যদি আমরা বলি নারীবাদী বুলি দিয়ে আওয়ামী ফ্যাসিবাদী রেজিমকে বৈধতা দেয়া হয়েছিলো, তাহলে কি ভুল হবে?
শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের উত্তাল সময়ে রেহনুমা আহমেদের হাতে একটা প্ল্যাকার্ডে লেখা ছিল, "শেখ হাসিনা তার ফ্যাসিবাদী রেজিমকে ক্যামোফ্লেজ করবার জন্যে নারীদের উন্নয়নের কার্ড ব্যবহার করেছে", সায়দিয়া গুলরুখের প্ল্যাকার্ডে লেখা ছিল, "শেখ হাসিনা তার ফ্যাসিবাদী রেজিমকে বৈধতা দেয়ার জন্যে প্রগতিশীল বনাম হিজাবি বাইনারি ব্যবহার করছে"। এ সময় জঙ্গিবাদ, ইসলামী চরমপন্থার উত্থান, জামাত-শিবিরের রাষ্ট্র ক্ষমতায় আসার সম্ভাবনা নিয়ে আগাগোড়া এক ভয় ছড়িয়ে দেয়া হয়, যেখান থেকে বিকল্প দেখতে পাওয়া অসম্ভব হয়ে পড়ে। পশ্চিমা সভ্যতা তার সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে অনন্ত যুদ্ধে আমাদের পেরিফেরিতে থাকা সমাজকেও তার নিজের আতংক দিয়ে আবিষ্ট করে ফেলে। পশ্চিমের এবং হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির অস্ত্র ইসলামোফোবিয়াকে এমনভাবে আত্মস্থ করে যে, খোদ ইস্টার্ন ফ্রন্টিয়ারে ৮০০ বছর ধরে কায়েমরত ইসলামী সংস্কৃতির বাহন আরবী হরফের ক্যালিগ্রাফিকে নিজের সংস্কৃতি ভাবা যায় না,"অপর" বলে প্রতীয়মান হয়, অথচ মাত্র দুইশ বছর আগে শেখা প্রভুর ভাষা ইংরেজি হতে পারে আত্মপ্রকাশের "স্বাভাবিক" বাহন।নারীর শত্রু যেন নিজেরই ধর্মবিশ্বাস।
নিজের দেশের সশস্ত্র বাহিনীর নিজের বেসামরিক নাগরিকের উপর অস্ত্র তাক করা, ২০০ তরুণের হত্যা, হাজার হাজার তরুণের অঙ্গহানি, জেল-জুলুম, ক্রস ফায়ার, গুমখুন, আয়নাঘর, গণকবর, গণ রুম, পিয়নের ৪০০ কোটির মালিক হওয়া, আইজির হাজার একর জমির মালিক হওয়া - একের পর এক ৩০ টা বিসিএস পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁস করে শত শত কোটির মাকিল হওয়া, ব্যাংক লুট, ট্রেজারি লুট, শেয়ার বাজার লুটপাট - কোন কিছুই ইসলামোফোবিয়ার চাইতে বড় আতংক সৃষ্টি করতে পারে না।পশ্চিমের সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে অনন্ত লড়াইয়ের বয়ানকে দেশী ভার্সনে জঙ্গী-শিবির জুজুর ভয় এক শ্রেণীর শিক্ষিত পেশাজীবী নারীদের মধ্যে গেঁথে দেয়া হয়েছে।যেন দেশী বাদামী চামড়ার মুসলমান পুরুষদের হাত থেকে নারীদের উদ্ধার করতে আওয়ামী শাসনের কোন বিকল্প আগেও ছিল না, এখনও নাই।সঞ্জীব ওয়াজেদ জয়ের সাক্ষাৎকারেও একই প্রতিধ্বনি শোনা গেল যে, বাংলাদেশ নাকি তার মায়ের পলায়নের ফলে আফগানিস্তান-পাকিস্তানের মত নৈরাজ্যভূমি হতে চলেছে।
সদ্য উৎখাত হওয়া এই রাষ্ট্রে নাগরিক হিসাবে নারীদের অবস্থা কেমন ছিল?
এক বছরে ধর্ষণ ও গণধর্ষণের সংখ্যা ১৪১৩ (২০১৯)। ধর্ষণের সংস্কৃতির বিরুদ্ধে ক্রমাগত আমাদের আওয়াজ তুলতে হয়েছে।ঘরেবাইরে, বাসে-ট্রেনে, একটা শেষ হতে না হতেই আরেকটা নৃশংস ধর্ষণের ঘটনায় আমাদের চমকে উঠতে হয়েছে।গেল বছরেই দেখা গেছে বিশ্ববিদ্যালয়ে যৌন নিপীড়নের শিকার ৯০% নারী অভিযোগই করতে পারে না এই জন্যে যে সাধারনত অভিযুক্ত ব্যক্তিরা প্রভাবশালী ক্ষমতাসীন দলের হওয়ার ফলে বিচার পাওয়ার সম্ভাবনা থাকে না।২০২০ এর প্রথম নয় মাসে স্বামী বা স্বামীর পরিবারের হাতে খুন হয়েছে অন্তত ২৩৫ জন নারী, তার আগের উনিশ বছরে ৩৩০০ জন। চৌদ্দ বছরে প্রায় ৪০০ জন গৃহকর্মী নিহত হয়েছে। পত্রিকার খবরের উপর ভিত্তি করে প্রস্তুত শুধুই মৃত্যুর হিসাব এগুলো। হত্যা ব্যতীত অন্য যে কোন মাত্রার ডোমেস্টিক ভায়োলেন্স ও গৃহকর্মী নির্যাতনের সঠিক পরিসংখ্যান অনুমান করাও হয়ত সম্ভব না! কিছুদিন আগেও অভিনেত্রী/মডেল নারীদের "রাতের রানী" অভিধা দিয়ে ক্ষমতা ও পদের অধিকারীদের বিপুল দুর্নীতিকে আড়াল করবার অপচেষ্টা করা হয়েছিল।বছর দুই আগে রেহনুমা আহমেদ "পৌরুষ, শাসক শ্রেণী ও রাষ্ট্রের ধরন" শীর্ষক একটি আলোচনায় (২০২২)বাংলাদেশের মাফিয়া রাষ্ট্র হয়ে ওঠার একটি অপরিহার্য উপাদান হিসাবে ক্ষমতার অধিকারী সহিংস পৌরুষ নির্মাণকে চিহ্নিত করে ছিলেন।
আওয়ামী রেজিম একদিকে জাতিসংঘ ও উন্নয়ন সংস্থা সমুহের নারীদের উন্নয়নের ইনডেক্সে উন্নতি দেখিয়েছে, আবার অপর দিকে গার্মেন্টস শ্রমিকদের বেতন বৃদ্ধির আন্দোলনকে ভয়ভীতি ও ডাণ্ডা দিতে ঠাণ্ডা করেছে।বিভিন্ন ক্ষমতার অধিকারী বড় বড় পদে নারীদের উল্লেখযোগ্য সংখ্যায় নিয়োগ দিয়ে একদিকে একটা দৃশ্যমান ক্ষমতায়নকে জারী রেখেছেঃ নারী প্রধানমন্ত্রী, নারী মন্ত্রী, নারী স্পিকার, নারী উপাচার্য, নারী ট্রেজারার, পিএসসির প্রধান, বিজেএমইর সভাপতি - এমন সব ক্ষমতার পদে নারীদের অধিষ্ঠিত করেছে, আবার অন্যদিকে আনভির সোবহানদের মত ক্ষমতাধর ব্যবসায়ীদের একের পড় এক ধর্ষণ ও হত্যা মামলা থেকে ছাড় দিয়েছে।বিপুল সংখ্যক নতুন গরীব, ভূমিহীন নিঃস্ব নারীদের সাথে কতিপয়তন্ত্রের সুবিধাভোগী, বিপুল ক্ষমতার অধিকারী নারীদের সাথে আকাশ-পাতাল ব্যবধান!
তাই নারীর উন্নয়ন বা ক্ষমতায়ন ছিল ঠিক মেগা উন্নয়নের মতই কসমেটিক। নারী-পুরুষের মধ্যকার বিদ্যমান বৈষম্য যে কাঠামোগত, নিও-লিবারেল মডেলের এই উন্নয়নের ধারায় সেটা আড়াল করা সম্ভব হয়েছে।যেন নারীবাদ মানে বিশেষ রকমের পোশাক, বিশেষ কোন লাইফস্টাইল, যেখানে পর্দা বা হিজাবের বিরুদ্ধে রয়েছে নিন্দাবাদ, এমন কি খোলাখুলি বিদ্বেষ।বিশ্বাসী ও প্র্যাকটিসিং মুসলিম নারীদের টার্গেট করা হয়েছে পশ্চাদপদ হিসাবে, এবং অগ্রগতির অর্থ করা হয়েছে বিশেষ ধরনের পোশাক ও লাইফ স্টাইলের মধ্যে।কৃষক-শ্রমিক, আদিবাসী, শিক্ষার্থী, চাকুরীজীবী, গৃহিণী - সকল শ্রেণী পেশার নারীদের জন্যে সম্পদ, জীবন-জীবিকার সুষম বণ্টণের প্রশ্নটি উত্থাপন করাও কঠিন হয়ে পড়েছে।পার্বত্য চট্টগ্রামের সামরিক শাসন নিয়ে কোন আলাপই তোলা যায় নাই।
আওয়ামী ফ্যাসিবাদী রেজিম ১৫ বছরের মত সুদীর্ঘ একটা সময় যে টিকে থাকতে পেরেছিল, তার পুরো কৃতিত্বই আওয়ামী লীগকে দেয়া ঠিক নয়। ২০০৯ সালের নির্বাচনে ভূমিধ্বস জয় নিয়ে গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত একটি সরকারের এই পরিণতির জন্যে জনসমাজের মধ্যকার বহুশক্তির সম্মিলিত অবদান আছে, যারা নিজেদের সেকুলার গণতন্ত্রের ধ্বজাধারী বলে প্রচার করে থাকেন। এঁদের ক্রমাগত প্রচার ও প্রোপাগান্ডা ছাড়া আওয়ামী সরকারের বৈধতা, এই সরকারের পক্ষে জনমত ও সম্মতি গঠন করা সম্ভব হত না। লেখক, সাহিত্যিক, শিল্পী, বুদ্ধিজীবী, সাংবাদিক, মিডিয়ার একটা বড় অংশ তথাকথিত সেকুলার গণতন্ত্র এবং হেজিমনিক বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদের এসেনশিয়াল বয়ান গঠনের মাধ্যমে নব্বইয়ের গণঅভুত্থ্যানের মধ্য দিয়ে অর্জিত একটা অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনভিত্তিক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে ফ্যাসিবাদে পর্যবসিত হওয়ার জন্যে মসৃণ পীচ ঢালা পথ তৈরি করেছে।এই সেকু গোষ্ঠীর বয়ানকে ভাঙার জন্যে আলাপ-সালাপ যে হয় নাই তা নয়। কিন্তু ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট দিয়ে সেই সব কণ্ঠকে রোধ করা হয়েছে। আওয়ামী ফ্যাসিবাদী কতিপয়তন্ত্র নারীদের ক্ষমতায়নের বুলিকে নিজের ক্ষমতার বৈধতা সৃষ্টির জন্যে সার্থকভাবে ব্যাবহার করতে পেরেছিল।এই রেজিম ক্ষমতার ভাগীদার রূপে এক শ্রেণীর সহযোগী ক্ষমতাভোগীনারীদেরও তাদের ক্রাইম পার্টনারে পরিণত করতে সক্ষম হয়েছিলো।
নারীদের চূড়ান্ত আত্মবিকাশের প্রথম ধাপ ইনসাফ
শিক্ষার্থীদের ভয়ংকর সাহস, ক্ষুরধার বুদ্ধিমত্তা, অব্যর্থ যুদ্ধকৌশল এবং চরম আত্মত্যাগের দৃশ্য যখন সারা দুনিয়ার বাংলাদেশীদের প্রায় হিপনোটাইজ করে ফেলেছে, বিদ্যুৎ গতিতে সারা দেশ থেকে গ্রাম-গঞ্জ, মফঃস্বল, শহর-বন্দর, মসজিদ-মাদ্রাসা, আস্তিক-নাস্তিক, ডান-বাম, মধ্যপন্থী জনসাধারণকে দ্রুততম সময়ে ঐক্যবদ্ধ করে ঐতিহাসিক ৫ ই অগাস্টে ঢাকা চল লং মার্চে লক্ষ লক্ষ মানুষকে সমবেত করে গণভবন দখল করে ফেলে, পেছনের দরজা দিয়ে হাসিনার লজ্জাজনক পলায়ন ঘটে তখন থেকেই রাষ্ট্র সংস্কার ও মেরামতের নতুন ভোর থেকেই অনেক তথাকথিত নারীবাদী বন্ধুরা কু ডাক দিচ্ছিলেনঃ "দেশ জামাত-শিবিরের হাতে চলে যাচ্ছে", "শরিয়া রাষ্ট্র গঠনের দিকে যেতে পারে", "নারীদের বোরখা পরিয়ে ঘর বন্দী করা হবে" "অপেক্ষা করেন, এবার আসল খেলা শুরু হবে" "জামাত-বিএনপি ক্ষমতা দখল করে ফেলবে" "হিজাব বের করেন আপা" "এই জন্যে কি এতগুলো বাচ্চা প্রাণ দিল?"- এইসব প্যারানয়েড ইসলামোফোবিক বাৎচিতগুলো যে ফ্যাসিবাদের বৈধতা তৈরি করে, তা এবারে মুখ খুলে বলবার সময় এসেছে।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের এমন গঠন আমরা প্রত্যাশা করি, যা পুরুষতন্ত্র ও আধিপত্যকে ব্যবস্থা হিসাবে চুরমার করে দিয়ে নারী ও পুরুষের সাম্যের ভিত্তিতে নতুন রাষ্ট্র ও সমাজ গড়ে তোলার কাজে নিয়োজিত হবে।পশ্চিমা মডেল বা হিন্দুত্ববাদী মডেলকে ডিকলোনাইজ করে ইনসাফভিত্তিক আমাদের নিজস্ব ধাঁচের একটি মডেল পৃথিবীর বুকে প্রতিষ্ঠা করা করবে যেখানে মুসলিম, হিন্দু, খ্রিস্টান, বিভিন্ন আদিবাসী ধর্মীয় অনুশাসনের অধীন সকল শ্রেণী, পেশার নারীরা দেশের সম্পদে ও সুযোগে সমান স্বত্বাধিকার লাভ করে আত্মবিকাশের চূড়ায় পৌঁছাতে পারে।
#SecondIndependenceBangladesh
#BANGLADESHWOMEN
#secondindependencebangladesh
#সায়েমারলেখা

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।


