ফিলিপাইনে একমাত্র মৃত্যু ছাড়া স্বামী বা স্ত্রী বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটাতে পারে না। ফিলিপাইন মুলত একটা ক্যাথোলিক খৃস্টান অধ্যুষিত দেশ। বিবাহ বিচ্ছেদের ক্ষেত্রে খৃস্টান ক্যাথোলিকদের নিয়মের চেয়েও ফিলিপাইনের আইন কড়া। এমনই কড়া যে এই দেশে আইনত কোন বিবাহ বিচ্ছেদ নাই। এই ধরণের কোন আইনই নেই যার দ্বারা বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটানো যেতে পারে।
ফিলিপাইনে একটা আইন আছে যার দ্বারা বিবাহের চুক্তিকে বাতিল করা যায়। এই বাতিলের অর্থ দাড়ায় যে, শুরু থেকেই বিয়েটা বেআইনি বা অবৈধ ছিল। অর্থাৎ বিয়ের শুরু থেকে বাতিল হওয়া পর্যন্ত সময়ের বাচ্চা, কাচ্চা থেকে শুরু করে স্বামী স্ত্রীর সকল রকমের সম্পর্ক এবং লেনদেনই অবৈধ ছিল। এই প্রক্রিয়াও খুব সহজ না। ৩/৪ বছর লেগে যায় আদালতের রায় পেতে। আইনি খরচ হয় প্রায় একজন ফিলিপাইনের নাগরিকের ১ বছরের আয়ের সমান। এই দীর্ঘ আইনি প্রক্রিয়া শেষ না হওয়া পর্যন্ত স্বামী বা স্ত্রী কোন সম্পদ ক্রয় করলে সেটা ঐ দম্পতির যৌথ সম্পদ হিসাবে গণ্য হতে থাকে। এই সময়ে স্বামী বা স্ত্রী অন্য কারও সাথে সম্পর্কে জড়ালে আইনত সেটা একটা অবৈধ সম্পর্ক। যার শাস্তি জেল পর্যন্ত হতে পারে।
ফিলিপাইনে প্রায় ৫% লোক হল মুসলিম। এদের জন্য আছে পৃথক মুসলিম আইন যে আইনের সাহায্যে মুসলমানরা বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটাতে পারে।
আবার আইনি প্রক্রিয়ায় বিবাহ চুক্তি বাতিল করার পরও চার্চের মাধ্যমে আলাদাভাবে বিবাহ চুক্তি বাতিল করতে হয়। এটা না করলে চার্চ কর্তৃপক্ষ অন্যত্র বিয়ে করার অনুমতি দেয় না। চার্চের এই প্রক্রিয়া শেষ করতে অনেক সময় ১০ বছরও লাগে।
বিয়ে চুক্তি বাতিলের ক্ষেত্রে স্বামী বা স্ত্রীকে আদালতে প্রমাণ করতে হয় যে বিয়ের চুক্তি বাতিলযোগ্য। যেমন হয়তো বিয়ের সময় স্বামী বা স্ত্রীর বয়স ১৮ বছরের কম ছিল অথবা ঐ স্বামী বা স্ত্রীর অনিরাময় যোগ্য সেক্সুয়ালি ট্রান্সমিটেড কোন রোগ আছে অথবা একাধিক বিয়ে আছে ইত্যাদি। এইভাবে বিয়ের চুক্তি বাতিল করলে আইনত ধরে নেয়া হয় যে এই দম্পতি কোন কালেই বিবাহিত ছিল না। একারণে অনেক আইনি এবং সামাজিক জটিলতা সৃষ্টি হয়।
ফিলিপাইন উনবিংশ শতাব্দীর শেষ পর্যন্ত যখন স্পেনের উপনিবেশিক শাসনের অধীনে ছিল তখন স্প্যানিশরা ক্যাথোলিক নিয়মে বিবাহ বিচ্ছেদের বিধান রেখেছিল। যদিও ক্যাথোলিকদের বিবাহ বিচ্ছেদের নিয়মও বেশ জটিল এবং কঠিন শর্তযুক্ত। ক্যাথোলিক নিয়মে কেবল মাত্র কোন স্পাউস ব্যভিচার করলে কিংবা অন্য ধর্মে ধর্মান্তরিত হলে বিবাহ বিচ্ছেদের অনুমতি আছে।
ফিলিপাইনের সংবিধান অনুযায়ী বিবাহ হল একটা অলঙ্ঘনীয় সামাজিক ইন্সটিটিউশন এবং পরিবারের ভিত্তি যে কারণে বিবাহকে রক্ষা করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব হিসাবে গণ্য করা হয়। ফিলিপাইনের বর্তমান আইনে ব্যভিচার বা ধর্ম পরিবর্তন করলেও বিবাহ বিচ্ছেদ করা যায় না। যদিও দেশের সিংহভাগ লোক ক্যাথোলিক খৃস্টান।
স্পেনের পরে যুক্তরাষ্ট্র ১৮৯৮ সাল থেকে প্রায় ৫০ বছর ফিলিপাইনকে শাসন করে। অ্যামেরিকানরা ঐ সময়ের আইনের দ্বারা শুধু ব্যভিচার বা উপপত্নীর ক্ষেত্রে বিবাহ বিচ্ছেদের অনুমতি দিত। জাপান যখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ফিলিপাইনের দখল নেয় তখন তারা বিবাহ বিচ্ছেদের আইন সহজ করেছিল। কিন্তু ফিলিপাইন যখন স্বাধীন হয় তারপর থেকে বিবাহ বিচ্ছেদের আইনই উঠে যায়। ফলে আইনত ফিলিপাইনে কোন বিবাহ বিচ্ছেদের নিয়ম নাই।
ফিলিপাইনের আইনে স্পাউস কর্তৃক প্রতারনা কিংবা শারীরিক নির্যাতন ঘটলেও বিবাহ বিচ্ছেদ করা যায় না। যদি স্বামী বা স্ত্রী প্রমাণ করতে পারে যে স্পাউস মানসিকভাবে ভারসাম্যহীন অথবা সে অস্বাভাবিক মানসিক আচরন করে সেই ক্ষেত্রে বিবাহ চুক্তি বাতিলের রায় দেয়া হয়। ফলে বিচ্ছেদের কারণ ভিন্ন হলেও ঘুরিয়ে ফিরিয়ে সবাই এই মানসিক সমস্যাকে বা ভারসাম্যহীনতাকে প্রমাণ করার চেষ্টা করে বিভিন্ন মিথ্যা কথা এবং মিথ্যা সাক্ষ্যের মাধ্যমে। এই আইনি প্রক্রিয়ায় প্রায় ৫ থেকে ১০ লাখ টাকা লাগে এবং অনেক ক্ষেত্রে আদালতে অনেকভাবে অপমানিত হতে হয়।
বিবাহ বিচ্ছেদ আইনের সমর্থনে একটা বিল ২০১০ সালে উত্থাপন করা হয়েছিল। কিন্তু আইন প্রণেতাদের অনেকে বলেছেন যে তারা চায় না যে ফিলিপাইন লাস ভেগাস হয়ে যাক যেখানে সকালে বিয়ে করে বিকেলে বিচ্ছেদ ঘটানো হয়ে থাকে। ২০১৪ সালে ৬০% লোক বিবাহ বিচ্ছেদ আইনের পক্ষে ছিল। কিন্তু ঐ সময় আইন প্রণেতাদের একজন বলেছেন যে এই আইন পাস হলে আমার স্ত্রী এটা আমার বিরুদ্ধে ব্যবহার করবে।
ফিলিপাইনে আরেকটা আইন আছে যার দ্বারা স্বামী বা স্ত্রী আইনগতভাবে পৃথক থাকার অধিকার অর্জন করতে পারে। এই প্রক্রিয়ায় তাদের সম্পদ আইনি প্রক্রিয়ায় পৃথক হয়ে যায় এবং তারা আলাদা থাকতে পারে। কিন্তু এই পদ্ধতির দ্বারা স্বামী এবং স্ত্রীর বিয়ের আইনি অবসান ঘটে না এবং অন্য কাউকে বিয়ে করার আইনগত অধিকার তৈরি হয় না।
বিয়ে করাও সহজ না আবার বিয়ের বিচ্ছেদ ঘটানোও সহজ না। তারপরেও মানুষ বিয়ে করে। তবে এখন উন্নত অনেক দেশে বিয়ে করা কমে গেছে। হয়তো ভবিষ্যতে বিয়ে প্রথা আর থাকবে না ঐ সব দেশে। বিয়ে একটা সামাজিক চুক্তি। যে কোন চুক্তিতেই অবসান করার একটা ধারা থাকে। ফিলিপাইনে এই চুক্তির অবসানের কোন সুযোগ নাই। আরও কিছু দেশ আছে যেখানে বিবাহ বিচ্ছেদ প্রক্রিয়া বেশ জটিল। একমাত্র ইসলাম ধর্মে বিয়ে করা এবং বিবাহ বিচ্ছেদ করা অপেক্ষাকৃত সহজ (মেয়েদের ক্ষেত্রে অবশ্য বিচ্ছেদের কিছু ঝামেলা আছে)। যারা ব্লগে বিয়ে করেছেন বা করেছিলেন তাদেরকে অভিনন্দন। যারা সামনে করবেন বলে পরিকল্পনা করেছেন তাদেরকেও আগাম অভিনন্দন। যারা বিয়ে করেন নাই বা করতে চান না তাদেরকেও অভিনন্দন কারণ সেই ক্ষেত্রে বিচ্ছেদের কোন ঝামেলা নাই। (বিবাহ এবং বিচ্ছেদ বিশেষজ্ঞরা বলেছেন যে বিবাহ হল বিচ্ছেদের অন্যতম প্রধান কারণ)। ফিলিপাইন আর জাপানে গিয়ে বিয়ে করার সময় ঐ দেশ দুটির ভালো কোন আইনজীবীর পরামর্শ নেয়া উচিত বলে আমি মনে করি। নইলে ইমরান শরিফের মত রাস্তায় নেমে হাউ মাউ করে কাঁদতে হতে পারে।
সূত্র -
theatlantic.com/international/archive
goldbergjones-or.com/divorce/10-odd-divorce-laws-from-around-the-world
ছবি - todaysfamilylawyer.co.uk
সর্বশেষ এডিট : ১৫ ই ফেব্রুয়ারি, ২০২৩ সকাল ৭:১৩