ষ্ট্যাণ্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংকের গ্রুপ চেয়ারম্যান জোসে ভিনাল ২০২২ সালের ডিসেম্বর মাসে বাংলাদেশে এসেছিলেন। ডেইলি স্টার পত্রিকায় দেয়া সাক্ষাতকারে তিনি বাংলাদেশ সম্পর্কে বেশ কিছু ইতিবাচক মন্তব্য করেছেন। আমার কাছে মনে হয়েছে এই মন্তব্যগুলি সৌজন্য মুলক ছিল না বরং তিনি তার অভিজ্ঞতার আলোকে নিরপেক্ষভাবে এই মন্তব্যগুলি করেছেন। জোসে ভিনাল ইতিপূর্বে আইএমএফ এর একজন পরিচালক ছিলেন। তিনি হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে পিএইচডি করেছেন এবং লন্ডন স্কুল অব ইকনমিক্স থেকে অর্থনীতিতে মাস্টারস করেছেন। ওনার সাক্ষাৎকারের উল্লেখযোগ্য অংশ আমি এই লেখায় তুলে ধরার চেষ্টা করেছি।
জোসে ভিনাল
জোসে ভিনাল বলেছেন অন্যান্য দেশের মতই বাংলাদেশ বর্তমানে কিছু স্বল্প মেয়াদি চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশের জন্য মধ্য মেয়াদি উজ্জ্বল সম্ভবনা আছে। এই মধ্য মেয়াদি সম্ভবনাকে বাস্তব রূপ দেয়ার জন্য বাংলাদেশকে স্বল্প মেয়াদি চ্যালেঞ্জগুলিকে সফলভাবে মোকাবেলা করতে হবে। কোভিড – ১৯ এবং বর্তমান বৈশ্বিক সঙ্কট মোকাবেলা ক্ষেত্রে দৃঢ় সংকল্প থাকার কারণে দেশের প্রাইভেট সেক্টরের প্রশংসা করেছেন জোসে ভিনাল। তিনি বলেছেন বাংলাদেশের প্রচুর জীবনীশক্তি আছে। তিনি অকপটে বলেন যে মধ্য মেয়াদে এশিয়ার অন্যতম তারকা হওয়ার মত সম্ভবনা বাংলাদেশের আছে।
জোসে ভিনাল বলেন তিনি খুবই আশাবাদী যে আগামী ৫ থেকে ১০ বছর সময়ে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সাফল্যের সম্ভাবনা রয়েছে। কোভিড – ১৯ এবং ইউক্রেন- রাশিয়া যুদ্ধের কারণে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতি কিছুটা শ্লথ হয়েছে। কিন্তু তারপরও জোসে ভিনাল আশাবাদী যে আগামী ৫ থেকে ৭ বছরে বাংলাদেশের পক্ষে ৭% থেকে ৭.৫% জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জন করা সম্ভব। এই প্রবৃদ্ধি অর্জনের জন্য তিনি কিছু পরামর্শ দিয়েছেন। তার মধ্যে রয়েছে ব্যবসা করার পরিবেশকে সহজ করা, অর্থনৈতিক সুশাসন, প্রতিষ্ঠানসমুহ এবং আইনের শাসনকে শক্তিশালী করা, অর্থনীতি এবং রপ্তানিকে ক্রমাগত বহুমুখী করা। এছাড়া তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভৌত এবং ডিজিটাল অবকাঠামো নির্মাণ এবং মানব সম্পদ উন্নয়নের পরামর্শ দেন।
জোসে ভিনাল বলেছেন যে বাংলাদেশ স্বল্প মেয়াদি চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে পারলে এবং কাঙ্ক্ষিত প্রবৃদ্ধি ধরে রাখতে পারলে মধ্য মেয়াদে খুব ভালো করতে পারবে। তিনি বলেন সুশাসনের সমস্যা অনেক দেশেই আছে। প্রতিষ্ঠানসমুহ এবং অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করাকেও গুরুত্ব দিতে হবে। অভ্যন্তরীণ এবং বৈদেশিক বিনিয়োগ নিশ্ছিত করার জন্য প্রয়োজনীয় আইনগত স্থিতিশীলতার প্রয়োজন আছে। ২০২৬ সালে স্বল্প উন্নত দেশ থেকে বাংলাদেশের উত্তরণ ঘটলে কিছু আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক এবং বাণিজ্যিক সুবিধা বাংলাদেশ আর পাবে না। তিনি বলেছেন তখন বাংলাদেশকে আরও বেশী প্রতিযোগিতার জন্য তৈরি হতে হবে এই উত্তরনকে স্থায়ী করার জন্য।
জোসে ভিনাল বলেছেন যে ইতিমধ্যেই বাংলাদেশ বিশ্বের কাপড় তৈরির কারখানা হয়ে গেছে। চীনের পরেই বাংলাদেশের অবস্থান। জোসে ভিনাল বলেন যে বাংলাদেশ যদি তার সুযোগ সঠিকভাবে কাজে লাগাতে পারে তাহলে অনেক ক্ষেত্রেই সুপার স্টার হয়ে যেতে পারবে। তিনি বলেছেন রপ্তানিকে আরও বহুমুখী করা গেলে এই সাফল্য বাংলাদেশ অর্জন করতে পারবে। অনেক কোম্পানি এখন উত্তর এশিয়া বিশেষত চীন থেকে স্থানান্তরিত হয়ে দক্ষিণ পূর্ব এশিয়া এবং দক্ষিণ এশিয়ায় যাচ্ছে। জোসে ভিনাল বাংলাদেশের শ্রম শক্তির প্রশংসা করেন এবং বলেন যে সস্তা হওয়ার কারণে এই শ্রম শক্তি আন্তর্জাতিকভাবে প্রতিযোগিতা মুলক। এই অবস্থাকে তিনি বাংলাদেশের জন্য একটা অনন্য সুযোগ বলেছেন।
জোসে ভিনাল বলেন যে কয়েকটি কারণে বৈশ্বিক সাপ্লাই চেইন বাণিজ্যে বাংলাদেশ ক্রমাগতভাবে আরও অনেক সুযোগ লাভ করতে পারে। এই কারণগুলির মধ্যে রয়েছে স্বল্প উৎপাদন খরচ, ভৌগলিক অবস্থান, ইউএস- চায়না বাণিজ্যিক সংঘাত, এই অঞ্চলের ভু- রাজনৈতিক ইস্যু। তিনি বলেন এই সাফল্যকে টেকসই করার কিছু শর্ত আছে। তার মধ্যে আছে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা, শক্তিশালী প্রাইভেট এবং সরকারী প্রতিষ্ঠান, শক্তিশালী অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠান এবং সুশাসন। তিনি মনে করেন সঙ্কটকে ভিন্নভাবে দেখলে সেটাকে সুযোগে রুপান্তর করা যায়। অল্প সমস্যার পরিবেশে থাকলে বড় এবং গভীর সঙ্কটগুলোর সমাধান করতে দেরী হয়।
জোসে ভিনাল বলেন বাংলাদেশকে এখন বৈদেশিক মুদ্রার বাজার এবং রিজার্ভ স্থিতিশীল করতে হবে। এছাড়া মধ্য মেয়াদি উন্নয়নের ভিত্তি তৈরি করতে হবে। আইএমএফের সাথে ঋণ চুক্তিকে তিনি ইতিবাচকভাবে দেখেছেন (ওনার সাক্ষাৎকারের সময় ঋণ চুক্তির কথা চলছিল।)। কারণ তিনি মনে করেন বর্তমানের স্বল্প মেয়াদী ব্যালেন্স অব পেমেন্ট এবং বৈদেশিক মুদ্রার সমস্যার সমাধানে এই ঋণ সাহায্য করবে। তিনি বলেন সৌভাগ্যক্রমে বাংলাদেশের অবস্থা একটু ভিন্ন কারণ বাংলাদেশের উঁচু মাত্রার বৈদেশিক ঋণ নেই। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমে গেলেও কয়েক মাস চালিয়ে যাওয়ার জন্য যথেষ্ট। তিনি গ্লোবালাইজেশনকে সমর্থন করেন। কারণ গ্লোবালাইজেশনের কারণে মানুষের আয় বেড়েছে এবং দরিদ্রতা কমেছে। বাংলাদেশেরও গ্লোবালাইজেশন প্রয়োজন। বিভিন্ন কারণে বিশ্বের অর্থনীতিতে বাংলাদেশের মত ‘বৈশ্বিক কারখানা’ র প্রয়োজন আছে।
তিনি বলেন বাংলাদেশের নিজের হাতের মধ্যে তার ভবিষ্যৎ সাফল্য লুকিয়ে আছে। মধ্য মেয়াদে বাংলাদেশ কি ধরণের পদক্ষেপ নিবে তার উপর এই সাফল্য নির্ভর করছে। তিনি মনে করেন ২০২২ সালের তুলনায় ২০২৩ সালে বিশ্বের এই সঙ্কটময় পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হবে।
জোসে ভিনাল বাংলাদেশের প্রশংসা করে বলেছেন যে মাথাপিছু আয়ের প্রবৃদ্ধি এবং অর্থনীতির আকার বিবেচনায় নিলে বাংলাদেশের বর্তমান অবস্থা আগের চেয়ে ভালো এবং বিশ্বের অনেক দেশের তুলনায় অনেক ভালো। তিনি বলেছেন আপনারা আধা ট্রিলিয়ন ডলার অর্থনীতির কাছাকাছি আছেন। এটা অনেক বড় একটা অর্জন। মধ্য মেয়াদে ১ ট্রিলিয়ন ডলার অর্থনীতির অধিকারী হওয়ার মত সুযোগ আপনাদের আছে। সব শেষে তিনি বলেন যে অভ্যন্তরীণ চ্যালেঞ্জগুলি মোকাবেলার করার লক্ষণ দেখা যাচ্ছে কি না সেটা দেখতে হবে। উচ্চ প্রবৃদ্ধি এবং টেকসই উন্নয়নের পথে যেতে হলে এই চ্যালেঞ্জগুলি মোকাবেলা করতে হবে। তিনি বলেন যে আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি যে চ্যালেঞ্জ মোকাবেলার এই গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলি করা হবে।
এই বার আমি আমার ব্যক্তিগত মতামত জানাচ্ছি। জোসে ভিনাল বাংলাদেশকে সম্ভবনাময় একটা দেশ হিসাবে দেখেছেন। আমিও সার্বিকভাবে ওনার বক্তব্যের সাথে একমত। কিছু চ্যালেঞ্জ যদি আমরা মোকাবেলা করতে পারি তাহলে আসলেই এই দেশের অনেক সম্ভাবনা আছে। জোসে ভিনাল অনেক কিছু বললেও দেশের অপরাজনীতি এবং নিম্ন মানের গণতন্ত্র নিয়ে কিছু বলেন নি। এই দেশের ঋণ খেলাপি সংস্কৃতি, বিলিয়ন ডলার অর্থ পাচার, সর্বগ্রাসী দুর্নীতি, বেকারত্ব ইত্যাদি নিয়ে তেমন কিছু বলেন নি। আমার মতে এই বিষয়গুলি নিয়েও আমাদের রাষ্ট্র নায়কদের ভাবতে হবে। তা না হলে উন্নয়ন ঘটলেও সেটার সুষম বণ্টন হবে না। গরীব এবং অনাহারী মানুষের অবস্থা আগের মতই থাকবে। উনি বিদেশী মানুষ হিসাবে যা বলেছেন সঠিক বলেছেন বলে মনে হয়। কিন্তু এই বাড়তি সমস্যাগুলি নিয়েও আমাদের নিজেদের ভাবতে হবে।
সূত্র- ডেইলি স্টার
ছবি - উইকিপিডিয়া এবং ব্লু মবার্গ
সর্বশেষ এডিট : ১৭ ই জুন, ২০২৩ দুপুর ১২:২৭