মঙ্গল শোভাযাত্রা থেকে যদি মুদ্রাস্ফীতি, অর্থ পাচার, ক্রসফায়ার, গুমখুন, ধর্ষণ, গণতন্ত্রকে স্থবির করে রাখা, বৈশ্বিক ও আঞ্চলিক নিয়ন্ত্রণের অধীনতার চরম অমঙ্গল নিয়ে আর্ট, আর্টিফ্যাক্ট বহন করে প্রতিরোধী মিছিল হত, তাহলে শহুরে নাগরিকেরা হয়তো দেশের সর্বসাধারণের মঙ্গলচিন্তায় সামিল হতে পারতেন। কৃষক-শ্রমিক-আদিবাসী-নারী-উদ্বাস্তু-সর্বহারার চৈতন্যের সাংস্কৃতিক প্রকাশ যদি ধারণ করতো, সেই শিল্প-সাহিত্য- সংস্কৃতির চিহ্ন যদি ধারণ করতো, তবেই তা হত সার্বজনীন উৎসব। এখন এই শোভা, এই যাত্রা, এই মঙ্গলের মধ্যে সর্বসাধারণ কোথায়?
সুশীল সাংস্কৃতিক গণবিচ্ছিন্নতা কিছুটা ঘুচাতে পারতো, যদি অন্তত আইসিইউ তে পাঠিয়ে দেয়া নিষ্প্রাণ গণতন্ত্রের প্রাণ প্রতিষ্ঠা নিয়ে দুইটা মুখোশ বানাইত। তার ধারে কাছেও না হাঁটাতে এই শোভাযাত্রা কেবল স্ট্যাটাস কো কেই জারী রাখবার সাংস্কৃতিক হাতিয়ার ছাড়া কিছুই হতে পারল না। সাম্রদায়িক পিশাচ ছাড়াও অনেক বড় বড় অমঙ্গলের কুশীলবদের গায়েব করে ফেলা হয়েছে। সুশীল জাতীয়তাবাদী সেকুলারদের পরাকাষ্ঠা এই এক্সপ্রেশন বর্তমান রেজিমের সাথে গাঁটছড়া বাঁধা। ফলে স্বৈরশাসন, জুলুম, নিপীড়নের বিরুদ্ধে গণমানুষের প্রতিরোধী চৈতন্যের প্রতিনিধিত্ব করবার শক্তি, সাহস, যোগ্যতা কোনটাই নেই চারুকলার শোভাযাত্রার।
কিন্তু এই মঙ্গল শোভাযাত্রাকে গোটা জাতির সাংস্কৃতিক এক্সপ্রেশন হিসেবে দেখাবারই বা দরকার কি? দেশের একটা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটা বিভাগ যেভাবে ইন্টারপ্রেট করেছে, এটা তারই বহিঃপ্রকাশ মাত্র। আবার তাই বলে একে বন্ধ করবার পায়তারাটাও তো শুভ নয়। চারুকলার শোভাযাত্রা সমালোচনা করতে পারেন, তাই বলে পহেলা বৈশাখ, নববর্ষকেই অস্বীকার করে বসবেন, সেটাও তো ফ্যাসিবাদী চিন্তা। আপনার নতুন বছরকে যেভাবে প্রকাশ করবার খায়েস, সেভাবে করুন! চারুকলার শোভাযাত্রা স্পষ্টতই একটা ইনভেন্টেড ট্র্যাডিশন। ট্র্যাডিশন তো কখনও না কখনও কেউ না কেউ ইনভেন্টই করেছে। সেটাকে সেই ঐতিহাসিক প্রেক্ষিতে দেখেন, পাঠ করেন, অংশগ্রহণ করেন নিজ নিজ বুঝ মত। আর না হলে অংশগ্রহণ কইরেন না। ল্যাঠা চুকে যায়।
ইনভেন্টেড হইলেই কি ইনভ্যালিড হয়ে যাবে নাকি? কল্পনা থেকেই তো সব কিছুর সৃষ্টি। যেমন, জাতি হচ্ছে একটা কল্পিত সম্প্রদায়। আধুনিক জাতি একটা যৌথ কল্পনা। একটা আবিষ্কার। "চিরকাল", "শাশ্বতকাল ধরে", "হাজার বছর ধরে" কোন জাতি একই রকমভাবে চলে এসেছে, এটা নিতান্তই জাতীয়তাবাদী সাহিত্যিকদের কল্পনা। "বাঙালি জাতির ইতিহাস" (ধরা যাক নীহার রঞ্জন রায় ) জাতীয় গ্রন্থগুলোও এক ধরনের প্রিমরডিয়াল ফ্রেমওয়ার্কে জাতির ইতিহাস লিখেছে, আর এই ধরনের ভাবনা বাঙালি জাতীয়তাবাদী বলয়ে কমনসেন্সে পরিণত হয়েছে। সুশীল সাহিত্য ও সংস্কৃতিতে এমনভাবে আত্মীকৃত হয়েছে যে এর বাইরে কিছু ভাবা অথবা ভিন্ন বয়ানকে গ্রহণযোগ্য করে তোলা প্রায় অসম্ভব মনে হয়। আধুনিক জাতীয়তাবাদের বিকাশ মোটেই হাজার বছরের ঘটনা নয়। আধুনিক জাতিরাষ্ট্রগুলো পুরানো সাম্রাজ্যগুলোর পতনের মধ্য দিয়ে আবির্ভূত হয়েছে মাত্র কয়েকশ বছর। এই জাতিরাষ্ট্রগুলো যে আচার-অনুষ্ঠান, ঐতিহ্যকে হাজার বছর বলে পরিবেশন করে আসছে, আর আধুনিক রাষ্ট্রের নাগরিকেরা যে উৎসব- অনুষ্ঠানগুলো জাতির উদযাপন হিসেবে পালন করে আসছে, সেসব আসলে কৃষক সমাজের উৎসবগুলোর এক ধরনের বাছাইকৃত নাগরিক আত্তীকরণ। রমনার বটমূলের পহেলা বৈশাখ, চারুকলার মঙ্গলশোভা অথবা আনন্দ শোভাযাত্রা সেই নাগরিক আত্তীকরণ ছাড়া আর কিছু নয়। এই প্রসঙ্গে চমৎকার ব্যাখ্যা দিয়েছেন নরওয়েজিয়ান সাংস্কৃতিক নৃবিজ্ঞানী থমাস হাইল্যান্ড এরিক্সেন। জাতি পরিচয় গড়ে তোলার সময় কিভাবে তখনকার জাতির আধুনিক শিক্ষিত মধ্যবিত্ত সমাজ নরওয়ের গ্রামীণ জীবনের বিভিন্ন অনুষঙ্গ, আচার-অনুষ্ঠানকে নতুন করে নাগরিকদের জন্যে পরিবেশন করে এবং জাতীয় সংস্কৃতি বলে আকার আকৃতি দেয়, সেটা দেখান। ব্রিটিশ ইতিহাসবিদ এরিক হবসবম এবং টেরেস রেঞ্জার ইনভেনশন অব ট্র্যাডিশনের কথা বলেছেন যে, যাকে আমরা যুগ যুগ থেকে চলে আসা বলে ভেবে আসছি, তা আসলে নতুন করে আবিষ্কার করা জিনিস। শাহবাগ-ধানমণ্ডি এলাকায় যে নাগরিক বর্ষবরণ তা স্পষ্টতই একটা বিশেষ সময়, ষাটের দশকে পাকিস্তান বিরোধী আন্দোলনের সাংস্কৃতিক আত্মপ্রকাশ হিসেবে ব্যাপকভাবে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। বাঙালি জাতিসত্তার পরিচয় বাহক হিসেবে প্রচারিত হয়েছে। যা আজকের অনির্বাচিত স্বদেশীয় স্বৈরশাসনকালীন অমঙ্গলকর রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক চর্চাগুলোকে অ্যাড্রেস করতে ব্যর্থ হয়ে প্রায় অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়েছে।
তাই বলে আমাদের জীবনে নববর্ষ আসবে না, জীর্ণ জীবনের গ্লানিকে উড়িয়ে দিয়ে আমরা মঙ্গল ও কল্যাণকে আবাহন করে নেব না, তা কখনও মেনে নেব না। আমরা নিশ্চয়ই ব্যর্থ প্রাণের আবর্জনা জ্বালিয়ে দিয়ে নতুন জীবনের আগুন জ্বেলে নেব।
সর্বশেষ এডিট : ১৫ ই এপ্রিল, ২০২৩ সকাল ৯:৩০