somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ধূসর অর্থনৈতিক খাত বা গ্রে ইকোনমিক সেক্টর এবং বাংলাদেশের জিডিপিতে উহার প্রভাব

২৭ শে জানুয়ারি, ২০২৩ সকাল ১১:৫৭
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


আমাদের দেশে বর্তমানে মাথা পিছু (পার ক্যাপিটা) জিডিপি হল প্রায় ২,৭৩৪ ইউ এস ডলার। কিন্তু মাত্রাতিরিক্ত গ্রে ইকোনমিক বা শ্যাডো ইকোনমিক খাতের কারণে আমাদের মাথা পিছু জিডিপি অনেক কম দেখায়। গ্রে ইকোনমিক খাত বলতে বুঝায় যে আয়গুলি অবৈধ অথবা যার উপর কর দেয়া হয়নি অথবা যে আয় কোন কারণে সরকারের হিসাবে আসেনি। অবৈধ আয় বলতে বুঝায় চোরাকারবারি, দুর্নীতি, ঘুষ, চুরি, ডাকাতি, পতিতাবৃত্তি, মানব পাচার, মাদক ব্যবসা, জুয়া, অবৈধ কমিশন, টেন্ডার কারসাজি, ব্যাংক ঋণ পরিশোধ না করা, অর্থ পাচার ইত্যাদি। সরকারের হিসাবে না আসা আয়ের উদাহরণ হল ঘরের উঠানে বা ছাদে শাক সবজি বা ফলমুলের চাষ, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীর আয় (যেমন ফুটপাতের হকার), কিছু স্ব-নিয়োজিত পেশাজীবীর আয়, বাসার কাজের বুয়ার আয় ইত্যাদি। বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে বাংলাদেশের গ্রে ইকোনমি আমাদের জিডিপির ৬২.৫০% থেকে ৮০% পর্যন্ত হতে পারে। তথ্যের অভাবে বা অবৈধ হওয়ার কারণে এই খাতের আয় আমাদের জিডিপিতে আসে না। অর্থাৎ এই গ্রে ইকোনমিক সেক্টরগুলির আয় হিসাবে নিলে আমাদের মাথা পিছু জিডিপি হত ৪,৯২১ ইউ এস ডলার।

পার ক্যাপিটা জিডিপি নিয়ে অনেক বিতর্ক আছে। এটা কোন আদর্শ সূচক না। তারপরও সরকারের বিভিন্ন অর্থনৈতিক নীতি এবং নিয়ন্ত্রণ প্রচেষ্টার ক্ষেত্রে জিডিপির সঠিক হিসাব খুব গুরুত্বপূর্ণ।

গ্রে ইকোনমি কেন সৃষ্টি হয়?

গ্রে ইকোনমি সৃষ্টি হওয়ার পিছনে বিভিন্ন কারণ আছে। দুর্নীতি, নৈতিক অবক্ষয়, অপরাজনৈতিক কর্মকাণ্ড, অতিরিক্ত কর বা শুল্ক আরোপ, অতিরিক্ত বাণিজ্যিক নিয়ম কানুন প্রয়োগ যেগুলি মানতে জনগণ হিমশিম খায়, নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলির অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড পর্যবেক্ষণের এবং নথিভুক্তকরনের ক্ষেত্রে অদক্ষতা এবং উদাসীনতা, জনগণের কর ফাঁকি দেয়ার প্রবণতা, প্রান্তিক পর্যায়ের আয়গুলি লিপিবদ্ধ করার কোন পদ্ধতি না থাকা, আয়ের অসম বণ্টন, হিসাব পদ্ধতির দুর্বলতা, নিম্ন মানের নিরীক্ষা, আইনের ফাঁক এবং অসঙ্গতি, ঘন ঘন আইনের পরিবর্তন, আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতির দুর্বলতা ইত্যাদি কারণে গ্রে ইকোনমির আকৃতি বৃদ্ধি পায়। এরকম আরও অনেক কারণ আছে।

গ্রে ইকোনমির আকার বড় হওয়ার সুফল এবং কুফলঃ

কুফলঃ
১। অর্থনৈতিক নীতি প্রনয়নের ক্ষেত্রে ভুল হতে পারে। কারণ প্রকৃত অর্থনৈতিক চিত্র না জানা গেলে সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষেত্রে ভুল হতে পারে। দেশের দারিদ্র্য এবং বেকারত্ব সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা পাওয়া যায় না। ফলে সঠিক প্রতিকার ব্যবস্থা গ্রহণ করা যায় না।

২। অনেকে নিয়ম মেনে কর দেয়ার বা ব্যবসা করার চেষ্টা করে কিন্তু নিয়ম ভঙ্গকারীদের সাথে এরা অসম প্রতিযোগিতার সম্মুখীন হয়। ফলে সমাজে বৈষম্য তৈরি হয়। সৎ লোক পিছিয়ে পরে আর অসৎ লোক এগিয়ে যায়।

৩। সরকারের রাজস্ব কমে যায়। ফলে সরকারকে অনেক সময় ঋণ করতে হয় এবং জনগণের কল্যাণে অবদান রাখা কষ্টকর হয়ে যায় (তবে আমাদের দেশে প্রায়শই জনগণের করের টাকা বিভিন্ন মেগা প্রকল্পের খরচ বারবার বৃদ্ধির মাধ্যমে এবং কমিশন নেয়ার মাধ্যমে শাসক এবং আমলা মহল নিজেরাই সুবিধাভোগী হিসাবে গ্রে ইকোনমি সৃষ্টি করে থাকে)।

৪। সমাজে অপরাধ বেড়ে যায়। কারণ অনেক গ্রে ইকোনমিক কর্মকাণ্ডের সাথে বিভিন্ন ধরণের ভয়ংকর অপরাধ জড়িত। যেমন নারী, শিশু এবং মানব পাচার, জুয়া, পতিতাবৃত্তি, টেন্ডার নিয়ে হত্যা বা হানাহানি, আর্থিক প্রতারনা ইত্যাদি।

৫। অর্থনৈতিক এবং সামাজিক ভারসাম্য নষ্ট হয় এবং সামশ্তিক অর্থনীতির সূচকগুলি সঠিক তথ্য দেয় না ফলে মুদ্রা এবং আর্থিক নীতি প্রণয়ন ত্রুটিপূর্ণ হয়। সমাজে বৈষম্য তৈরি হয়। সামাজিক সাম্য থাকে না।

৬। সরকার কর বাড়ানোর জন্য সৎ লোকের উপর হামলে পড়ে কিন্তু ফাঁকিবাজদের ব্যাপারে উদাসীন থাকে।

৭। জমি, ফ্লাট ইত্যাদির মূল্য অস্বাভাবিক রকম বেড়ে যায় অবৈধ অর্থের কারণে। অবৈধ আয় করা লোকেরা নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্য বৃদ্ধি ঘটাতে সাহায্য করে। কারণ এরা বাজারে বা মার্কেটে গিয়ে দামাদামি করে না।

৮। শেয়ার মার্কেটকে অবৈধ অর্থের সাহায্যে নিজেদের খুশি মত নিয়ন্ত্রণ করা যায়। ফলে জনগণ আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। শেয়ার বাজার সঠিকভাবে কাজ না করলে প্রাইভেট সেক্টরে বিনিয়োগ এবং শিল্পায়ন সঠিকভাবে হয় না। উদ্যোক্তারা শেয়ার বাজারের সুফল গ্রহণ করতে না পারার জন্য ব্যাংকমুখী হয়। এতে ব্যাংকের লাভ হয় এবং সৎ উদ্যোক্তাদের বিনিয়োগ পেতে বেশী অর্থ খরচ করতে হয়। শেয়ার মার্কেট সঠিকভাবে কাজ করলে কম খরচে উদ্যোক্তারা বিনিয়োগ পেতেন।

গ্রে ইকোনমির সুফলঃ
১। অনেক লোকের কর্মসংস্থান হয়। বিশেষ করে বড় অর্থনৈতিক সংকটের সময় গ্রে ইকোনমি কর্মসংস্থানে ভুমিকা রাখে।

২। গ্রে সেক্টরে পণ্য বা সেবার উৎপাদন খরচ কম হয়। জনগণ এতে উপকৃত হয়।

তবে গ্রে ইকোনমির আকার বড় হওয়া সার্বিকভাবে কোন দেশের জন্য ভালো না। উন্নত বিশ্বে গ্রে ইকোনমির আকৃতি ৭% থেকে ১৫% হতে পারে। তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলি গ্রে ইকোনমির আকৃতি অনেক বড় হয়। এটা দেশের রাজনীতি, অর্থনীতি এবং সমাজ জীবনে খারাপ প্রভাব ফেলে। সুশাসন প্রতিষ্ঠা করা যায় না। পরিণামে সাধারণ জনগণ নিপীড়িত এবং ক্ষতিগ্রস্ত হয়। দেশের উন্নয়ন বাঁধাগ্রস্ত হয়।

বাংলাদেশের অবৈধ আয়ের বড় অংশ কোথায় আছে?

১। বিদেশের ব্যাঙ্কে বা বিদেশে সম্পদ কেনার মাধ্যমে।
২। শেয়ার মার্কেটে আছে
৩। জমি এবং ফ্লাট আকারে আছে।
৪। ব্যাঙ্ক হিসাবে বা এফ ডি আর ইত্যাদিতে কিছু অবৈধ রাখা হয়। তবে এটার পরিমান খুব কম।
৫। নগদ, স্বর্ণ এবং অলঙ্কার হিসাবে আছে।

সব দিক বিবেচনা করলে গ্রে ইকোনমির আকৃতি বড় হওয়া একটা দেশের জন্য ক্ষতিকর। পৃথিবীর উন্নত দেশগুলিতে গ্রে ইকোনমির আকৃতি খুব ছোট। আমাদেরকে উন্নত দেশ হতে হলে আমাদের গ্রে ইকোনমির আকৃতি ১০% এর নীচে নিয়ে আসতে হবে। যদি আমরা সফল হই তাহলে সমাজে অর্থনৈতিক এবং সামাজিক বৈষম্য কমবে, সুশাসন বিরাজ করবে, মানবাধিকার নিশ্চিত হবে, রাজনীতিতে সচ্ছতা আসবে, গণতন্ত্র এবং সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হবে।

সুত্রঃ
mof.portal.gov.bd/sites/default/files/files/mof.portal.gov.bd/page/17643e1a_542c_47c8_a833_91a90d156ac7/chapter1 (1).pdf

investopedia.com/articles/markets-economy/062216/how-underground-economy-affects-gdp.asp

en.wikipedia.org/wiki/Economy_of_Bangladesh

jbepnet.com/journals/Vol_3_No_1_March_2016/2.pdf

ছবিঃ ফাইনানন্সিয়াল এক্সপ্রেস
সর্বশেষ এডিট : ২৭ শে জানুয়ারি, ২০২৩ দুপুর ১২:০৪
৯টি মন্তব্য ৯টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

মেঘ ভাসে - বৃষ্টি নামে

লিখেছেন লাইলী আরজুমান খানম লায়লা, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:৩১

সেই ছোট বেলার কথা। চৈত্রের দাবানলে আমাদের বিরাট পুকুর প্রায় শুকিয়ে যায় যায় অবস্থা। আশেপাশের জমিজমা শুকিয়ে ফেটে চৌচির। গরমে আমাদের শীতল কুয়া হঠাৎই অশীতল হয়ে উঠলো। আম, জাম, কাঁঠাল,... ...বাকিটুকু পড়ুন

= নিরস জীবনের প্রতিচ্ছবি=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:৪১



এখন সময় নেই আর ভালোবাসার
ব্যস্ততার ঘাড়ে পা ঝুলিয়ে নিথর বসেছি,
চাইলেও ফেরত আসা যাবে না এখানে
সময় অল্প, গুছাতে হবে জমে যাওয়া কাজ।

বাতাসে সময় কুঁড়িয়েছি মুঠো ভরে
অবসরের বুকে শুয়ে বসে... ...বাকিটুকু পড়ুন

Instrumentation & Control (INC) সাবজেক্ট বাংলাদেশে নেই

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:৫৫




শিক্ষা ব্যবস্থার মান যে বাংলাদেশে এক্কেবারেই খারাপ তা বলার কোনো সুযোগ নেই। সারাদিন শিক্ষার মান নিয়ে চেঁচামেচি করলেও বাংলাদেশের শিক্ষার্থীরাই বিশ্বের অনেক উন্নত দেশে সার্ভিস দিয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

জীবনের গল্প

লিখেছেন ঢাকার লোক, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৯:৩৫

মাত্র মাস দুই আগে আমার এক আত্মীয়ের সাথে দেখা আমার এক বোনের বাড়ি। তার স্ত্রী মারা গেছেন তার সপ্তাহ দুই আগে। মক্কায় উমরাহ করতে গিয়ে হঠাৎ অসুস্থ হয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

অভিমান

লিখেছেন জিনাত নাজিয়া, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১০:১২

" অভিমান "

তোমার ঠোঁটে বোল শিখেছি
তুমি আমার মা, কেমন করে
ভুলছ আমায় বলতে
পারিনা। এমন করে চলে
গেলে, ফিরে ও এলেনা। হয়তো
তোমার সুখেই কাটছে দিন,
আমায় ভাবছ না।

আমি এখন সাগর... ...বাকিটুকু পড়ুন

×