রোজ রোজ একই রকম লতাপাতা, শাক আর কচু ঘেচু দিয়ে ভাত খেতে মন চায় না আয়না বিবির। গলা দিয়ে যেন ভাত নামতে চায় না। এক লোকমা ভাতের সাথে অনেক খানি পানি খেতে হয় ঢক ঢক করে। ভাত কেন যেন পেটের ভেতর যেতে চায় না। শেষ পর্যন্ত ভাত পেটের ভেতর গেলেও সব কিছু খালি খালি লাগে। পেট ভরে না। অতৃপ্তি রয়ে যায়। মনে হয় কত দিন ধরে না খেয়ে আছে। রাতে ঘুম আসে না। ক্ষুধার জ্বালা যেন রয়েই যায়। বার বার হা পিত্যেশ করে সময় কাটে।
কোন রকমে পেটে ভাত চালান করে দিতে পারলেও তৃপ্তি পায়না বুড়ি। আগে এই কষ্টটা ছিল না তার। মরিচ, পেয়াজ যা পেত সবই ভাতের সাথে মেখে খেয়ে নিত গপগপ করে। খেতে খুব একটা খারাপ লাগতো তার। তার বয়স বাড়ার সাথে সাথে জিহ্বা যেন রুচি পাল্টিয়ে ফেরেছে। গরীব মানুষের খাবার যেন তার কাছে আর সমাদর পায় না। খালি মাছ মাংস খেতে মন চায় ।
অনেক দিন ধরে ইলিশ মাছ খেতে মন চাইছে আয়না বুড়ির। প্রায়ই মনে মনে ভাবে- আহা, যদি এক টুকরো ইলিশ মাছ ভাতের থালার এক কোনে রাখতে পারত তাহলে সেই সুবাসেই সে পুরো থালা ভাত খেয়ে নিতে পারতো।
ছেলের সংসারে সে বোঝা হয়ে আছে। এটা সে খুব ভালো ভাবেই বুঝে। তাই কখনো কোন কিছু খেতে মন চাইলে আজকাল আর বলতে মন চায় না। এমন তো না যে ছেলে তার তালেবর। বিরাট তালুক আছে। সংসারের চার জনের মুখের আহার জোটাতেই সে হয়রান। তার উপরে সে তো এক রবাহুত। তার মুখের মাছ মাংস জোটানোর জন্য কাউকে কষ্ট দিতে চায় না সে।
অনেক রাতে পাতলা ঘুম ভেঙ্গে গেলে ব্যাপারীর কথা খুব মনে পড়ে। পাশের বাড়ির রহমানকে নিয়ে পদ্মায় মাছ ধরতে যেত মানুষটা। বিকেলে নৌকা সাজিয়ে নিয়ে বের হয়ে যেত। রাতের খাবারও নিয়ে যেত। সকালে আলো ফুটতে না ফুটতে নৌকা নিয়ে এসে হাজির হতো তারা। বাগিতে এসেই হাক দিত –কইরে বদরুল জলদি আয় । দেইখা যা।
বদরুল তখনো ঘুমে। এতো সকালে তার ঘুম ভাঙ্গে না। তবু বাবার হাক ডাক আর মায়ের চিৎকারে সে উঠে পড়তো। তার বাপে নাও ভর্তি করে ইলিশ মাছ ধরে নিয়ে এসেছে। কত মাছ । যেন পদ্মার সব মাছই নিয়ে এসেছে। এতো মাছ কে খাবে? বড় বড় ২/৩ টা মাছ রেখে বাকি মাছ নিয়ে তারা চলে যেত দেবী নগর হাটে। সেই মাছ বিক্রি করে ঝাৎপি ভর্তি বাজার করে বাড়িতে ফিরতো। সপ্তাহের সেই দিনটি তার কাছে মনে হতো ঈদের দিন। এতো খুশী লাগতো তার। সে মাছ কেটে নিয়ে কয়েক পদের রান্না করতো। সব চেয়ে ভালো লাগতো ইলিশ ভাজা। কড়াইয়ের তেলে ইলিশ দিলে যে ঘ্রাণ বের হতো সেই ঘৃাণ ১০ বাড়ির পর থেকেও টের পেত সবাই। ভাতের সাথে সেই মাছ ভাজা মুখে দিলে মনে হতো বেহেশতী খাবার খাচ্ছি।
বদরুল তখন চুলোর পার থেকে সরতেই চাইতো না। আধা ভাজা মাছ তুলে না দিলে সেই কান্না জুড়ে দিত। আয়না বিবি বলতো- একটু তো ধৈর্য ধরবি বাজান। মাছ ভাজতেও তো সময় দেওন লাগে। ছেলেটা কোন অপেক্ষাই করতে চাইতো না।
ছেলের বউকে বলতে সাহস পায় না। যদি আবার রেগে যায়। আকামের মানুষ। তাকে খেতে দিচ্ছে এটাই বা কম কিসে। তারপর আবার ইলিশ মাছ। তবে সাহস করে একবার বদরুলকে বলে দেখা যেতে পারে। মায়ের এই সামান্য আব্দার কি সে রাখবে না।
আয়না বিবির মনে আজ একটি কথা জাগে। সকালে একবার বলবে বদরুলকে। কত দিন একটুকরা ইলিশ মাছ খায়না। পরানডা কান্দে। বলেই দেখবে। ছেলে যদি কোন উপায় করে। বলা তো যায় না।
বদরুল তার এক মাত্র ছেলে। জয়পাড়া বাজারে রিক্সা চালায়। উপজেলা সদরে আর তেমন রুজি রোজগার নেই। আজকাল কেউ আর মানুষ চালিত রিক্সায় উঠতে চায় না। ব্যাটারী লাগানো কলের রিক্সা এসে গেছে। সেই রিক্সা যেন ঘোড়ার বেগে দেৌড়ে চলে। তিন চারজন এক সাথে চড়ে। ভাড়াও হয় কম। তাই তার মতো রিক্সাচালকদের কাজ কমে গেছে।
তবে বিলাসী আর আয়েশী লোক এখনো প্রচুর আছে। তারা ভাগের ব্যাটারী চালিত গাড়ীতে উঠতে চায় না। একা একটা রিক্সা নেয়া দরকার। এতে মান সম্মানের বিষয় জড়িত। একটা রিক্সায় যদি একাই না উঠতে পারলো তাহলে আর ইজ্জত থাকে কই। টাকার চেয়ে ইজ্জত অনেক বড়। এই সব ইজ্জতী মানুষ জন এখনো আছে বলেই না তার মতো রিক্সা চালকরা এখনো কোন রকমে খেয়ে পড়ে বেঁচে আছে।
বুড়ি ঠিক করেছিল- কখনোই বলবেই না ছেলেকে।
কিন্তু সন্ধ্যা বেলায় ছেলে খুব হাসি হাসি মুখ নিয়ে বাড়ি ফিরলো। দেখে তার মন ভালো হয়ে গেল। তাই সে মনে করলো এক বার বলেই দেখি না।
- একটু ভালো মন্দ খাইতে মন চায় রে বাপ। কয় দিনই আর বাঁচুম ক তো বাজান।
বদরুল খুব আগ্রহ নিয়ে মায়ের দিকে তাকায়। অনেক দিন কোন আব্দার করে না মা। হঠাৎ করে মায়ের কথা শুনে তার মন প্রাণ আকুল হয়ে উঠলো।
কি খাইতে মন চায় মা। তুমি কও আমারে।আমি কালই কিনা আনমু।
মনডা খুব ইলশা মাছ খাইতে মন চায়। কোন রকমে একটু মাছ অইলেই অইবো। আমি বাসনা দিয়াই ভাত খাইতে পারুম। আইচ্ছা, ইলিশা মাছ কি আইজ কাইল আর উডে না বাজারে?
-ঠিক আছে মা। আমি দেখুম অনে। কাইল এক বার বাজারে খোজ নিমু। তুমি অহন খাইয়া ঘুমাও।
পরের দিন খুব ভোরে বদরুল রিক্সা নিয়ে বের হয়ে পড়ে। তার কপাল খুব ভালো। খুব তাড়াতাড়ি বেশ ভালো কয়েকটা খ্যাপও পেয়ে গেল।
ইউরোপ আমেরিকায় চাকরি করে এমন কয়েক জন যুবক দেশে এসেছে বিয়ে করবে বলে। এদের হাত খুব বড়। রিক্সা নিলে দরদাম করে না। বিদেশে বড় চাকরি করে। টাকা এদের কাছে কোন ব্যাপারই না। দুই হাতে এরা খরচ করে। যেই খ্যাপ মানুষ ২০/২৫ টাকার বেশী দিতে চায় না সেই খ্যাপ এরা এক শ দেড়শ টাকা দিয়ে দেয়। রিক্সায় উঠে এরা দামী বিদেশী সিগারেট ধরায় । তাকেও একটা দিয়েছে।
২০/২৫ মিনিটের খ্যাপে সে আজ দুটি চকচকে একশ টাকার নোট পেয়েছে। তার মনটা খুবই ভালো। বদরুল ঠিক করলো আজ আর রিক্সা চালাবে না। তার চেয়ে বাজার করে বাড়িতে গিয়ে লম্বা একটা ঘুম দেবে।
বাজারে গিয়ে অবাক হলো বদরুল। দার মনটা গেল দমে। সে ঠিক করে রেখেছিল- ইলিশ মাছ কেটে ভাগা দিয়ে যে বিক্রি হয় তার একটা ভাগা সে কিনে নিয়ে যাবে। অনেক আগে বাজারে মাছ কেটে ভাগা দিয়ে বিক্রি করতো। অনেক দিন ইলিশ মাছ কেনা হয় না বলে তার ঠিক খেয়াল নেই কত বছর আগে।
বেশ কয়েক জন বিক্রেতার কাছে বড় ও মাঝারী সাইজের কিছু ইলিশ মাছ থাকলেও কেউ কেটে ভাগ দিয়ে বিক্রি করছে না। তার সামনেই এক জন এসে আস্ত একটা ইলিশ কিনে নিয়ে চলে গেল। লোকটা কোন দামাদামিও করলো না। মনে হয় তার কাছে টাকা কোন বিষয় না। মাছটা পেলেই হলো। টাকা যেন তার কাছে হাতের ময়লা।
কাহা, ইলিশের ভাগা দেও না ? আমি একটা ভাগা কিনতে চাই।
না রে ভাতিজা । অহন আর ভাগা চলে না। সবাই আস্ত মাছই কিনতে চায়। সবার হাতে এখন কাচা পয়সা। কেউ আর ভাগা কিনে না। আমার ও মেহনত কম। আবার লাভ ও হয় অনেক বেশী। তোমার লাগবো নি মাছ একখান?
কাহা, এই মাছ খানের দাম কত?
তিন হাজার এর নীচে দেওন যাইবো না।
দাম শুনেও বদরুল খুব দমে গেল। মাছ খাওয়া তার জন্য না। সে ফিরে চললো বাড়ির দিকে।
এক সময় বদরুল আনমনা হয়ে যায়। মনে পড়ে বাজানের সাথে সেও অনেক বার নেৌকা নিয়ে গিয়েছে পদ্মায়। প্রচন্ড ভয় করতো তার। নৌকার মাঝ খানে শক্ত হয়ে বসে সে বাজান আর রহমান চাচার মাছ ধরার কৌশল দেখতো। ইলিশ উঠলেই সে আনন্দে চিৎকার করে উঠতো।
বাড়িতে মাছ আনার পর মা কাছ কাটতো। সে মায়ের সামনে বসে থাকতো। সব চেয়ে মজা লাগতো রান্নার সময়। যখন মা কড়াইয়ে মাছ ছেড়ে দিত তখন যে ঝাৎ করে একটা শব্দ হতো সেই শব্দটা তার কানে বাজে এখনো। কড়াইয়ের তেলে মাছ দেয়ার একটু পড়েই মিষ্টি ঘ্রাণ বের হতে শুরু করতো। সেই ঘ্রাণ কে যেন সে আজও টের পেতে শুরু করেছে।
হঠাৎ করেই তার আগের জীবনে ফিরে যেতে খুব ইচ্ছে করল। সেই বাল্যকালে। সকালে ঘুমের ঘোরে থাকবে। তার ঘুম ভাঙ্গবে বাজানের চিৎকারে।
বদরুল, কইরে বাজান আয় দেখ আজ কত মাছ ধরছি।
( কুয়ালালামপুরঃ মে, ২০১৯)
সর্বশেষ এডিট : ১৩ ই জুন, ২০১৯ সন্ধ্যা ৭:১০