আমি নির্দ্বিধায় বলে দিয়েছিলাম তমাকে, "আমাকে বিয়ে করবে?"
তমা নির্লিপ্ত হয়ে হ্যাঁ বলতে পারেনি।
"ভেবে দেখি", বলে আমার সামনে থেকে সরে গিয়েছিল। তমার সাথে আমার বিয়ে হয়নি। যে লোকটার সাথে তমার বিয়ে হয়েছিল সে বয়সের হিসাবে আমাদের চেয়ে আট বছরের বড় ছিল। ফরিদ নামের লোকটাকে আমার নিপট ভদ্রলোক বলেই মনে হয়েছে। তমার তা মনে হয়নি। বিয়ের পর তমা আমার কাছের বান্ধবী বনে গেল। আমি টুকটাক বিষয়ে ওর সাথে কথা বলি। কথার ফাঁকে মাঝে মাঝেই বলি, "তুমি যদি ফরিদ সাহেবকে ছেড়ে আমার কাছে চলে আসো, আমি কিছুই মনে করব না।"
তমা চলে আসেনা আমার কাছে। আমি মাঝে মাঝেই তমাকে বলি, ফরিদ সাহেবের অফিসে আমাকে একটা চাকরির ব্যবস্থা করে দিতে। তমা "ভেবে দেখি" বলে। আমি অপেক্ষায় থাকি। আমার অপেক্ষার প্রহর শেষ হয় না। তমা সংসার করে, আমি করি চাকরি। আমার অফিসের বস মেহেরাজ সাহেব আমাকে মাঝে মাঝে ডেকে বলেন, "আশিক, বিয়ে সাদি করবে না?"
"এখনও তো বয়স হয়নি, স্যার।"
"বিয়ে করে ফেলো।"
"করব স্যার।"
মেহেরাজ সাহেবের সাথে আমার অতি সু সম্পর্ক। তার বউ বাসার বাইরে থাকলেই, তিনি আমাকে একখানা বোতল নিয়ে তার বাসায় যেতে বলেন। আমি যাই, আমাকে টাকা দিয়ে তিনি বোতল হাতিয়ে নেন। গ্লাসের পর গ্লাস খেয়ে যান, আমি সামনে বসে তা দেখি। আমার ওসবে রুচি হয় না। তিনি ড্রিংকস করার সময়টায় একটানা অনেক কিছু বলে যান। তার কথা, তার গোপন কিছু কথা। আমি সে কথার শ্রোতা হিসাবে সামনে বসে থাকি, ব্যাস। সেসব কথা তিনি কাউকেই বলেন না, কাউকেই না। পরদিন আমার অঘোষিত বন্ধ থাকে। আমি বন্ধের দিনটায় তমাকে বলি, "দেখা করবে?"
তমা বলে, "ভেবে দেখি।"
তমার সাথে আমার দেখা হয় না।
মেহেরাজ সাহেবের স্ত্রী উম্মে সালমার কাছেও আমি অতি বিশ্বস্ত হিসাবে পরিচিত। তিনি যেদিন বাসার বাইরে থাকেন, পরদিন তিনি আমাকে ফোন করে জিজ্ঞেস করেন, "আশিক, তোমার স্যার গত রাতেও ড্রিংকস করেছেন, তাই না?"
"জ্বি ম্যাডাম।"
"বোতল কিনে নিয়ে গিয়েছে কে? তুমি?"
"জ্বি ম্যাডাম।"
"তোমাকে কতবার না করেছি?"
"ম্যাডাম, আমি তো স্যারের চাকরি করি। না করব কী করে?"
"তোমার নতুন চাকরি লাগবে?"
"জ্বি ম্যাডাম?"
"আমি তোমাকে যদি আরও ভাল বেতনে চাকরি দেই, করবে?"
আমি তমার মত করে, ভেবে দেখি বলতে চেয়েও বলি না। মেহেরাজ সাহেবের অফিসের চাকরি ছেড়ে আমি নতুন চাকরিতে ঢুকি। উম্মে সালমা ম্যাডামের এক বান্ধবীর অফিসে। আমার অস্বস্তি বোধ হয় এই অফিসে। তবু বেতনের কথা ভেবে চুপ থাকি। কিছু বলি না। আমার নতুন বস নুহা ম্যাডাম অল্পতেই রেগে যান, অল্পতেই রাগ চলে যায়। তার মেজাজের মতিগতি আমি ধরতে পারি না। আমি তার বান্ধবীর রেফারেন্সে এসেছি, তাই তিনি খুব একটা কিছু বলতে পারেন না।
নুহা ম্যাডামের ছোট বোন নোভা, আমার টিমের হেড। অল্প বয়স্ক একটা মেয়ে, অথচ কী দারুণ মার্কেটিং সেন্স। আমি নোভার কাছাকাছি থেকে জীবনের সেরা গ্রুমিংটা পেয়েছি, তা স্বীকার করতেই হবে। নোভাকে আমি নানা জায়গার সোর্স দেই। মার্কেটিং এর দায়িত্ব নোভার। অল্প কথায় পটিয়ে ফেলার ক্ষমতা আমি নোভার কাছ থেকে আয়ত্ত করার চেষ্টা করি। নোভা হুট করেই বড় এক কোম্পানিতে আমাদের প্রোডাক্টের পুরোপুরি কন্ট্রাক্ট পেয়ে যায়। হুট করেই আমাদের ব্যবসায় দারুণ লাভ হয়। সবটাই নোভার জন্য। তবু নোভা আমাকে নুহা ম্যাডামকে দেখিয়ে বলে, "আশিক ইজ এ রিয়েল জিনিয়াস। এই লার্জ প্রফিটের পুরোটাই আশিকের ক্রেডিট।"
আমি লজ্জায় মাথা নিচু করে থাকি। নুহা ম্যাডাম শক্ত মুখে হাসি ফুটিয়ে রাখেন। তিনি ইদানীং আমার উপর কিছুটা রুষ্ট, আমি তা বুঝতে পারি। কেউ একজন নুহা ম্যাডামের কানে দিয়েছে, আমার আর নোভার মাঝে কিছু চলছে। নুহা ম্যাডাম তা বিশ্বাস করেন। আমাকে কিছু না বললেও, আমি বুঝতে পারি, ম্যাডাম চাচ্ছেন না আমি আর এই অফিসে চাকরি করি, নোভার আশেপাশে থাকি। অথচ আমাদের মাঝে অমন কিছুই নেই। নোভার কারও সাথে সম্পর্ক আছে। তার সাথে হেসে হেসে কথা বলে, সময় পেলে দেখা করে। সে মানুষটা আমি নই। অন্য কেউ।
তবু নুহা ম্যাডাম আমাকেই অবিশ্বাস করেন। আমার হাতে একটা প্যাকেট ধরিয়ে দিয়ে বলেন, "এর মধ্যে তিন মাসের বেতন আছে। তুমি নতুন চাকরি খুঁজো একটা। না পাওয়া পর্যন্ত এখানে থাকো সমস্যা নেই।"
আমি প্যাকেট হাতে বেরিয়ে আসি। নোভাকে কিছু বলিনা। নোভাকে কিছু জানালে ব্যাপারটা বাজে হবে।
আমি আবার তমাকে বলি, "আমার তো চাকরি চলে গিয়েছে। ফরিদ সাহেবের অফিসে আমার একটা চাকরির ব্যবস্থা করে দাও।"
তমা সে কথার কোন উত্তর দেয় না। চুপ করে থাকে।
"ভালো লাগছে না কথা বলতে", বলে ফোন রেখে দেয়।
দিন চারেক আমি তমাকে ফোন দেই। তমা ফোন ধরে না। একবার ভাবি, ওর বাসার সামনে চলে যাই। অতটা অধিকার আমার এখনও হয়নি ভেবে, আমি পিছিয়ে আসি। পঞ্চম দিনের মাথায় তমা আমাকে নিজে থেকে বলে, "দেখা করতে পারবে?"
"কী বলছ?"
"পারবে কি-না বল?"
"অবশ্যই পারব।"
"আজ বিকালে দেখা করো।"
সত্যি সত্যিই তমা সেদিন বিকালে দেখা করতে আসে। আমার সামনে মুখ গোমড়া করে বসে থাকে। কী হয়েছে, জানতে চাই। উত্তর পাই না। নীরবতায় বেলা গড়িয়ে সন্ধ্যা হয়। আমিও কথা বলার কিছু খুঁজে না পেয়ে ঝিম মেরে বসে থাকি। তমা নিজে থেকেই নীরবতা ভাঙে।
"ফরিদ আমাকে ডিভোর্স দিতে চায়। ও আবার বিয়ে করবে।"
আমি অবাক হওয়া চোখে তাকিয়ে থাকি। আমার কী বলা উচিৎ আমি ভেবে পাই না। তবে আমি জানি, তমা আর ফরিদ সাহেবের সম্পর্কটা টিকবে না। ফরিদ সাহেব ঠিক তমাকে ডিভোর্স দিয়ে দিবেন। তিনি নতুন বিয়ে করবেন। আমার মার্কেটিং সোর্সে নোভার মার্কেটিং এ, ফরিদের সাহেবের কোম্পানির সাথে নুহা ম্যাডামের কোম্পানির মাঝে যে সু-সম্পর্ক গড়ে উঠেছে, তা ছড়িয়ে গিয়েছে নোভা আর ফরিদ সাহেবের মাঝে। তিনি নোভাকেই বিয়ে করবেন। এখানে আমার করার কিছুই নেই। আমি এখন শুধু তমার হাত ধরে বলতে পারি, " আমাকে বিয়ে করবে?"
তমা কি এখনও "ভেবে দেখি" উত্তর দিবে?
০৭-০৩-২০১৯
রিয়াদুল রিয়াদ