ায়। আর কারো দিকে চোখ তুলে তাকানোর সাহসও হয় নি। আর কখনো বাড়িও যাওয়া হয় নি। ওখানে জোহরা বড় শান্তিতে ঘমাচ্ছে আর এটা আমার সহ্য হবে না।
হরিকাকা এটুকু বলে তার চোখের ধারাটুকু ছেড়ে দেয়। আমরা তাকে সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করি। কিন্তু যার মনে এতো দুঃখ তাকে কি মিথ্যে সান্ত্বনায় ভোলানো যায়।
এবার উঠে তিনজন হাটা দেই বাড়ির দিকে। কাকাকে বলি, কাকা ক্ষমা করবেন, আপনাকে নিয়ে না জেনে অনেক উপহাস করেছি। আপনার প্রেমকে আসলে কেউ বুঝবে না। তবে আপনার এই প্রেমের প্রতি শ্রদ্ধা রইলো।
এখন বড় হয়েছি। হরিকাকা আগের মতো চলতে পারেন না। তবে মাঝে মাঝে যাই উনার সাথে দেখা করতে।
ছেলে দুটোকে এই গল্পটাই শুনালাম। তারা নিজেদের চোখের জল ধরে রাখতে পারলো না। আমিও।
আসলে এই কর্পোরেট ভালোবাসার যুগে এই মানুষগুলার ঘটনাই প্রেমে ভাসতে সাহায্য করে। মনের মনিকোঠায় যে প্রেম রয় তার খোজে কি নাবিক প্রেম কভু বের হয়???