প্রথম পর্ব
প্রতিটা দিন সারা দিনের কাজের ঝামেলার পর রাত ১১ টায় আবুল মিয়া তার কালো রঙ এর নকিয়া ফোনটি হাতের কাছে নিয়ে অপেক্ষায় থাকে।
অপেক্ষাটা একটা মিসড কলের। মিসড কলটি আসে হাজার মাইল দূরের বাংলাদেশে থেকে। সারা দিনের ব্যস্ততা শেষে গিন্নী কল দেয়। এই সময়টি তার কাছে অনেক সুন্দর আর আনন্দময় একটি সময়।
বেশীর ভাগ কথাই হয় নানান অভাব, অভিযোগ আর অনুযোগের। সে ভালো ভালো কথা শুনতে চায়। তারপরও তাকে শুনতে হয় এই নেই, সেই নেই। ছেলের অসুখ। বাজারে বাকি। মায়ের অসুখ। এই সব শুনতে খুব বেশী ভালো না লাগলেও প্রিয় মানুষটিন কণ্ঠ শুনতে খুব ভালো লাগে আবুল মিয়ার।
এই সময় তার ফোনেটি সে ব্যস্ত রাখতে চায় না। নিজে ব্যস্ত থাকতে চায় না। কেননা, এই সময় সখিনা বেগম বাংলাদেশ থেকে তাকে মিস কল দেয়। প্রতি দিনই তার মিস কলের অপেক্ষায় থাকে আবুল মিয়া। প্রবাসের একাকীত্বের মাঝে এই ফোন কলটি তাকে অজানা এক আনন্দে শিহরিত করে।
আবুল মিয়া মালয়েশিয়াতে আছে আজ প্রায় ১১ বছর । এর মধ্যে সে এক বার মাত্র দেশে গিয়েছিল।
আবুল মিয়ার দেশের বাড়ি ঝিকরগাছা। তার প্রিয় গ্রাম। অথচ কত দিন সেখানে সে যায় না। তার মন পড়ে থাকে ঝিকর গাছার মাঠে। পুকুরের পাড়ে।
দেশের জন্য তার মন কাদে। মন কাদলে কি হবে । দেশে তো থাকার জো নেই। এতো এতো মানুষের ভিড়ে দেশে একটি কাজ পায়নি সে। শেষ মেষ চলে এসেছে মালয়েশিয়াতে।
মালয়েশিয়া দেশটি সুন্দর। তবে ঝিকরগাছার চেয়ে সুন্দর নয়। এখানে অনেক পাহাড় পর্বত। আর প্রচুর গাছ পালা। তার নিজের দেশে কোন পাহাড় পর্বত সে দেখেনি। কিন্তু শুনেছে বাংলাদেশেও অনেক পাহাড় পবর্ত আছে। তার খুব ইচ্ছে ছিল দেশের পাহাড় দেখার। পাহাড়ের উপরে উঠলে নাকি অনেক দূর পর্যন্ত দেখা যায়। তার খুব ইচ্ছে ছিল দেখার।
ছোট বেলায় বাবা মারা যাবার পর পড়াশোনাই তো হলো না। সংসারের প্রয়োজনে রোজগারে নামতে হলো। দেশে কুলাতে না পেরে অনেক আয়ের আশায় চলে এলো মালয়েশিয়া। অজানা অচেনা দেশ। মানুষ জন অচেনা। থাকতে থাকতে এক সময় সে মালয়েশিয়ার ভাষাও শিখে গেল। বন্ধুকে সে এখন বলে- কাবান। বলে- কাবান, তুমি কেমন আছ? কিংবা, আবাং আমাকে একটু তলং করেন। তার প্রতি দিনের কথা এখন এক মিশ্র ভাষায় পরিণত হয়েছে। মিশ্র ভাষা ছাড়া এখন সে আর বাংলায় কথা বলতে পারে না।
তার একটি ভালো গুণ আছে। কারো কাছ থেকে তলং পেলে সে ধন্যবাদ দেয়। বাংলাদেশে তার এলাকায় সে কখনো ধন্যবাদ দিতে শুনেনি। মালয়েশিয়ার মানুষ জন প্রচুর ধন্যবাদ দেয়। সে যেই দোকানে কাজ করে সেই দোকানে ক্রেতারা টাকা দিলে তার পণ্য পলিথিন ব্যাগে ভরে দিয়ে সে আর সবার মতোই বলে- তেরিমা কাসিহ।
তার মনে আছে জীবনে প্রথম ঢাকায় যাওয়া। ঢাকার তেমন কিছু দেখা হয়নি তার। বাসে করে যশোহর থেকে ঢাকায়। সেখান থেকে
বিমানে করে মালয়েশিয়া। তারপর কখন যে ১০ টি বছর কেটে গেছে খেয়ালই করেনি আবুল মিয়া।
**************************************************************
ঘড়ির কাটায় যখন রাত সোয়া এগারোটা বাজে তখন তার মোবাইল বেজে উঠলো। বাংলাদেশ থেকে কল। এই কল ধরা যাবে না। ধরলে প্রচুর টাকা কাটবে অন্য পাশে। বাংলাদেশ থেকে মালয়েশিয়াতে কল দিলে সে কল ধরে না। টাকা তোর তারই। যে পাশ থেকেই কাটুক না কেন। তার চেয়ে তার পাশে থেকেই টাকা কাটুক।
এখানকার সিস্টেম ভালো লাগে আবুল মিয়ার। খুব কম খরচে দেশে কল করা যায়। কথাও খুব আরাম করে বলা যায়। আজ কাল আবার ইমু নামের এক জিনিস চালু হয়েছে। তবে তার জন্য দামী মোবাইল লাগে। আবুল মিয়া টাকা জমাচ্ছে। টাকা জমলে সে এক টা ইমু অলা মোবাইল ফোন কিনবে। অনেকেই কিনেছে।
তবে এই ইমুর অসুবিধা্ও আছে। অপর পাশেও ইমুঅলা ফোন থাকতে হবে। আর থাকতে হবে ইন্টারনেট। তার জন্য বাড়তি খরচ আছে।
আজকাল টাকা জমানো খুব কঠিন।
বছরে একবার চপ লাগাতে হয় পাসপোর্টে । তাতে প্রায় ৩ হাজার রিঙ্গিত খরচ। এই টাকা না জোগাড় করতে পারলে বিরাট সমস্যা।
কলটি এলো। শেষ পর্যন্ত সত্যি সত্যি কল এলো। বউএর কল পেতে তার খুব ভালো লাগে।
তবে বেশীর ভাগ কথাই হয় সাংসারিক। আবেগ বিহীন কথা। তারপরও শুনতে ভালো লাগে।
(চলবে)
সর্বশেষ এডিট : ০৬ ই জানুয়ারি, ২০১৯ দুপুর ২:১৭