বিশ্বাস করতে পারেন, বিজ্ঞান ক্লাস নেয়ার জন্যে দেশের একজন স্কুল শিক্ষককে জেলে বন্দী করা হয়েছে?এটা কি সপ্তদশ শতকের গ্যালিলিওর ইতালী নাকি ২০২২ এর বাংলাদেশ? বিশ্বাস করতে পারেন, মুন্সীগঞ্জ জেলায় অতীশ দীপঙ্কর থেকে শুরু করে দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাস, রাজনীতিক সরোজিনী নাইডু, বিজ্ঞানী স্যার জগদীশ চন্দ্র বসু, লেখক হুমায়ুন আজাদ, সাহিত্যিক মানিক বন্দোপাধ্যায়, সমরেশ মজুমদাররা জন্ম নিয়েছেন?এই মুন্সীগঞ্জেরই ভাই হৃদয় মণ্ডলের উপর বাঙ্গালী মধ্যবিত্ত্ব মুসলিম পুরুষ শ্রেণীর রাষ্ট্রের জুলুম-নিপীড়নের নীরব সাক্ষী হয়ে জিজ্ঞাসা করতে ইচ্ছা হয়, এখানে শঠতার কী কোন সীমাপরিসীমা নাই? বাংলাদেশে বাঙ্গালী মুসলমান কি নিপীড়িত বর্গ, না অধিপতি বর্গ? ইনসাফ প্রতিষ্ঠার নিয়ত কিংবা কর্মকৌশল এই অধিপতি গোষ্ঠীর আছে কিনা? এরা নিজেরাই নিপীড়িত/আঘাতপ্রাপ্ত সাজে কিভাবে? বছর বছর পূজার সময় যখন নিয়ম করে সঙ্ঘবদ্ধ হয়ে হিন্দুদের পবিত্র প্রতিমা ভাঙা হয়, তখন সেটা ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত নয়? তখন এরা কই থাকে?
আমাদের জীবদ্দশায় আমরা ইউরো-আমেরিকান সাম্রাজ্যবাদী শক্তির দ্বারা সংঘটিত প্যালেস্টাইন, ইরাক, আফগানিস্তান, সিরিয়ার মুসলমানদের উপর চাপিয়ে দেয়া অন্যায্য যুদ্ধ ও গণহত্যা দেখলাম। লক্ষ লক্ষ নারী-শিশু হত্যা ও গণধর্ষণ দেখলাম। এই মুহূর্তে বিশ্বের ইতিহাসে বৃহত্তম সংখ্যায় ৪ কোটি চল্লিশ লাখ শরণার্থী মানুষ দেখতে পাচ্ছি, যাদের একটা বিরাট অংশ প্যালেস্টাইন, ইরাকী, কুর্দি, আফগান, সিরিয়ান, ইথিওপিয়ান, সুদানী, রোহিঙ্গা মুসলমান। এর আগে ভারত-পাকিস্তান-বাংলাদেশ, ইন্দোনেশিয়া-মালয়শিয়া, আফ্রিকা ও আরবের বিস্তীর্ণ অঞ্চল, পূর্ব ইউরোপের মুসলিম অধ্যুষিত অঞ্চলগুলো ব্রিটিশ কলনিয়াল শক্তির অধীনে একটা দীর্ঘ সময় নিপীড়িত হয়েছে।রাষ্ট্রযন্ত্র করায়ত্ব করে এই অঞ্চলের সম্পদ পশ্চিমে পাচার, অস্ত্রের ভাষায়, জোর-জুলুম-জবরদস্তির মাধ্যমে, পশ্চিমা শিক্ষা ব্যবস্থায় মগজ ধোলাই করে এই সব সমাজগুলোর কাঠামো আমূল বদলে ফেলা হয়েছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে পঞ্চাশের দশক থেকে কলোনিগুলো স্বাধীন হওয়ার পরেও ভেঙ্গে পড়া এই সমাজগুলোকে ঋণের জালে এবং উন্নয়নের ফাঁদে বন্দী করে রাখা হয়েছে। তদুপরি, হাল জমানায় ইউরোপ-আমেরিকার সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে অনন্ত যুদ্ধের নামে ছড়িয়ে দেয়া ইসলামোফোবিয়ার জালে সারা বিশ্বের মুসলমানদের কোণঠাসা করা হয়েছে।এই সময় ইউরো-আমেরিকান সভ্যতার আবিষ্কৃত বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের মধ্যে জীবনরক্ষাকারী চিকিৎসার পাশাপাশি গণহত্যার প্রযুক্তি, পারমানবিক মারণাস্ত্রকে কেউ ভুলে যাবে না।এই পরিস্থিতি উপনিবেশিত সমাজের কেবল ধর্মীয় অনুভূতি নয়, জান-মাল, জীবন-জীবিকা, আত্মপরিচয়, মর্যাদা, আত্মনিয়ন্ত্রণ-গোটা অস্তিত্বের উপরই আঘাত।
বিশ্ব-ইতিহাসের এইসব বৃহদাকায় ঐতিহাসিক সত্যগুলোকে টেবিলে খুলে রেখে আমাদের নিজের ঘরে ভাই হৃদয় মণ্ডলের উপর জুলুম দেখে ব্যথিত ও দুশ্চিন্তিত চিত্তে বাঙ্গালী মুসলমান মধ্যবিত্ত্ব পুরুষকে জানাবোঝার বড়ই আগ্রহ হয়।বাংলাদেশের ভেতর এরা তো নিপীড়িত বর্গ নয়, বরং প্রবল ক্ষমতাশালী অধিপতি গোষ্ঠী।এই প্রবল অধিপতি বর্গ এত সহজেই দুর্বলের দ্বারা আঘাত পায় কিভাবে? আর ভিন্ন ধর্মের সংখ্যালঘু মানুষকে এমন সুপরিকল্পিতভাবে টার্গেট করেই বা কিভাবে? ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতের নামে দেশের নাজুক সংখ্যালঘুর জান-মাল, মান-মর্যাদা, জীবনের নিরাপত্তার ওপর হামলা করলে কি আর ন্যায্যতার দাবী টেকে? জগতের লাঞ্ছিত-বঞ্চিত মুসলমানদের মুক্তির জন্যে ন্যায্যভাবে প্রত্যাঘাত কাকে করবেন? দুর্বলের উপর সবলের অত্যাচারে? হৃদয় মণ্ডলের বিজ্ঞান ক্লাসের আলাপচারিতা আপনার অনুভূতিকে আঘাত করল? আর এই যে অবৈধ অস্ত্রের খেলা চলছে, রোজ দুর্নীতি-গুম-খুন-ধর্ষণ-অর্থপাচার - এত জুলুম-নিপীড়ন সয়ে মানুষ বেঁচে আছে, কই তখন তো ধর্মরাজ্য প্রতিষ্ঠায় কোন জাগ্রত জনতাকে নড়াচড়া করতে দেখা যায় না?
এখন গোড়ার প্রশ্নটা আবার করিঃ বাংলাদেশে বাঙ্গালী মুসলমান কি নিপীড়িত বর্গ, না অধিপতি বর্গ? সংখ্যার বিচারে উত্তর খুঁজলে দেখি, গুরুতরভাবে সংখ্যাগুরু, বাংলাদেশে সাড়ে তের কোটি, অর্থাৎ ৯০.৪% ভাগ মানুষ মুসলমান। অপরদিকে ১ কোটি তিন লাখের মত মানুষ হিন্দু, যা জনসংখ্যার মাত্র ৮.৫% শতাংশ। রাষ্ট্রযন্ত্র, মিলিটারি, জমিজমা, কারবার-ব্যবসা, মিডিয়া সবই তো এই বাঙ্গালী মুসলমান মধ্যবিত্ত্ব পুরুষ কর্তার হাতে। তবে এই কর্তা সময় সময় ভিকটিম কার্ড খেলে ক্যান? বুঝলাম যে, বিশ্ব ব্যবস্থার প্রান্তিক রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ নিশ্চয়ই শোষিত - বিশ্বব্যাংক, আই এমএফের চাপিয়ে দেয়া উন্নয়ন প্রকল্প এবং মার্কিন সাম্রাজ্যবাদী পলিসির শিকার হয়ে চরম মাসুল গুনছে।আবার আঞ্চলিক দিকে ভারতীয় হিন্দুত্ববাদী আগ্রাসনের হুমকিও বড়ই বাস্তব। ঐতিহাসিক বিভিন্ন সময়ে বাঙ্গালী মুসলমান একটি সামাজিক সাংস্কৃতিক বর্গ হিসেবে নিপীড়িত, লাঞ্ছিত, বঞ্চিত হয়েছে। ঐতিহাসিকভাবে এই নিপীড়ন-লাঞ্ছনা-বঞ্চনার প্রতিবাদ, প্রতিরোধও নিরন্তনভাবে হয়েছে, বলতে গেলে বাংলাদেশের জন্মই হয়েছে এই বাঙ্গালী মুসলমান সমাজের বঞ্চনার প্রতিকার করতে গিয়ে। তো ঐতিহাসিক এই বঞ্চনা কে করেছিল? আরেক জাতিগোষ্ঠীর মুসলমানরা ভাই-ব্রাদারই তো? তাই নয় কি? অধিপতি উর্দুভাষী পাকিস্তানী উচ্চবর্গীয় মুসলমান ভাইয়েরাই পূর্বাঞ্চলের ভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর ভিন্ন ভাষাভাষী মুসলমান ভাই-ব্রাদারদের উপর চরম জুলুম-অত্যাচার নামিয়ে দিয়েছিল। বোরহান উদ্দিন খান জাহাঙ্গীরের ভাষায় "অভ্যন্তরীণ উপনিবেশের" শিকার বা ভিকটিম ছিল বাঙ্গালী মুসলমান (কখনই ভুলে যাব না, কারা আড়াই লাখ নারীদের ধর্ষণ করেছিল)।
সাতল্লিশের আগে ব্রিটিশদের অধীনে ঐতিহাসিক শাসন-শোষণের পরিসরে আধুনিক নির্বাচনী রাজনৈতিক চালে মুসলমান হিসেবে সংখ্যালঘু খেলা শুরু হয়।সংখ্যালঘুত্বে ভয় কি পরাক্রমশালী মুঘলদের ছিল? কম করে হিসাব করলেও পাঁচশত বছর ভারত শাসনের জন্যে মুসলমানদের সংখ্যাগুরু হওয়ার প্রয়োজন হয়েছিলো কী? ইউরো-আমেরিকান উপনিবেশ স্থাপিত হয়েছে মাত্র সেইদিনের কথা।শাসনের ইতিহাস দুইশত বছর মাত্র।১৪৯০ এর দশকে ভাস্কো দা গামা আর কলম্বাসের ভারত ও আমেরিকা আবিষ্কারেরও প্রায় তিনশত বছর পরে। এর আগে ভারত ও আমেরিকার ভূস্বর্গে পৃথিবীর অপর প্রান্ত থেকে যাওয়া-আসা, যোগাযোগের বহু নিদর্শন আছে। বাংলায় মুসলমানদের প্রথম আগমন পাওয়া যাচ্ছে ময়মন্সিংহে দ্বাদশ শতাব্দীতে।সুলতানী আমলে বাঙ্গালী মুসলমান বাংলায় শাসক শ্রেণী হিসেবে জীবন যাপন করেছে, যারা আবার দিল্লীর অধীনতা শিকার করেনি।ব্রিটিশদের হাতে ক্ষমতা হারানোর পর থেকেই বাঙ্গালী মুসলমান নিজেকে পুরোপুরি ভিকটিম হিসেবে দেখতে থাকে এবং বহুবার কলোনি ও সাম্রাজ্যবাদবিরোধী ধর্মীয়, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক আন্দোলন গড়ে তুলেছে, যার সর্বশেষ নিদর্শন হল বাংলাদেশ রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা।
এখন এই স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রের অধিপতি শাসক বর্গ হয়ে বাঙ্গালী মুসলমান মধ্যবিত্ত্ব পুরুষ প্রায়শই তাদের অতি নাজুক ধর্মীয় অনুভূতিতে বারে বারে আঘাত পেতে থাকে।ব্যাপারটা কি? এই আশ্চর্যরকম স্ববিরোধী হিসাব কোন অংকেই মেলানো যায় না! বিজ্ঞান শিক্ষার ক্লাসে বিজ্ঞানের বিষয় আলোচনা হলে যদি ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত লাগে, তাইলে তো এর কোন ওষুধ নাই। সমাজ কতটা অধঃপতিত আর বিষাক্ত হলে দশম শ্রেণীর বাচ্চা ছেলেরা পরিকল্পিতভাবে তাদের বিজ্ঞান শিক্ষকের সংখ্যালঘু পরিচয়কে জিম্মি করে ক্লাসের আলোচনা রেকর্ড করে তাঁকে জেলে পাঠানোর ব্যবস্থা করেছে। বাঙ্গালী মুসলমান মধ্যবিত্ত্ব পুরুষের একাংশের ক্ষমতার খেলা দেখে ভয়ে শিউরে উঠতে হয়। শিউরে উঠি ভেবে যে, হিন্দু হয়ে, ভিন্ন ধর্মাবলম্বী হয়ে বাংলাদেশে রোজকার জীবন কি নিঃশঙ্ক চিত্তে যাপন করা সম্ভব?
এই কি তাহলে ইনসাফের রাজত্ব কায়েম করার তরিকা ? মুসলমানেরা তাহলে বিজ্ঞান চর্চা করবে না? পরমত, পরধর্মসহিষ্ণু হবে না? এইভাবে তাহলে শান্তির ধর্ম প্রতিষ্ঠা করবে? লাকুম দি নুকুম ওয়ালিয়া দিন, তাহলে কি বোঝায়? তাহলে কি মুসলমানদের সমাজে বিজ্ঞান পড়ানো অপরাধ বলে গণ্য হবে। মুসলমানদের হাজার বছরের জ্যোতির্বিজ্ঞান, রসায়ন, গণিত, চিকিৎসা বিজ্ঞান চর্চা তাহলে কোথায় কিভাবে গায়েব হয়ে গেলো? তাহলে আল ফারাবি, আল বাতিনি, ইবনে রুশদ, ইবনে সিনা, আল খাওয়া রিজমি, ইবনে কোরা, আল রাজী, আল হাইউন, ইবনে খালদুন, ইবনে বতুতা- এঁরা কারা? এঁদের মত কেউ যদি আজকের বাংলাদেশে জন্মায়, জানে বাঁচতে পারবে তো? মুসলমান পণ্ডিতদের সঙ্গীত আর সাহিত্যের কথা আর নাই বা বল্লাম।
মুন্সীগঞ্জের স্কুলের বাচ্চাদের মত দশম শ্রেণীতে পড়বার সময় স্কুলের পাঠ্য বইয়ে আমরা পড়েছিলাম কবিতা "শিক্ষাগুরুর মর্যাদা", চিরকালের জন্যে মগজে ঢুকে গেছেঃ
বাদশাহ আলমগীর-
কুমারে তাঁহার পড়াইত এক মৌলভী দিল্লীর।
একদা প্রভাতে গিয়া
দেখেন বাদশাহ- শাহজাদা এক পাত্র হস্তে নিয়া
ঢালিতেছে বারি গুরুর চরণে
পুলকিত হৃদে আনত-নয়নে,
শিক্ষক শুধু নিজ হাত দিয়া নিজেরি পায়ের ধুলি
ধুয়ে মুছে সব করিছেন সাফ্ সঞ্চারি অঙ্গুলি।
.....................................................
শিক্ষকে ডাকি বাদশা কহেন, ”শুনুন জনাব তবে,
পুত্র আমার আপনার কাছে সৌজন্য কি কিছু শিখিয়াছে?
বরং শিখেছে বেয়াদবি আর গুরুজনে অবহেলা,
নহিলে সেদিন দেখিলাম যাহা স্বয়ং সকাল বেলা”
শিক্ষক কন-”জাহপানা, আমি বুঝিতে পারিনি হায়,
কি কথা বলিতে আজিকে আমায় ডেকেছেন নিরালায়?”
বাদশাহ্ কহেন, ”সেদিন প্রভাতে দেখিলাম আমি দাঁড়ায়ে তফাতে
নিজ হাতে যবে চরণ আপনি করেন প্রক্ষালন,
পুত্র আমার জল ঢালি শুধু ভিজাইছে ও চরণ।
নিজ হাতখানি আপনার পায়ে বুলাইয়া সযতনে
ধুয়ে দিল না’ক কেন সে চরণ, স্মরি ব্যথা পাই মনে।”
উচ্ছ্বাস ভরে শিক্ষকে আজি দাঁড়ায়ে সগৌরবে
কুর্ণিশ করি বাদশাহে তবে কহেন উচ্চরবে-
”আজ হতে চির-উন্নত হল শিক্ষাগুরুর শির,
সত্যই তুমি মহান উদার বাদশাহ্ আলমগীর।”
- (শিক্ষাগুরুর মর্যাদা – কাজী কাদের নেওয়াজ)
আজকে স্কুলের বাচ্চা ছেলেরাও এতটা নষ্ট হয়ে গেছে দেখে সত্যি ভয়ে বুক কেঁপে ওঠে। এই দেশ আগামীতে ইনসাফ ও জ্ঞানের পীঠস্থান হবে বলে আশা রাখতে বড়ই কষ্ট হয়। সংখ্যালঘুর জীবন-জীবিকা-মান সম্মানকে প্রতিদিন বিপন্ন ও পদদলিত করে এই মুসলমানদের পক্ষে কোন ইনসাফের রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা কি সম্ভব হবে?
সর্বশেষ এডিট : ১১ ই এপ্রিল, ২০২২ রাত ৯:২০