somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

অনার কিলিংঃ নারীর উপর বর্বরতা

১৩ ই আগস্ট, ২০১৬ রাত ১১:২১
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :




প্রায় পাঁচটি বছর কেটে গেছে ১৭ বছরের তরুণী দোয়া খলিলের মৃত্যুর। বাড়ী ছিলো ইরাকী কুর্দিস্তানে। পারিবারিক মর্যাদা রক্ষার জন্য তার আত্মীয়-স্বজনেরা তাকে পাথর নিঃক্ষেপ করে হত্যা করে। মোবাইলে ধারণকৃত এই ভয়ংকর ঘটনার দৃশ্য ইন্টারনেটে যারা দেখেছেন, তারা মাত্রই আতংকিত হয়েছেন। আর সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশে ঘটা হেনার মৃত্যু। হেনা ১৪ বছরের একটি কিশোরী। নিতান্ত দরিদ্র পরিবারের সন্তান। একবেলা খায়, তো অন্য বেলায় উপোস। কখনও হয়তো বা দু’বেলাই উপোস। জীবন কী বুঝে ওঠার বয়সও তার হয়ে ওঠে নি। তবু কী ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতা নিয়ে তাকে এ পৃথিবী ছাড়তে হলো! শরীয়তপুরের নাড়িয়া উপজেলার চামটা গ্রামের দরিদ্র কৃষক দরবেশ খাঁর মেয়ে হেনাকে ধর্ষণ করেছে তারই চাচাত ভাই। মাহবুব নামের এক পশু! আরও কিছু পশুর দল বিচারের নামে ফতোয়া দিয়ে দোররার আঘাতে আঘাতে তাকে হত্যা করে, নির্ধারিত একশ দোররার প্রয়োজন হয় নি। সত্তর দোররায় মেয়েটি লুটিয়ে পড়লো এবং যা হওয়ার তাই হলো…।

ঘটনাগুলো একটি পিতৃতান্ত্রিক বিশ্বে নারীর উপর প্রতিনিয়ত ঘটে চলা নির্যাতনকে নাটকীয়ভাবে প্রমাণ করে। বহুদিন থেকে বিশ্বের বিপুলসংখ্যক নারী “অনার কিলিং”-এর শিকার হয়েছে, যাদের অধিকাংশই কিশোরী।
যাদের হত্যাকাণ্ডের ঘটনা আন্তর্জাতিক মহলের নজর কেড়েছিলো করেছিলো, তাদের একটি তালিকা দেখায় যে, নারীদের বিরুদ্ধে এই কার্যকলাপ বিশ্বের অনেক জায়গায় চালু রয়েছে, বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্যে (এর মধ্যে রয়েছে তুরস্ক) এবং দক্ষিণ এশিয়ায়।
জাতিসংঘের জনসংখ্যা তহবিল (population fund) এর হিসেবমতে সারা বিশ্বে প্রতি বছর “অনার কিলিং”-এর শিকার হন সর্বমোট ৫০০০-এরও বেশী নারী। তবে সঠিক সংখ্যা আরও বেশী হতে পারে, যদি “মর্যাদা সংক্রান্ত অন্যান্য অপরাধসমূহ গণনায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়।”
“পুলিশ চিফদের মতে, প্রতি বছর বৃটেনে ১৭ হাজারের মতো নারী হত্যাকাণ্ডসহ মর্যাদা সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন হিংস্রতার শিকার হয়। কর্তৃপক্ষ আরও জানান, এটি বিশাল একটি বিষয়ের সামান্য একটি ইঙ্গিত মাত্র।” (ডেইলি ইন্ডিপেন্ডেন্ট, ১০ ফেব্রুয়ারি, ২০০৮)

এগুলো শুধুমাত্র যুক্তরাজ্যের হিসেব, এখানে মধ্যপ্রাচ্য কিংবা দক্ষিণ এশিয়ার তালিকা নেই, যেখানে পরিসংখ্যান আরও ভয়াবহ।
দোয়াকে পাথর নিঃক্ষেপের ঘটনা যে স্থানে ঘটে, সেই ইরাকী কুর্দিস্তানে ১৯৯১ (১৯৯১ সালে যুক্তরাষ্ট্র ও অন্যান্য সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলো ইরাকে প্রথমবারের মতো আক্রমণ করে) এবং ২০০৭ এর মধ্যবর্তী সময়কালে ১২ হাজারের অধিক নারী অনার কিলিংসের শিকার হয়। (দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস, ২০ নভেম্বর ২০১০)
“অনার কিলিং”-এর অনেকগুলো ঘটনা সংঘটিত হয় এমন আরেকটি স্থান হলো— পাকিস্তান। সেখানে একে বলা হয় “কারো-কারি”। যদি সরকারী হিসেবের ওপর আস্থা রাখা হয়, তবে “গত ৬ বছরে পাকিস্তানের ৪ হাজারের বেশী নারী এই ধরনের হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন।” (বিবিসি, ২ মার্চ, ২০০৫)
“অনার কিলিং”-এর ওপর উইকিপিডিয়ার দেওয়া তথ্যমতে, নানান দেশেই ‘অনার কিলিং’ ঘটেছে, যার মধ্যে রয়েছে— আলবেনিয়া, বাংলাদেশ, ব্রাজিল, কানাডা, ডেনমার্ক, ইকুয়েডর, মিশর, জার্মানি, ভারত, ইরান, ইরাক, ইসরায়েল, ইতালি, জর্ডান, মরক্কো, পাকিস্তান, ফিলিস্তিন এলাকা, সুইডেন, তুরস্ক, উগান্ডা, যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্র।

একজন মহিলার অনার কিলিং এর শিকার হওয়ার পিছনে নানা কারণ থাকতে পারে; যদি তিনি কাউকে ভালোবাসেন অথবা তার প্রেমিক থাকে। এছাড়া কিছু বিষয় রয়েছে যেমন— মহিলাটি যদি তার উপর চাপিয়ে দেওয়া কোনো বিয়েতে অস্বীকৃতি জানান; হতে পারে তিনি ধর্ষণের শিকার, কিংবা অত্যাচারী স্বামী থেকে তালাক চাইছেন। ব্যভিচার— আরেকটি কারণ। অনেক ক্ষেত্রে কেবলমাত্র সন্দেহের ওপর নির্ভর করেই হত্যাকাণ্ডে সম্মতি প্রদান করা হয়। উদাহরণ হিসেবে ২০০৭ সালে জর্ডানে সংঘটিত একটি হত্যাকাণ্ডের ঘটনা উল্লেখ করা যেতে পারে, যেখানে ১৭ বছর বয়সী কন্যাকে তার পিতা[!] গুলি করে হত্যা করে। তার ‘সন্দেহ’ ছিলো যে, মেয়েটি যৌন সম্পর্কে জড়িত। যদিও মেডিকেলের পরীক্ষায় মেয়েটির কুমারিত্ব প্রমাণিত হয়েছিলো।


স্বেচ্ছাকৃত অকার্যকর আইন - - -

“অনার কিলিং”-এর বিপক্ষে সারা বিশ্বের মানুষের মাঝে প্রতিক্রিয়ার মুখে কিছু রাষ্ট্র এর অনুশীলনকে আইন-বহির্ভূত বলে ঘোষণা করেছে, যার মধ্যে রয়েছে— যুক্তরাষ্ট্র, ইরাকের কুর্দিশ স্বায়ত্বশাসিত সরকার এবং পাকিস্তান। তবে নানা কারণে এসব দেশের সরকার এখনও এই আইন ভঙ্গকারীদের প্রতি বেশ সদয়। উদাহরণস্বরূপ, আন্তর্জাতিক চাপের মুখে কুর্দিশ স্বায়ত্তশাসিত সরকার ‘অনার কিলিং’কে বেআইনী ঘোষণা করে আইনটি সংশোধন করেছে। কিন্তু পরিবর্তিত আইনটি কেবলমাত্র কাগজপত্রেই রয়ে গেছে; এর প্রয়োগের ন্যূনতম আগ্রহ কর্তৃপক্ষ প্রদর্শন করছে না। অনেকক্ষেত্রে এই সমস্ত হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় তারা অন্ধের ভূমিকা পালন করে। স্থানীয় নিরাপত্তা কর্মীরা নিশ্চিত করেছে— দোয়াকে পাথর নিঃক্ষেপের সময় কেউ কোনোপ্রকার বাধা দেবার চেষ্টাও করে নি।
কোনো কোনো ক্ষেত্রে পরিবারের সর্বকনিষ্ঠ পুরুষ সদস্যরা সর্বনিম্ন শাস্তি পাওয়ার জন্য হত্যাকাণ্ড সম্পাদন করে থাকে। অন্যান্য ক্ষেত্রে “অপমানিত” মহিলাটিকে জোরপূর্বক নিজের প্রাণ দিতে বাধ্য করা একটি সাধারণ ঘটনায় পরিণত হয়েছে।

তুরস্কের দক্ষিণ আনাতোলিয়ার চারপাশের শহরগুলোতে এবং বাটমান-এ বহুসংখ্যক অনার কিলিং ঘটে যেগুলো ঘটেছে পাথর নিঃক্ষেপ, শ্বাসরোধ, গুলি করে অথবা জ্যান্ত কবর দিয়ে। ইদানীং প্রায়ই তরুণীরা আত্মহত্যা করেছে বলে খবর পাওয়া যায়।
তুরস্কে পুলিশ একটি ১৬ বছর বয়সী মেয়ের লাশ উদ্ধার করে। মেয়েটির অপরাধ ছিলো— ছেলেদের সাথে কথা বলা, সেজন্য তাকে জ্যান্ত কবর দিয়ে দেয় তার আত্মীয়রা। লাশটির দুই হাত বাধা ছিলো। ময়নাতদন্তে মেয়েটির শরীরের ভেতর প্রচুর পরিমাণ মাটি পাওয়া গেছে, যা থেকে বোঝা যায় তাকে জ্যান্ত কবরই দেওয়া হয়েছিলো। (৪ ফেব্রুয়ারী, ২০১০; গার্ডিয়ান ডট কো ডট ইউকে)
Birzeit University’র প্রফেসর শরীফ খান্নার মতে, আরব সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ‘অনার-কিলিং’ লুকিয়ে আছে, আরব সমাজে মেয়েদের শুধুই সন্তানোৎপাদনের যন্ত্র মনে করা হয়। শুধু শিক্ষার অভাব এর জন্য দায়ী বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন না, তুরস্কে এক রিসার্চে দেখা গেছে, ৬০ ভাগ হত্যাকারীই গ্র্যাজুয়েট বা হাই-স্কুল পাশ।

“গত ৬ বছরে বাটমান শহরে ১৬৫টি আত্মহত্যা ও আত্মহত্যার চেষ্টার ঘটনা ঘটে, যার ১০২টিই ঘটে নারীদের দ্বারা। জাতিসংঘের মতে, এ বছরের শুরু থেকে ৩৬ জন নারী আত্মহত্যা করেছেন।” (দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস, ১৬ জুলাই, ২০০৬) এসকল সন্দেহজনক ঘটনা তদন্ত করতে জাতিসংঘ তুরস্কে দ্রুত বিশেষ দূত ইয়াকিন আর্তার্ক (Yakin Erturk)-কে পাঠায়। দূত উপসংহারে উল্লেখ করেন যে, কিছু ঘটনা ছিলো প্রকৃতপক্ষে আত্মহত্যা, অন্যগুলো আত্মহত্যা কিংবা দুর্ঘটনার ছদ্মবেশে ‘অনার কিলিং’।
পাকিস্তানে ‘অনার কিলিং’ হত্যা হিসেবে বিবেচিত হওয়ার কথা থাকলেও কার্যত পুলিশ এমনকি আদালতও তা উপেক্ষা করে থাকে। হত্যাকারী যদি দাবী করে যে, তার সম্মান রক্ষার জন্য সে হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে, তাহলে সে বেকসুর ছাড়া পেয়ে যায়। আন্তর্জাতিক ও জাতীয় চাপের মুখে ইরাকী কুর্দিস্তানের মতো পাকিস্তানে ‘অনার কিলিং’-এর সাথে জড়িত অপরাধীদের শাস্তি প্রদানের লক্ষ্যে একটি বিল উত্থাপন করা হয়, যেখানে ৭ বছর কারাদণ্ড থেকে মৃত্যুদণ্ড পর্যন্ত শাস্তি প্রদানের উল্লেখ করা হয়। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের মদদপুষ্ট জিয়া-উল-হক এর শাসনামলে আইনের কিছু ধারা তৈরী করা হয়, যার মাধ্যমে আক্রান্তের আত্মীয়স্বজনকে ক্ষতিপূরণ প্রদানের বিনিময়ে খুনীরা খালাস পাওয়ার সুযোগ পায়। পাকিস্তানে ‘কারো-কারি’ বৃদ্ধি পাওয়ার পেছনে এই আইনটির সরাসরি ভূমিকা রয়েছে এবং এ আইনটি বর্তমানে বলবৎ আছে।
তবে, অধিকাংশ ক্ষেত্রে হত্যাকারীরা শিকারীর ঘনিষ্ট আত্মীয় হয়। এর ফলে ক্ষমা ভিক্ষার জন্য ক্ষতিপূরণের কোনো প্রয়োজন হয় না এবং হত্যাকারী বেকসুর ছাড়া পেয়ে যায়।
২০০৫ সালের মার্চ মাসে পাকিস্তান পার্লামেন্টের একজন মহিলা সদস্য একটি বিল উত্থাপন করেন যেখানে “অনার কিলিং”কে আইনবহির্ভূত করার ক্ষেত্রে আরো শক্তিশালী ভূমিকা গ্রহণের ব্যাপারে উল্লেখ করা হয়। পাকিস্তান সরকার ইসলামপন্থীদের সাথে ঐক্যমত হয়ে এ বিলটি প্রত্যাখান করে। পার্লামেন্ট ইসলাম বিরোধী ঘোষণা করে সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটের মাধ্যমে বিলটি প্রত্যাখান করে। (বিবিসি, ২ মার্চ ২০০৫) শেষ পর্যন্ত এক বছর পর বিলটি গৃহীত হয়। তথাপি এহেন কর্মকাণ্ডের চর্চা এখনও বিস্তর এবং এর শিকার হচ্ছে বিপুল সংখ্যক মানুষ।


সরকারের ভূমিকা - - -

পাকিস্তান, কুর্দিস্তান, তুরস্ক এবং অন্যান্য দক্ষিণ এশীয় ও মধ্য প্রাচ্যের দেশসমূহে নারীদের বিরুদ্ধে এধরনের ঘটনাগুলোর পেছনের কারণ কী হতে পারে— সে বিষয়ে বিতর্ক আছে। কেউ সংস্কৃতিকে এর প্রধান কারণ বলে মনে করেন, আবার কেউ কেউ প্রভাববিস্তারকারী ‘ধর্ম’কেই এর কারণ বলে মনে করে থাকেন।
এ দু’টি ব্যাখ্যাতেই সত্যতা থাকতে পারে, তবে এর কোনোটি সম্পূর্ণ সত্য নয়। একই সাথে দুটো ব্যাখ্যাকে গ্রহণ করলেও সেটি পুরোপুরি সত্যতা লাভ করবে না, যদি এর সাথে নারীর ওপর অত্যাচার, পিতৃতন্ত্র এবং ঐসব সামাজিক সম্পর্কের সাথে সংশ্লিষ্ট উৎপাদনের (অর্থনৈতিক) সম্পর্কসমূহকে যুক্ত করা না হয়। নারীর ওপর অত্যাচারের এই রূপগুলো উৎপাদনের পশ্চাৎপদ সামন্তীয় এবং আধা-সামন্তীয় সম্পর্কের কার্যকারিতা রক্ষা ও নিশ্চিত করার জন্য জরুরী, যা অন্যদিকে, বর্তমান বিশ্বে সাম্রাজ্যবাদী কর্তৃত্বের সাথে যুক্ত।
সংস্কৃতির অংশ হিসেবে যা বিবেচনা করা হয়, তা মূলতঃ শাসক শ্রেণীর স্বার্থকেই পোষণ করে। এরূপ উৎপাদন সম্পর্কের বিরাজমান প্রভাবের কারণে এধরনের একটি সংস্কৃতি ও নৈতিকতা গড়ে তোলা হয়েছে এবং শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে যা মানুষের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে। এটা বিশ্বাস করা ভুল হবে না যে, এই নীতিগুলো আইন এবং প্রভাবশালী ধর্মগুলোর ব্যাখ্যার ভেতরে প্রবেশ করেছে।
পিতৃতান্ত্রিক “মর্যাদা” রক্ষার অর্থ মূলতঃ একটি বিশেষ উৎপাদনের সম্পর্ককে রক্ষা করা এবং সর্বশেষ বিশ্লেষণে এটি রক্ষা করছে শাসক শ্রেণীর স্বার্থকেই। শুধু তাই নয়, এটি পুরুষের কর্তৃত্বকেও রক্ষা করছে, যার অস্তিত্ব আজ বিশ্বের প্রতিটি দেশেই বিদ্যমান রয়েছে নানা রূপে উৎপাদনের সম্পর্ক অনুযায়ী।
এটি বিস্ময়কর নয় যে, কুর্দিশ শাসকগণ, যারা আধা-সামন্তীয় এবং গোষ্ঠী সম্পর্কের প্রতিনিধি এবং ইরাকে যুক্তরাষ্ট্রের কর্তৃত্বের অন্যতম একটি স্তম্ভ স্থাপন করেছে তারা “অনার কিলিং”-এর বিরুদ্ধে গুরুত্বের সাথে লড়াই করতে অনিচ্ছুক এবং যারা এ ঘটনার সাথে জড়িত তাদের প্রতি সদয়।
অবাক হবার কিছু নেই যে, পাকিস্তান সরকার এবং পার্লামেন্ট পশ্চাদপদ অর্থনৈতিক এবং সামাজিক সম্পর্কের প্রতিনিধিত্ব করে এবং একই সাথে সাম্রাজ্যবাদীদের সেবায় নিয়োজিত। এ ধরনের রীতিকে খর্ব করতে পারে এমন যেকোনো আইনেরই প্রতি তারা ব্যাপক প্রতিরোধ গড়ে তুলছে। চাপের মুখে আইনগুলো গৃহীত হয়, তখনও অপরাধীদের জন্য জায়গা ছেড়ে দেওয়া, যার ফলে তারা এইসব অপরাধ ঘটিয়ে যেতে পারে।
দ্রুত নজর দেওয়া যাক কিছু স্থানে, যেখানে যারা অপরাধের শিকার হন, তারা নয় বরং অপরাধীদেরকে আইন কীভাবে রক্ষা করে থাকে যেখানে ‘অনার কিলিং’-এর ব্যাপক প্রচলন আছে। বাস্তবতা হলো আইন প্রকাশ্যেই হত্যাকারীদের রক্ষা করে। যেমন— জর্ডানে প্রচলিত আইন অনুযায়ী, “কোনো ব্যক্তি তার স্ত্রীকে অথবা কোনো নারী আত্মীয় ব্যভিচারী হওয়ার কারণে যদি হত্যা, আহত কিংবা আঘাত করে, তবে সে সবরকম শাস্তি থেকে অব্যাহতি পাবে।” (পেনাল কোড-এর ৩৪০ নং আর্টিকেল)। সিরিয়ার আইনে বলা হয়েছে, “কোনো ব্যক্তি তার স্ত্রী বা পূর্বসূরী বা উত্তরসূরীদের কাউকে অথবা নিজের বোনকে ব্যভিচার কিংবা অবৈধ যৌন সম্পর্কে লিপ্ত অবস্থায় দেখতে পায় এবং একজনকে বা উভয়কেই হত্যা বা আহত করে, তবে সে শাস্তি থেকে অব্যাহতি পাবে।” (আর্টিকেল: ৫৪৮)
মরক্কোর আইনে বলা হয়েছে, “হত্যা, আঘাত ও প্রহার ক্ষমাযোগ্য (অপরাধ), যদি স্বামী তার স্ত্রীকে ব্যভিচারে লিপ্ত অবস্থায় দেখতে পায়।” (পেনাল কোড-এর ৪১৮ নং আর্টিকেল)
হাইতিতে একই ধরনের আইন রয়েছে, যেখানে ব্যভিচারী স্ত্রীর হত্যাকারী স্বামীকে ক্ষমা করে দেওয়া হয় (পেনাল কোড-এর ২৬৯ ধারা)। ব্রাজিল ও কলম্বিয়ায় ২০ বছর আগে আইনটি পরিবর্তন করার পূর্ব পর্যন্ত একজন স্বামী তার স্ত্রীকে হত্যার ঘটনাটি ‘অনার কিলিং’ হিসেবে দেখিয়ে এর ন্যায্যতা প্রমাণের অধিকার পেতো।
এসকল দেশের আইনে পারিবারিক “মর্যাদা” রক্ষার ভূমিকা পালনের দায়িত্ব ন্যস্ত করা হয়েছে পুরুষদের ওপর। বাস্তবে লক্ষ্য করা যায় যে, এই কারণে নারী হত্যাই তাদের প্ররোচিত ও উৎসাহিত করা হয়েছে।
ইরান ও আফগানিস্তানের মত কিছু দেশে ‘অনার কিলিং’ এর চর্চা ব্যাপক আকারে ছিলো না, কিন্তু গত কয়েক দশকে এর মাত্রা অনেক বেড়ে গেছে।
ইরানের আইন ‘অনার কিলিং’ অনুমোদন করে না এবং ধর্মীয় নেতারা-এর বিপক্ষে অনেক বক্তব্য রেখেছেন। সবকিছুর পরেও সরকার নিজেই পারিবারিক ‘সম্মান/মর্যাদা’ রক্ষার ভূমিকা গ্রহণ করে হত্যাকাণ্ডগুলো সম্পাদন করছে। উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করা যেতে পারে আতেফেহ-এর ঘটনাটি। উত্তর ইরানের কিশোরী আতেফেহ-এর প্রাণ নেওয়া হয় কারণ এক ব্যক্তি তার শ্লীলতাহানী ঘটায়। মূলতঃ ধর্ষিত হওয়াটাই ইরানে সরকারীভাবে একটি অপরাধ। মেয়েটির পিতার ও তার পরিবারের প্রতিবাদ সত্ত্বেও রাষ্ট্র তাকে হত্যা করে।
উল্লেখ করা যেতে পারে, সাকিনেহ মোহাম্মাদি আশতিয়ানির ঘটনাটি। যাকে গত বছর পাথর ছুঁড়ে মৃত্যুদণ্ডের রায় দেওয়া হয়। পরবর্তীতে আন্তর্জাতিক চাপের মুখে পাথর নিঃক্ষেপের পরিবর্তে ফাঁসিকাষ্ঠে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের রায় দেওয়া হয়। আসল বিষয় হলো ইসলামী প্রজাতন্ত্র সাকিনেহ’র পুত্র ও পরিবারের সকলের আপত্তি উপেক্ষা করে তাকে শাস্তি প্রদানে অটল থাকে।
এসকল ঘটনায় লক্ষ্য করা যায় যে, পরিবার বা আত্মীয়স্বজন তাদের তথাকথিত সম্মানের ব্যাপারে আগ্রহী না হলেও রাষ্ট্র এ ব্যাপারে আইন চাপিয়ে দিতে আগ্রহী, যাতে করে পরিবারগুলো তাদের নারী সদস্যদের যৌন আচরণ ও সম্পর্কের ওপর নিয়ন্ত্রণ চাপাতে বাধ্য হয়।
এ ঘটনাগুলো থেকে এটা পরিষ্কার যে শাসক শ্রেণী ও এর রাষ্ট্রযন্ত্রগুলোই এ জাতীয় অপরাধ সংঘটনের জন্য দায়ী। নারীদের দমন ও নিপীড়নের ওপর নির্ভর করে গড়ে ওঠা একটি শ্রেণী কাঠামো টিকিয়ে রাখার জন্য এগুলো সুপরিকল্পিতভাবে করা হয়।


ধর্মের ভূমিকা - - -

‘অনার কিলিং’ বিষয়ক বিতর্কে কেউ কেউ যুক্তি দেখান যে, এর উৎপত্তি ঘটেছে ইসলাম ধর্ম থেকে। এ মতামতের সপক্ষে বেশ কিছু প্রমাণও রয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, ইসলাম অধ্যুষিত মধ্যপ্রাচ্য ও দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে অধিকমাত্রায় এর প্রচলন রয়েছে। তবে এ মতের বিপক্ষেও যুক্তি রয়েছে।
‘অনার কিলিং’ যে কেবলমাত্র মুসলিমদের ক্ষেত্রেই ঘটে তা নয়। অনেক অমুসলিম দেশে এ ঘটনা ঘটে— যেমন: ব্রাজিলে, আইনটি বদলানোর পূর্বে, মাত্র একটি বছরে প্রায় আটশ জন স্বামী তাদের স্ত্রীদের হত্যা করেছিলো। ভারতে হিন্দু ও শিখদের ভেতরেও এর প্রচলন আছে। কানাডা নিবাসী শিখ পরিবারের ১৭ বছর বয়সী মন্দিপ আটওয়ালের ঘটনাটি এর একটি উদাহরণ। মন্দিপকে তার পরিবার ভারত পাঠিয়ে দিয়েছিলো যেখানে তাকে হত্যা করা হয়। তার অপরাধ সে একজনকে ভালোবাসতো এবং পরিবারের ঠিক করা বিয়েতে সে মত দেয় নি। ১৯৯৮ সালে শুধু পাঞ্জাবেই ৮৮৮ জন নারী ‘অনার-কিলিং’-এর স্বীকার হন। ১৯৯৭ সালে সিন্ধু প্রদেশে ৩০০ নারীর প্রাণ হরণ করা হয়।
কোরান ও হাদীসে ‘অনার কিলিং’-এর কোনো উল্লেখ নেই বলেও অনেকে বলে থাকেন।
এর শেকড় ইসলাম ধর্মে আছে কি নেই সে বিষয় নিয়ে মতপার্থক্য থাকলেও একটি বিষয় নিশ্চিত যে, ইসলাম ও অন্যান্য ধর্মগুলো শাসক শ্রেণীর সেবায় নিয়োজিত এবং এর যে কোনো প্রয়োজনে কোনো না কোনো উপায়ে সবগুলো ধর্মই ‘অনার কিলিং’-এর প্রসার ঘটিয়েছে। কোরানে ‘অনার কিলিং’-এর উল্লেখ না থাকলেও এবং কোরানের কিছু ব্যাখ্যা একে নিষিদ্ধ করলেও ‘অনার কিলিং’-এর ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করলে, তা হবে ইসলামী আইনের সর্বাঙ্গীন মূলনীতির ঘোর বিরোধিতা।
কথা হলো, যখন কোনো ধর্ম sex segregation আরোপ করে, নারীদের পর্দা করতে ও পুরুষের পেছনে থাকতে হুকুম জারী করে; যখন পুরুষ ও পরিবার কর্তৃক নারীরা রূঢ় আচরণের শিকার হয়, স্বামীরা স্ত্রীদের শাস্তি প্রদানের অনুমতি পায়, সেদিক থেকে লক্ষ্য করলে ‘অনার কিলিং’কে এসমস্ত ঘটনার একটি পরিবর্ধিত রূপ হিসেবে বিবেচনা করা যায়।
ইসলামে বিয়ে বহির্ভূত সম্পর্কের ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। নারী পুরুষ উভয়ের ক্ষেত্রেই জেনাহ (ব্যভিচার) নিষিদ্ধ। কিন্তু একইসাথে পুরুষদের রয়েছে একাধিক স্ত্রী গ্রহণের অনুমতি। শিয়া ধর্ম মোতাবেক পুরুষদের জন্য অস্থায়ী (Sigle or Siqe) এমনকি কয়েক ঘণ্টার জন্য বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার অনুমতি রয়েছে। এদিকে নারীদেরই কেবল স্বামীর প্রতি সম্পূর্ণ আনুগত্য প্রদর্শন করতে হয় এবং শারীরিক শুদ্ধতা রক্ষার দায়বদ্ধতাও শুধু মহিলাদের জন্যই প্রযোজ্য। ইসলামী আইন অনুসারে পুরুষেরা বাইরের জগতের ওপর নারীদের অধিকারকে অস্বীকৃতি জানাতে পারে, ঘরের বাইরে যাবার ব্যাপারে নিষেধ করতে পারে। সুতরাং, এটি নিশ্চিত যে ‘অনার কিলিং’ ইসলামী মূলনীতির একটি বর্ধিত রূপ। হতে পারে ইসলাম ধর্ম থেকে এর উৎপত্তি ঘটে নি, কিন্তু যেসব স্থানে শরিয়াহ আইন (ইসলামী আইন) চালু রয়েছে, সেখানে ইসলাম ধর্ম এর অনুশীলনে অবদান রেখে, প্রসার ঘটিয়ে এবং এর প্রয়োগ জোরপূর্বক আরোপ করেছে।
বিশ্বের হাজার হাজার সম্ভাবনাময় তরুণীদের জীবন কেড়ে নিয়েছে এবং আরও লক্ষ লক্ষ নারীকে দমন ও সন্ত্রস্ত করে রেখেছে ‘অনার কিলিং’। পশ্চাৎপদ ও প্রতিক্রিয়াশীল এই রীতি থেকে মুক্তি পেতে হলে এর বিরুদ্ধে লড়াই গড়ে তুলতে হবে। ‘অনার কিলিং’সহ নারীর ওপর অত্যাচারের সব ধরনের কৌশল ও রূপ থেকে মুক্তির উপায় খুঁজতে হলে অর্থনৈতিক ও সামাজিক প্রক্রিয়াকে উৎখাত করতে হবে। যা থেকে এসকল নির্যাতন ও অত্যাচার উদ্ভব ও পুনরুদ্ভব ঘটছে। কিন্তু প্রভাবশালী প্রতিক্রিয়াশীল ধ্যান-ধারণা ও আচরণের বিরুদ্ধে সংগ্রাম ছাড়া এই ব্যবস্থার পরিবর্তন ঘটানো সম্ভব নয়। কাজেই প্রক্রিয়াটির বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে যাওয়া ও নারীর ওপর চালিত সব ধরনের নির্যাতনের বিরুদ্ধে যারা সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছে তাদের সাথে ঐক্যবদ্ধ হওয়া দু’টি অবিচ্ছিন্ন বিষয়।
৮ মার্চ-কে ‘আন্তর্জাতিক নারী দিবস’ হিসেবে ঘোষণা করার পর অনেক বছর পেরিয়ে গেছে। কিছু দেশে পুরুষ আধিপত্যের নগ্ন নিদর্শন রয়েছে আগের মতোই। দেখা যায়, যেখানে ‘তাদের’ নারীদের জীবন ও মৃত্যুর ওপর পুরুষদের রয়েছে সকল ক্ষমতা বিষয়টি সেসব স্থানে স্বাভাবিক ও আইনানুগ বলে বিবেচিত হয়। অন্যদিকে সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলোতে আধিপত্যের অস্তিত্ব প্রত্যক্ষভাবে না থাকলেও পরোক্ষভাবে লুকিয়ে আছে এর বীভৎস রূপ। গোটা বিশ্ব জুড়ে পুরুষের কর্তৃত্বের এই অটল অস্তিত্ব নির্দেশ করে বিশ্বজোড়া সর্বব্যাপী বৈপ্লবিক পরিবর্তনের যা ঘটবে সকল অন্যায় দূর করার লক্ষ্যে।

প্রায় পাঁচটি বছর কেটে গেছে ১৭ বছরের তরুণী দোয়া খলিলের মৃত্যুর। বাড়ী ছিলো ইরাকী কুর্দিস্তানে। পারিবারিক মর্যাদা রক্ষার জন্য তার আত্মীয়-স্বজনেরা তাকে পাথর নিঃক্ষেপ করে হত্যা করে। মোবাইলে ধারণকৃত এই ভয়ংকর ঘটনার দৃশ্য ইন্টারনেটে যারা দেখেছেন, তারা মাত্রই আতংকিত হয়েছেন। আর সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশে ঘটা হেনার মৃত্যু। হেনা ১৪ বছরের একটি কিশোরী। নিতান্ত দরিদ্র পরিবারের সন্তান। একবেলা খায়, তো অন্য বেলায় উপোস। কখনও হয়তো বা দু’বেলাই উপোস। জীবন কী বুঝে ওঠার বয়সও তার হয়ে ওঠে নি। তবু কী ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতা নিয়ে তাকে এ পৃথিবী ছাড়তে হলো! শরীয়তপুরের নাড়িয়া উপজেলার চামটা গ্রামের দরিদ্র কৃষক দরবেশ খাঁর মেয়ে হেনাকে ধর্ষণ করেছে তারই চাচাত ভাই। মাহবুব নামের এক পশু! আরও কিছু পশুর দল বিচারের নামে ফতোয়া দিয়ে দোররার আঘাতে আঘাতে তাকে হত্যা করে, নির্ধারিত একশ দোররার প্রয়োজন হয় নি। সত্তর দোররায় মেয়েটি লুটিয়ে পড়লো এবং যা হওয়ার তাই হলো…।

ঘটনাগুলো একটি পিতৃতান্ত্রিক বিশ্বে নারীর উপর প্রতিনিয়ত ঘটে চলা নির্যাতনকে নাটকীয়ভাবে প্রমাণ করে। বহুদিন থেকে বিশ্বের বিপুলসংখ্যক নারী “অনার কিলিং”-এর শিকার হয়েছে, যাদের অধিকাংশই কিশোরী।
যাদের হত্যাকাণ্ডের ঘটনা আন্তর্জাতিক মহলের নজর কেড়েছিলো করেছিলো, তাদের একটি তালিকা দেখায় যে, নারীদের বিরুদ্ধে এই কার্যকলাপ বিশ্বের অনেক জায়গায় চালু রয়েছে, বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্যে (এর মধ্যে রয়েছে তুরস্ক) এবং দক্ষিণ এশিয়ায়।
জাতিসংঘের জনসংখ্যা তহবিল (population fund) এর হিসেবমতে সারা বিশ্বে প্রতি বছর “অনার কিলিং”-এর শিকার হন সর্বমোট ৫০০০-এরও বেশী নারী। তবে সঠিক সংখ্যা আরও বেশী হতে পারে, যদি “মর্যাদা সংক্রান্ত অন্যান্য অপরাধসমূহ গণনায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়।”
“পুলিশ চিফদের মতে, প্রতি বছর বৃটেনে ১৭ হাজারের মতো নারী হত্যাকাণ্ডসহ মর্যাদা সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন হিংস্রতার শিকার হয়। কর্তৃপক্ষ আরও জানান, এটি বিশাল একটি বিষয়ের সামান্য একটি ইঙ্গিত মাত্র।” (ডেইলি ইন্ডিপেন্ডেন্ট, ১০ ফেব্রুয়ারি, ২০০৮)

এগুলো শুধুমাত্র যুক্তরাজ্যের হিসেব, এখানে মধ্যপ্রাচ্য কিংবা দক্ষিণ এশিয়ার তালিকা নেই, যেখানে পরিসংখ্যান আরও ভয়াবহ।
দোয়াকে পাথর নিঃক্ষেপের ঘটনা যে স্থানে ঘটে, সেই ইরাকী কুর্দিস্তানে ১৯৯১ (১৯৯১ সালে যুক্তরাষ্ট্র ও অন্যান্য সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলো ইরাকে প্রথমবারের মতো আক্রমণ করে) এবং ২০০৭ এর মধ্যবর্তী সময়কালে ১২ হাজারের অধিক নারী অনার কিলিংসের শিকার হয়। (দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস, ২০ নভেম্বর ২০১০)
“অনার কিলিং”-এর অনেকগুলো ঘটনা সংঘটিত হয় এমন আরেকটি স্থান হলো— পাকিস্তান। সেখানে একে বলা হয় “কারো-কারি”। যদি সরকারী হিসেবের ওপর আস্থা রাখা হয়, তবে “গত ৬ বছরে পাকিস্তানের ৪ হাজারের বেশী নারী এই ধরনের হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন।” (বিবিসি, ২ মার্চ, ২০০৫)
“অনার কিলিং”-এর ওপর উইকিপিডিয়ার দেওয়া তথ্যমতে, নানান দেশেই ‘অনার কিলিং’ ঘটেছে, যার মধ্যে রয়েছে— আলবেনিয়া, বাংলাদেশ, ব্রাজিল, কানাডা, ডেনমার্ক, ইকুয়েডর, মিশর, জার্মানি, ভারত, ইরান, ইরাক, ইসরায়েল, ইতালি, জর্ডান, মরক্কো, পাকিস্তান, ফিলিস্তিন এলাকা, সুইডেন, তুরস্ক, উগান্ডা, যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্র।

একজন মহিলার অনার কিলিং এর শিকার হওয়ার পিছনে নানা কারণ থাকতে পারে; যদি তিনি কাউকে ভালোবাসেন অথবা তার প্রেমিক থাকে। এছাড়া কিছু বিষয় রয়েছে যেমন— মহিলাটি যদি তার উপর চাপিয়ে দেওয়া কোনো বিয়েতে অস্বীকৃতি জানান; হতে পারে তিনি ধর্ষণের শিকার, কিংবা অত্যাচারী স্বামী থেকে তালাক চাইছেন। ব্যভিচার— আরেকটি কারণ। অনেক ক্ষেত্রে কেবলমাত্র সন্দেহের ওপর নির্ভর করেই হত্যাকাণ্ডে সম্মতি প্রদান করা হয়। উদাহরণ হিসেবে ২০০৭ সালে জর্ডানে সংঘটিত একটি হত্যাকাণ্ডের ঘটনা উল্লেখ করা যেতে পারে, যেখানে ১৭ বছর বয়সী কন্যাকে তার পিতা[!] গুলি করে হত্যা করে। তার ‘সন্দেহ’ ছিলো যে, মেয়েটি যৌন সম্পর্কে জড়িত। যদিও মেডিকেলের পরীক্ষায় মেয়েটির কুমারিত্ব প্রমাণিত হয়েছিলো।


স্বেচ্ছাকৃত অকার্যকর আইন - - -

“অনার কিলিং”-এর বিপক্ষে সারা বিশ্বের মানুষের মাঝে প্রতিক্রিয়ার মুখে কিছু রাষ্ট্র এর অনুশীলনকে আইন-বহির্ভূত বলে ঘোষণা করেছে, যার মধ্যে রয়েছে— যুক্তরাষ্ট্র, ইরাকের কুর্দিশ স্বায়ত্বশাসিত সরকার এবং পাকিস্তান। তবে নানা কারণে এসব দেশের সরকার এখনও এই আইন ভঙ্গকারীদের প্রতি বেশ সদয়। উদাহরণস্বরূপ, আন্তর্জাতিক চাপের মুখে কুর্দিশ স্বায়ত্তশাসিত সরকার ‘অনার কিলিং’কে বেআইনী ঘোষণা করে আইনটি সংশোধন করেছে। কিন্তু পরিবর্তিত আইনটি কেবলমাত্র কাগজপত্রেই রয়ে গেছে; এর প্রয়োগের ন্যূনতম আগ্রহ কর্তৃপক্ষ প্রদর্শন করছে না। অনেকক্ষেত্রে এই সমস্ত হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় তারা অন্ধের ভূমিকা পালন করে। স্থানীয় নিরাপত্তা কর্মীরা নিশ্চিত করেছে— দোয়াকে পাথর নিঃক্ষেপের সময় কেউ কোনোপ্রকার বাধা দেবার চেষ্টাও করে নি।
কোনো কোনো ক্ষেত্রে পরিবারের সর্বকনিষ্ঠ পুরুষ সদস্যরা সর্বনিম্ন শাস্তি পাওয়ার জন্য হত্যাকাণ্ড সম্পাদন করে থাকে। অন্যান্য ক্ষেত্রে “অপমানিত” মহিলাটিকে জোরপূর্বক নিজের প্রাণ দিতে বাধ্য করা একটি সাধারণ ঘটনায় পরিণত হয়েছে।

তুরস্কের দক্ষিণ আনাতোলিয়ার চারপাশের শহরগুলোতে এবং বাটমান-এ বহুসংখ্যক অনার কিলিং ঘটে যেগুলো ঘটেছে পাথর নিঃক্ষেপ, শ্বাসরোধ, গুলি করে অথবা জ্যান্ত কবর দিয়ে। ইদানীং প্রায়ই তরুণীরা আত্মহত্যা করেছে বলে খবর পাওয়া যায়।
তুরস্কে পুলিশ একটি ১৬ বছর বয়সী মেয়ের লাশ উদ্ধার করে। মেয়েটির অপরাধ ছিলো— ছেলেদের সাথে কথা বলা, সেজন্য তাকে জ্যান্ত কবর দিয়ে দেয় তার আত্মীয়রা। লাশটির দুই হাত বাধা ছিলো। ময়নাতদন্তে মেয়েটির শরীরের ভেতর প্রচুর পরিমাণ মাটি পাওয়া গেছে, যা থেকে বোঝা যায় তাকে জ্যান্ত কবরই দেওয়া হয়েছিলো। (৪ ফেব্রুয়ারী, ২০১০; গার্ডিয়ান ডট কো ডট ইউকে)
Birzeit University’র প্রফেসর শরীফ খান্নার মতে, আরব সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ‘অনার-কিলিং’ লুকিয়ে আছে, আরব সমাজে মেয়েদের শুধুই সন্তানোৎপাদনের যন্ত্র মনে করা হয়। শুধু শিক্ষার অভাব এর জন্য দায়ী বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন না, তুরস্কে এক রিসার্চে দেখা গেছে, ৬০ ভাগ হত্যাকারীই গ্র্যাজুয়েট বা হাই-স্কুল পাশ।

“গত ৬ বছরে বাটমান শহরে ১৬৫টি আত্মহত্যা ও আত্মহত্যার চেষ্টার ঘটনা ঘটে, যার ১০২টিই ঘটে নারীদের দ্বারা। জাতিসংঘের মতে, এ বছরের শুরু থেকে ৩৬ জন নারী আত্মহত্যা করেছেন।” (দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস, ১৬ জুলাই, ২০০৬) এসকল সন্দেহজনক ঘটনা তদন্ত করতে জাতিসংঘ তুরস্কে দ্রুত বিশেষ দূত ইয়াকিন আর্তার্ক (Yakin Erturk)-কে পাঠায়। দূত উপসংহারে উল্লেখ করেন যে, কিছু ঘটনা ছিলো প্রকৃতপক্ষে আত্মহত্যা, অন্যগুলো আত্মহত্যা কিংবা দুর্ঘটনার ছদ্মবেশে ‘অনার কিলিং’।
পাকিস্তানে ‘অনার কিলিং’ হত্যা হিসেবে বিবেচিত হওয়ার কথা থাকলেও কার্যত পুলিশ এমনকি আদালতও তা উপেক্ষা করে থাকে। হত্যাকারী যদি দাবী করে যে, তার সম্মান রক্ষার জন্য সে হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে, তাহলে সে বেকসুর ছাড়া পেয়ে যায়। আন্তর্জাতিক ও জাতীয় চাপের মুখে ইরাকী কুর্দিস্তানের মতো পাকিস্তানে ‘অনার কিলিং’-এর সাথে জড়িত অপরাধীদের শাস্তি প্রদানের লক্ষ্যে একটি বিল উত্থাপন করা হয়, যেখানে ৭ বছর কারাদণ্ড থেকে মৃত্যুদণ্ড পর্যন্ত শাস্তি প্রদানের উল্লেখ করা হয়। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের মদদপুষ্ট জিয়া-উল-হক এর শাসনামলে আইনের কিছু ধারা তৈরী করা হয়, যার মাধ্যমে আক্রান্তের আত্মীয়স্বজনকে ক্ষতিপূরণ প্রদানের বিনিময়ে খুনীরা খালাস পাওয়ার সুযোগ পায়। পাকিস্তানে ‘কারো-কারি’ বৃদ্ধি পাওয়ার পেছনে এই আইনটির সরাসরি ভূমিকা রয়েছে এবং এ আইনটি বর্তমানে বলবৎ আছে।
তবে, অধিকাংশ ক্ষেত্রে হত্যাকারীরা শিকারীর ঘনিষ্ট আত্মীয় হয়। এর ফলে ক্ষমা ভিক্ষার জন্য ক্ষতিপূরণের কোনো প্রয়োজন হয় না এবং হত্যাকারী বেকসুর ছাড়া পেয়ে যায়।
২০০৫ সালের মার্চ মাসে পাকিস্তান পার্লামেন্টের একজন মহিলা সদস্য একটি বিল উত্থাপন করেন যেখানে “অনার কিলিং”কে আইনবহির্ভূত করার ক্ষেত্রে আরো শক্তিশালী ভূমিকা গ্রহণের ব্যাপারে উল্লেখ করা হয়। পাকিস্তান সরকার ইসলামপন্থীদের সাথে ঐক্যমত হয়ে এ বিলটি প্রত্যাখান করে। পার্লামেন্ট ইসলাম বিরোধী ঘোষণা করে সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটের মাধ্যমে বিলটি প্রত্যাখান করে। (বিবিসি, ২ মার্চ ২০০৫) শেষ পর্যন্ত এক বছর পর বিলটি গৃহীত হয়। তথাপি এহেন কর্মকাণ্ডের চর্চা এখনও বিস্তর এবং এর শিকার হচ্ছে বিপুল সংখ্যক মানুষ।


সরকারের ভূমিকা - - -

পাকিস্তান, কুর্দিস্তান, তুরস্ক এবং অন্যান্য দক্ষিণ এশীয় ও মধ্য প্রাচ্যের দেশসমূহে নারীদের বিরুদ্ধে এধরনের ঘটনাগুলোর পেছনের কারণ কী হতে পারে— সে বিষয়ে বিতর্ক আছে। কেউ সংস্কৃতিকে এর প্রধান কারণ বলে মনে করেন, আবার কেউ কেউ প্রভাববিস্তারকারী ‘ধর্ম’কেই এর কারণ বলে মনে করে থাকেন।
এ দু’টি ব্যাখ্যাতেই সত্যতা থাকতে পারে, তবে এর কোনোটি সম্পূর্ণ সত্য নয়। একই সাথে দুটো ব্যাখ্যাকে গ্রহণ করলেও সেটি পুরোপুরি সত্যতা লাভ করবে না, যদি এর সাথে নারীর ওপর অত্যাচার, পিতৃতন্ত্র এবং ঐসব সামাজিক সম্পর্কের সাথে সংশ্লিষ্ট উৎপাদনের (অর্থনৈতিক) সম্পর্কসমূহকে যুক্ত করা না হয়। নারীর ওপর অত্যাচারের এই রূপগুলো উৎপাদনের পশ্চাৎপদ সামন্তীয় এবং আধা-সামন্তীয় সম্পর্কের কার্যকারিতা রক্ষা ও নিশ্চিত করার জন্য জরুরী, যা অন্যদিকে, বর্তমান বিশ্বে সাম্রাজ্যবাদী কর্তৃত্বের সাথে যুক্ত।
সংস্কৃতির অংশ হিসেবে যা বিবেচনা করা হয়, তা মূলতঃ শাসক শ্রেণীর স্বার্থকেই পোষণ করে। এরূপ উৎপাদন সম্পর্কের বিরাজমান প্রভাবের কারণে এধরনের একটি সংস্কৃতি ও নৈতিকতা গড়ে তোলা হয়েছে এবং শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে যা মানুষের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে। এটা বিশ্বাস করা ভুল হবে না যে, এই নীতিগুলো আইন এবং প্রভাবশালী ধর্মগুলোর ব্যাখ্যার ভেতরে প্রবেশ করেছে।
পিতৃতান্ত্রিক “মর্যাদা” রক্ষার অর্থ মূলতঃ একটি বিশেষ উৎপাদনের সম্পর্ককে রক্ষা করা এবং সর্বশেষ বিশ্লেষণে এটি রক্ষা করছে শাসক শ্রেণীর স্বার্থকেই। শুধু তাই নয়, এটি পুরুষের কর্তৃত্বকেও রক্ষা করছে, যার অস্তিত্ব আজ বিশ্বের প্রতিটি দেশেই বিদ্যমান রয়েছে নানা রূপে উৎপাদনের সম্পর্ক অনুযায়ী।
এটি বিস্ময়কর নয় যে, কুর্দিশ শাসকগণ, যারা আধা-সামন্তীয় এবং গোষ্ঠী সম্পর্কের প্রতিনিধি এবং ইরাকে যুক্তরাষ্ট্রের কর্তৃত্বের অন্যতম একটি স্তম্ভ স্থাপন করেছে তারা “অনার কিলিং”-এর বিরুদ্ধে গুরুত্বের সাথে লড়াই করতে অনিচ্ছুক এবং যারা এ ঘটনার সাথে জড়িত তাদের প্রতি সদয়।
অবাক হবার কিছু নেই যে, পাকিস্তান সরকার এবং পার্লামেন্ট পশ্চাদপদ অর্থনৈতিক এবং সামাজিক সম্পর্কের প্রতিনিধিত্ব করে এবং একই সাথে সাম্রাজ্যবাদীদের সেবায় নিয়োজিত। এ ধরনের রীতিকে খর্ব করতে পারে এমন যেকোনো আইনেরই প্রতি তারা ব্যাপক প্রতিরোধ গড়ে তুলছে। চাপের মুখে আইনগুলো গৃহীত হয়, তখনও অপরাধীদের জন্য জায়গা ছেড়ে দেওয়া, যার ফলে তারা এইসব অপরাধ ঘটিয়ে যেতে পারে।
দ্রুত নজর দেওয়া যাক কিছু স্থানে, যেখানে যারা অপরাধের শিকার হন, তারা নয় বরং অপরাধীদেরকে আইন কীভাবে রক্ষা করে থাকে যেখানে ‘অনার কিলিং’-এর ব্যাপক প্রচলন আছে। বাস্তবতা হলো আইন প্রকাশ্যেই হত্যাকারীদের রক্ষা করে। যেমন— জর্ডানে প্রচলিত আইন অনুযায়ী, “কোনো ব্যক্তি তার স্ত্রীকে অথবা কোনো নারী আত্মীয় ব্যভিচারী হওয়ার কারণে যদি হত্যা, আহত কিংবা আঘাত করে, তবে সে সবরকম শাস্তি থেকে অব্যাহতি পাবে।” (পেনাল কোড-এর ৩৪০ নং আর্টিকেল)। সিরিয়ার আইনে বলা হয়েছে, “কোনো ব্যক্তি তার স্ত্রী বা পূর্বসূরী বা উত্তরসূরীদের কাউকে অথবা নিজের বোনকে ব্যভিচার কিংবা অবৈধ যৌন সম্পর্কে লিপ্ত অবস্থায় দেখতে পায় এবং একজনকে বা উভয়কেই হত্যা বা আহত করে, তবে সে শাস্তি থেকে অব্যাহতি পাবে।” (আর্টিকেল: ৫৪৮)
মরক্কোর আইনে বলা হয়েছে, “হত্যা, আঘাত ও প্রহার ক্ষমাযোগ্য (অপরাধ), যদি স্বামী তার স্ত্রীকে ব্যভিচারে লিপ্ত অবস্থায় দেখতে পায়।” (পেনাল কোড-এর ৪১৮ নং আর্টিকেল)
হাইতিতে একই ধরনের আইন রয়েছে, যেখানে ব্যভিচারী স্ত্রীর হত্যাকারী স্বামীকে ক্ষমা করে দেওয়া হয় (পেনাল কোড-এর ২৬৯ ধারা)। ব্রাজিল ও কলম্বিয়ায় ২০ বছর আগে আইনটি পরিবর্তন করার পূর্ব পর্যন্ত একজন স্বামী তার স্ত্রীকে হত্যার ঘটনাটি ‘অনার কিলিং’ হিসেবে দেখিয়ে এর ন্যায্যতা প্রমাণের অধিকার পেতো।
এসকল দেশের আইনে পারিবারিক “মর্যাদা” রক্ষার ভূমিকা পালনের দায়িত্ব ন্যস্ত করা হয়েছে পুরুষদের ওপর। বাস্তবে লক্ষ্য করা যায় যে, এই কারণে নারী হত্যাই তাদের প্ররোচিত ও উৎসাহিত করা হয়েছে।
ইরান ও আফগানিস্তানের মত কিছু দেশে ‘অনার কিলিং’ এর চর্চা ব্যাপক আকারে ছিলো না, কিন্তু গত কয়েক দশকে এর মাত্রা অনেক বেড়ে গেছে।
ইরানের আইন ‘অনার কিলিং’ অনুমোদন করে না এবং ধর্মীয় নেতারা-এর বিপক্ষে অনেক বক্তব্য রেখেছেন। সবকিছুর পরেও সরকার নিজেই পারিবারিক ‘সম্মান/মর্যাদা’ রক্ষার ভূমিকা গ্রহণ করে হত্যাকাণ্ডগুলো সম্পাদন করছে। উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করা যেতে পারে আতেফেহ-এর ঘটনাটি। উত্তর ইরানের কিশোরী আতেফেহ-এর প্রাণ নেওয়া হয় কারণ এক ব্যক্তি তার শ্লীলতাহানী ঘটায়। মূলতঃ ধর্ষিত হওয়াটাই ইরানে সরকারীভাবে একটি অপরাধ। মেয়েটির পিতার ও তার পরিবারের প্রতিবাদ সত্ত্বেও রাষ্ট্র তাকে হত্যা করে।
উল্লেখ করা যেতে পারে, সাকিনেহ মোহাম্মাদি আশতিয়ানির ঘটনাটি। যাকে গত বছর পাথর ছুঁড়ে মৃত্যুদণ্ডের রায় দেওয়া হয়। পরবর্তীতে আন্তর্জাতিক চাপের মুখে পাথর নিঃক্ষেপের পরিবর্তে ফাঁসিকাষ্ঠে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের রায় দেওয়া হয়। আসল বিষয় হলো ইসলামী প্রজাতন্ত্র সাকিনেহ’র পুত্র ও পরিবারের সকলের আপত্তি উপেক্ষা করে তাকে শাস্তি প্রদানে অটল থাকে।
এসকল ঘটনায় লক্ষ্য করা যায় যে, পরিবার বা আত্মীয়স্বজন তাদের তথাকথিত সম্মানের ব্যাপারে আগ্রহী না হলেও রাষ্ট্র এ ব্যাপারে আইন চাপিয়ে দিতে আগ্রহী, যাতে করে পরিবারগুলো তাদের নারী সদস্যদের যৌন আচরণ ও সম্পর্কের ওপর নিয়ন্ত্রণ চাপাতে বাধ্য হয়।
এ ঘটনাগুলো থেকে এটা পরিষ্কার যে শাসক শ্রেণী ও এর রাষ্ট্রযন্ত্রগুলোই এ জাতীয় অপরাধ সংঘটনের জন্য দায়ী। নারীদের দমন ও নিপীড়নের ওপর নির্ভর করে গড়ে ওঠা একটি শ্রেণী কাঠামো টিকিয়ে রাখার জন্য এগুলো সুপরিকল্পিতভাবে করা হয়।


ধর্মের ভূমিকা - - -

‘অনার কিলিং’ বিষয়ক বিতর্কে কেউ কেউ যুক্তি দেখান যে, এর উৎপত্তি ঘটেছে ইসলাম ধর্ম থেকে। এ মতামতের সপক্ষে বেশ কিছু প্রমাণও রয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, ইসলাম অধ্যুষিত মধ্যপ্রাচ্য ও দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে অধিকমাত্রায় এর প্রচলন রয়েছে। তবে এ মতের বিপক্ষেও যুক্তি রয়েছে।
‘অনার কিলিং’ যে কেবলমাত্র মুসলিমদের ক্ষেত্রেই ঘটে তা নয়। অনেক অমুসলিম দেশে এ ঘটনা ঘটে— যেমন: ব্রাজিলে, আইনটি বদলানোর পূর্বে, মাত্র একটি বছরে প্রায় আটশ জন স্বামী তাদের স্ত্রীদের হত্যা করেছিলো। ভারতে হিন্দু ও শিখদের ভেতরেও এর প্রচলন আছে। কানাডা নিবাসী শিখ পরিবারের ১৭ বছর বয়সী মন্দিপ আটওয়ালের ঘটনাটি এর একটি উদাহরণ। মন্দিপকে তার পরিবার ভারত পাঠিয়ে দিয়েছিলো যেখানে তাকে হত্যা করা হয়। তার অপরাধ সে একজনকে ভালোবাসতো এবং পরিবারের ঠিক করা বিয়েতে সে মত দেয় নি। ১৯৯৮ সালে শুধু পাঞ্জাবেই ৮৮৮ জন নারী ‘অনার-কিলিং’-এর স্বীকার হন। ১৯৯৭ সালে সিন্ধু প্রদেশে ৩০০ নারীর প্রাণ হরণ করা হয়।
কোরান ও হাদীসে ‘অনার কিলিং’-এর কোনো উল্লেখ নেই বলেও অনেকে বলে থাকেন।
এর শেকড় ইসলাম ধর্মে আছে কি নেই সে বিষয় নিয়ে মতপার্থক্য থাকলেও একটি বিষয় নিশ্চিত যে, ইসলাম ও অন্যান্য ধর্মগুলো শাসক শ্রেণীর সেবায় নিয়োজিত এবং এর যে কোনো প্রয়োজনে কোনো না কোনো উপায়ে সবগুলো ধর্মই ‘অনার কিলিং’-এর প্রসার ঘটিয়েছে। কোরানে ‘অনার কিলিং’-এর উল্লেখ না থাকলেও এবং কোরানের কিছু ব্যাখ্যা একে নিষিদ্ধ করলেও ‘অনার কিলিং’-এর ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করলে, তা হবে ইসলামী আইনের সর্বাঙ্গীন মূলনীতির ঘোর বিরোধিতা।
কথা হলো, যখন কোনো ধর্ম sex segregation আরোপ করে, নারীদের পর্দা করতে ও পুরুষের পেছনে থাকতে হুকুম জারী করে; যখন পুরুষ ও পরিবার কর্তৃক নারীরা রূঢ় আচরণের শিকার হয়, স্বামীরা স্ত্রীদের শাস্তি প্রদানের অনুমতি পায়, সেদিক থেকে লক্ষ্য করলে ‘অনার কিলিং’কে এসমস্ত ঘটনার একটি পরিবর্ধিত রূপ হিসেবে বিবেচনা করা যায়।
ইসলামে বিয়ে বহির্ভূত সম্পর্কের ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। নারী পুরুষ উভয়ের ক্ষেত্রেই জেনাহ (ব্যভিচার) নিষিদ্ধ। কিন্তু একইসাথে পুরুষদের রয়েছে একাধিক স্ত্রী গ্রহণের অনুমতি। শিয়া ধর্ম মোতাবেক পুরুষদের জন্য অস্থায়ী (Sigle or Siqe) এমনকি কয়েক ঘণ্টার জন্য বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার অনুমতি রয়েছে। এদিকে নারীদেরই কেবল স্বামীর প্রতি সম্পূর্ণ আনুগত্য প্রদর্শন করতে হয় এবং শারীরিক শুদ্ধতা রক্ষার দায়বদ্ধতাও শুধু মহিলাদের জন্যই প্রযোজ্য। ইসলামী আইন অনুসারে পুরুষেরা বাইরের জগতের ওপর নারীদের অধিকারকে অস্বীকৃতি জানাতে পারে, ঘরের বাইরে যাবার ব্যাপারে নিষেধ করতে পারে। সুতরাং, এটি নিশ্চিত যে ‘অনার কিলিং’ ইসলামী মূলনীতির একটি বর্ধিত রূপ। হতে পারে ইসলাম ধর্ম থেকে এর উৎপত্তি ঘটে নি, কিন্তু যেসব স্থানে শরিয়াহ আইন (ইসলামী আইন) চালু রয়েছে, সেখানে ইসলাম ধর্ম এর অনুশীলনে অবদান রেখে, প্রসার ঘটিয়ে এবং এর প্রয়োগ জোরপূর্বক আরোপ করেছে।
বিশ্বের হাজার হাজার সম্ভাবনাময় তরুণীদের জীবন কেড়ে নিয়েছে এবং আরও লক্ষ লক্ষ নারীকে দমন ও সন্ত্রস্ত করে রেখেছে ‘অনার কিলিং’। পশ্চাৎপদ ও প্রতিক্রিয়াশীল এই রীতি থেকে মুক্তি পেতে হলে এর বিরুদ্ধে লড়াই গড়ে তুলতে হবে। ‘অনার কিলিং’সহ নারীর ওপর অত্যাচারের সব ধরনের কৌশল ও রূপ থেকে মুক্তির উপায় খুঁজতে হলে অর্থনৈতিক ও সামাজিক প্রক্রিয়াকে উৎখাত করতে হবে। যা থেকে এসকল নির্যাতন ও অত্যাচার উদ্ভব ও পুনরুদ্ভব ঘটছে। কিন্তু প্রভাবশালী প্রতিক্রিয়াশীল ধ্যান-ধারণা ও আচরণের বিরুদ্ধে সংগ্রাম ছাড়া এই ব্যবস্থার পরিবর্তন ঘটানো সম্ভব নয়। কাজেই প্রক্রিয়াটির বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে যাওয়া ও নারীর ওপর চালিত সব ধরনের নির্যাতনের বিরুদ্ধে যারা সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছে তাদের সাথে ঐক্যবদ্ধ হওয়া দু’টি অবিচ্ছিন্ন বিষয়।
৮ মার্চ-কে ‘আন্তর্জাতিক নারী দিবস’ হিসেবে ঘোষণা করার পর অনেক বছর পেরিয়ে গেছে। কিছু দেশে পুরুষ আধিপত্যের নগ্ন নিদর্শন রয়েছে আগের মতোই। দেখা যায়, যেখানে ‘তাদের’ নারীদের জীবন ও মৃত্যুর ওপর পুরুষদের রয়েছে সকল ক্ষমতা বিষয়টি সেসব স্থানে স্বাভাবিক ও আইনানুগ বলে বিবেচিত হয়। অন্যদিকে সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলোতে আধিপত্যের অস্তিত্ব প্রত্যক্ষভাবে না থাকলেও পরোক্ষভাবে লুকিয়ে আছে এর বীভৎস রূপ। গোটা বিশ্ব জুড়ে পুরুষের কর্তৃত্বের এই অটল অস্তিত্ব নির্দেশ করে বিশ্বজোড়া সর্বব্যাপী বৈপ্লবিক পরিবর্তনের যা ঘটবে সকল অন্যায় দূর করার লক্ষ্যে।

সর্বশেষ এডিট : ১৩ ই আগস্ট, ২০১৬ রাত ১১:২৬
০টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

মৃত্যু ডেকে নিয়ে যায়; অদৃষ্টের ইশারায়

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ১৭ ই মে, ২০২৪ সকাল ৮:৩৯

১৯৩৩ সালে প্রখ্যাত সাহিত্যিক উইলিয়াম সমারসেট মম বাগদাদের একটা গল্প লিখেছিলেন৷ গল্পের নাম দ্য অ্যাপয়েন্টমেন্ট ইন সামারা বা সামারায় সাক্ষাৎ৷

চলুন গল্পটা শুনে আসি৷

বাগদাদে এক ব্যবসায়ী ছিলেন৷ তিনি তার... ...বাকিটুকু পড়ুন

ফিরে এসো রাফসান দি ছোট ভাই

লিখেছেন আবদুর রব শরীফ, ১৭ ই মে, ২০২৪ দুপুর ২:৩৮

রাফসানের বাবার ঋণ খেলাপির পোস্ট আমিও শেয়ার করেছি । কথা হলো এমন শত ঋণ খেলাপির কথা আমরা জানি না । ভাইরাল হয় না । হয়েছে মূলতো রাফসানের কারণে । কারণ... ...বাকিটুকু পড়ুন

কুমীরের কাছে শিয়ালের আলু ও ধান চাষের গল্প।

লিখেছেন সোনাগাজী, ১৭ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৩:৪০



ইহা নিউইয়র্কের ১জন মোটামুটি বড় বাংগালী ব্যবসায়ীর নিজমুখে বলা কাহিনী। আমি উনাকে ঘনিষ্টভাবে জানতাম; উনি ইমোশানেল হয়ে মাঝেমাঝে নিজকে নিয়ে ও নিজের পরিবারকে নিয়ে রূপকথা বলে... ...বাকিটুকু পড়ুন

সভ্য জাপানীদের তিমি শিকার!!

লিখেছেন শেরজা তপন, ১৭ ই মে, ২০২৪ রাত ৯:০৫

~ স্পার্ম হোয়েল
প্রথমে আমরা এই নীল গ্রহের অন্যতম বৃহৎ স্তন্যপায়ী প্রাণীটির এই ভিডিওটা একটু দেখে আসি;
হাম্পব্যাক হোয়েল'স
ধারনা করা হয় যে, বিগত শতাব্দীতে সারা পৃথিবীতে মানুষ প্রায় ৩ মিলিয়ন... ...বাকিটুকু পড়ুন

রূপকথা নয়, জীবনের গল্প বলো

লিখেছেন রূপক বিধৌত সাধু, ১৭ ই মে, ২০২৪ রাত ১০:৩২


রূপকথার কাহিনী শুনেছি অনেক,
সেসবে এখন আর কৌতূহল নাই;
জীবন কণ্টকশয্যা- কেড়েছে আবেগ;
ভাই শত্রু, শত্রু এখন আপন ভাই।
ফুলবন জ্বলেপুড়ে হয়ে গেছে ছাই,
সুনীল আকাশে সহসা জমেছে মেঘ-
বৃষ্টি হয়ে নামবে সে; এও টের... ...বাকিটুকু পড়ুন

×