দুই প্রান্তের দুজন মানুষ ছিলাম আমরা। কারো সাথে কারো পরিচয় ছিল না কখনো। ছিল না কোনো আত্মীক সম্পর্ক। হঠাৎ করেই এই ব্যস্ত শহরে আমাদের পরিচয় হয়। মাত্র একটা সন্ধ্যা পরেই তৈরি হতে থাকে আমাদের সম্পর্কের সেতুবন্ধন। রাতটা কেটে যায় আমাদের খোশগল্পে। সকালবেলা এক সাথে নাস্তার টেবিলে।সিদ্ধান্ত যে বাসায় গত সন্ধ্যায় আমাদের পরিচয় হয়েছে সেই বাসা ছেড়ে দিয়ে নতুন বাসায় উঠব দুজন এক সাথে। প্রয়োজন হলে পুরো মাসের ভাড়া দিয়ে বাসা ছেড়ে দেব। বললাম দাদা আপনার আমার মাত্রই পরিচয় হয়েছে, এই বাসাতে অন্তত পক্ষে এই মাসটা থাকি, আমার সম্পর্কে আপনে জানেন, আপনে তো মুরুব্বী মানুষ আপনার সম্বন্ধে আমার আর কি জানার আছে। তাছাড়া আমি পোলাপাইন মানুষ আমার বিভিন্ন ধরণের বদ অভ্যাস আছে আপনে কি এগুলো সহ্য করতে পারবেন? একটু ধমক দিয়েই বললেন এই ব্যাটা আমার তো তোর বয়সী দুইটা ছেলে আছে তু্ই কি তাদের চেয়েও বেশী ফাজিল??? হইলেও কোন সমস্যা নেই মানুষ করে ছেড়ে দেব। প্রথম প্রশ্নের উত্তরে আমি দাদার উপর ৯৫% ফিদা হয়ে গেলাম। তাছাড়া প্রথম বাক্যেই ডিরেক্ট 'তুই'তে নেমে আসাতে ধর্ম বর্ণ বয়সের যোজন যোজন ব্যবধান নিয়ে আর কোনো প্রশ্ন করার সুযোগ ফেলাম না। যেই কথা সেই কাজ, দুদিনের মধ্যে আমরা নতুন বাসা পেয়ে গেলাম। শুরু হল পিতা-পুত্র, দাদা-নাতি, বন্ধু যেই সম্পর্ক বলি না কেন সব সম্পর্কের উপাদন দিয়ে আমাদের পথ চলা। বাহ্যিক দিক দিয়ে আমাদের মাঝে ছিল শুধু বয়সের ব্যবধান। কিন্তু মনের দিক দিয়ে কোন ব্যবধান উপলব্দি করিনি কখনো। ধর্ম ভিন্ন হলেও ছিলাম একই মতে বিশ্বাসী। কর্মেও ছিলাম আমরা একে অপরের পরিপূরক।সুখ দু:খ হাসি আনন্দে একই সাথে চোখের পলকে কেটে গেল সাত সাতটি বছর। একই বাসায় একই রুমে। সদস্য আমরা সেই দুজনই প্রবীন আর নবীন। এক সাথে থাকাকলিন সময়ে হঠাৎ করেই একটা টর্নেটো ঝড়ে আমার জীবন কিছুটা এলোমেলো করে দিয়ে গেল। চোখের সামনে সবকিছু দেখলেন, সাহস দিলেন, দায়িত্ব নিলেন। অভিজ্ঞতার কথা শুনালেন, ৫% অবশিষ্ট যেটা ছিল সেটাও দাদার উপর ফিদা হয়ে গেলাম। একজন আরেকজনকে ছাড়া একটি মুর্হুত্ থাকতে পারিনা। ছুটিছাটায় কেউ কোথাও গেলে অস্থির হয়ে যেতাম কখন ফিরবে। এমনি এক ছুটিতে গেলেন মার্চ মাসের ১৫ তারিখে, মার্চ মাস গেলে, এপ্রিলও গেল চিটাগাং থেকে আসার কোনো নাম গন্ধ নেই। ফোনে যোগাযোগ হয়, বলেন এই তো ভাই পত্রিকার কাজটা শেষ করেই চলে আসব।মে মাসের ২ তারিখ বৃহস্পতিবার রাতে ফোন দিলাম, একটু অভিমান করেই বললাম আপনে কি শুরু করছেন??? আসছেন না কেন??? আপনে চলে আসেন আমার ভালো লাগছে না, পরে না হয় আবার চিটাগাং যাবেন। আসার বানী শুনিয়ে বললেন
টিকেটের জন্য ষ্টেশনে গেছিলাম, টিকেট পেয়েছি শনিবার সকালের। বাসায় আসার সময় এই মাত্র তোর বৌদির জন্য ইয়া মোটা একটা তরমুজ নিয়ে আসলাম, বললাম ঠিক আছে শনিবারে যেনো মিস না হয়, অবশ্যই আসবেন। বললেন ওরে পাগল টিকেট যখন কাটা হয়ে গেছে না এসে কি পারব??? বললাম আচ্ছা ঠিক আছে শুক্রবারে রাতে আবার ফোন দেব। কল্পনায়ও ভাবতে পারিনি এটাই হবে দাদার সাথে আমার শেষ কথা। আমাদের কথাবার্তা শুনে হয়তো বিধাতাও তখন মিটিমিট হেসেছেন, দীর্ঘ সাতটি বছর এক সাথে আপন হয়ে থেকেছো বলে তোমাদের শেষবার কথা বলার সুযোগ দিলাম। যাতে যে চলে যাবে সে শান্তিতে থাকবে, আর যে ধরনীর বুকে থাকবে সে তোমাকে আজীবন স্বরণ রাখবে। দাদা আজও ভূলতে পারিনি সেই রাতের শেষ কথাগুলো।যদি আরো দুটিদিন আগে ট্রেনের টিকেটটা বুকিং দিতে তাহলে হয়তো "০৩ মে ২০১৩" শুক্রবার ভোরের বিধাতার ট্রেনটি তুমি মিস করতে। তাতে ক্ষতি কি ছিল??? আরো কিছুদিন পরে যেতেও পারতে!! বিধাতার ট্রেনে তো সবাইকেই আসন নিতে হবে। তাহলে আমাদের শেষ সাক্ষাতের ট্রেনটি কেন মিস হল???? (চলবে.......)
সর্বশেষ এডিট : ০৩ রা মে, ২০১৭ সন্ধ্যা ৭:২১