
ছোট মেরুন রঙের প্যাকেটটা দেখে এগিয়ে গেলাম।নাবিস্কু বিস্কিট।২০ বছর আগের সেই নাবিস্ক বিস্কিট ৩ টাকা নয়ত ৫ টাকা দাম ছিল। অনেকদিন পর দেখলাম।এই বিস্কিটটা যে এখনও পাওয়া যায় এখানে না এলে জানতামই না।
ছোট একটা চায়ের দোকান, পিছনের তাঁকে থরে থরে সাজানো বিস্কিট, চিপস আর নানা রকমের খাদ্য।পানও পাওয়া যায়। এই পুরো এলাকায় প্রায় ১০ কিমি এর মধ্যে শুধু এই একটি দোকান। দোকানদার মধ্য বয়স্ক। এই দিকে বহিরাগত আগন্তুক খুব কম বলে লোকটি আমাদের দেখে উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠলো। সে চা এগিয়ে দিলো আর আমি নিলাম সেই নাবিস্ক বিস্কিট।এই দিকে বিদ্যুৎ সরবরাহ নাই,তাই একটা তেলের কুপিই ভরসা, টিমটিম করে জ্বলছে।
আমি যে জায়গাটার কথা বলছি সেটা হচ্ছে সেন্টমারটিন বাজার আর ছেড়াদ্বীপ এর মধ্যবর্তী একটা জায়গা।সেন্টমারটিন বাজার থেকে হেঁটে হেঁটে সেই সকালে ছেড়াদ্বীপ গিয়েছি।তখন দোকানটি চোখে পড়েনি। এখন ফেরার সময় হয়তো রাত বলে চোখে পড়েছে।
এরকম একটা জায়গায় লোকটা কি মনে করে চায়ের দোকান দিলো তাও বুঝছি না।কতোজন কাস্টমারই বা আসে প্রতিদিন এখানে।আর এখন আমি ছাড়া আর কোনও কাস্টমারই নেই।কাস্টমার না থাকলে উনি কি করেন,পুরোটা দিন কি সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে থাকেন।
আমরা যেখানে বসে আছি তার বিপরীতে মানে দোকানের সামনে হচ্ছে বিশাল সমুদ্র।সমুদ্রের উপরে যে চাঁদ উঠেছে তার আলোতেই পুরো এলাকা আলোকিত হয়ে গেছে।সমুদ্রের প্রচণ্ড গর্জন আর ঝলসানো রুপালী আলোয় এক মায়াময় পরিবেশ তৈরি হয়েছে।
দোকানের সামনে দুটি ছোট বেঞ্চি পাতা রয়েছে।তার উপর বসে চায়ে চুমুক দিচ্ছিলাম।অনেক চিনি দেয়ায় স্বাদটা বিস্বাদ ঠেকছিল।
“কি নাম? – জিজ্ঞেস করতেই বলল “মোখলেস”।
কতদিন ধরে এইখানে?
এই যে ধরেন বাপ দাদা মিলাইয়া ৭০ বছর তো হবেই।
দোকান কেমন চলে?
মোটামুটি ,কোনমতে।
দীর্ঘ পথ হাটার বিরতি হিসেবে একটু বিশ্রাম নিচ্ছিলাম আর টুকটাক কথা চলছিলো। কথায় কথায় জানা গেল তার প্রধান ব্যাবসা হচ্ছে সমুদ্রে মাছ ধরা।অবসর সময়ে , মুলত সন্ধ্যায় দোকানে বসে।অন্যান্য মাঝি ও লোকরা এখানে আড্ডা মারতে আসে।তখন টুকটাক বেচাকেনা হয়।যা চলে তাই লাভ।এখন বুঝলাম ছেড়াদ্বীপ যাওয়ার সময় দোকানটি চোখে পড়লো না কেন।
ভাই কি শহর থেকে আসলেন?
হ্যাঁ – আমি চট্টগ্রামের এলাকার নাম বললাম।
দোকানের পিছনে এতক্ষন যে একটা ১৯-২০ বছরের ছেলে কাজ করছিলো তা এখন খেয়াল করলাম। সে পিছন থেকে মাথা বের করে বলল,
“আপনি তো একদম শহরে থাকেন। সে তো অনেক বড় শহর!সেখানে অনেক বাতি, তাই না?আমার খুব ইচ্ছা শহরে থাকার”।
“বাতি, ঝলমলে সবই ঠিক আছে,কিন্তু এই জায়গা তো সুন্দর, প্রাকৃতিক, স্বপ্নের মতো।এতো শান্তি সেখানের চাঁদের আলোতে নেই। ওখানের চাঁদের আলো প্রচণ্ড ম্রিয়মাণ।আমার তো ইচ্ছে করে আপনাদের এমন সুন্দর জায়গায় পুরো জীবনটা কাটিয়ে দেই।সমুদ্রের পাশে, চাঁদের সাথে”।
“সমুদ্র আর চাঁদ ছাড়া আর কিইবা দেখার আছে এখানে।সমস্ত সুখ তো আপনাদের ওখানে, শহরে।ভালো থাকা, ভালো খাওয়া।একটাই তো জীবন।ভালোভাবে যদি কাটানো না যায় তবে কি আর জীবন? আমি শহরে থাকতে চায়,আমাকে একটা কাজ যোগাড় করে দিবেন”।- ছেলেটার সহ্জ সরল আকুতি।
ছেলেটা কি সত্যিই শহর দেখেনি? এসব সহজ সরল ছেলেরা কি শহরে যান্ত্রিকতার সাথে মিলাতে পারবে?চাঁদের আলো তার কাছে কি আমার মতই সুন্দর মনে হবে।নাকি পুরো শহরকে এরা তাদের মতো সহজ সরল, মায়াময় বানিয়ে ফেলবে।
“নদীর এপার কহে ছাড়ি নিঃশ্বাস, ও পাড়েতে সর্বসুখ আমার বিশ্বাস”।
আমি উঠে দাঁড়ালাম। আমার যেতে হবে আমার গন্ত্যব্যে।নয়তো জোয়ারের পানি এসে ছেড়াদ্বীপকে আলাদা করে দিবে মুল দ্বীপ থেকে। নিজেকে তাগাদা দিলাম।জোরে চলো মাঝি,জোয়ার ভাটার জীবনে থমকে দাড়াতে নেই। দাঁড়ালে আর পৌঁছানো যাবে না গন্ত্যব্যে।
সর্বশেষ এডিট : ২৩ শে জানুয়ারি, ২০১৯ দুপুর ১২:৫৯

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




