বর্তমান ও অতীতের মাঝে যে সাঁকো—তার নাম ইতিহাস। দুয়ের সম্মিলনেই তৈরি হয় পথরেখা। সেই পথরেখা ধরে মানুষকে ফিরে আসতে হয় নিজেদের ইতিহাসের কাছেই। বর্তমান এবং ভবিষ্যেক যথার্থভাবে অনুধাবন করতে ইতিহাসচর্চার বিকল্প নেই। অতীতের কর্মধারা এবং কর্মপদ্ধতি জেনে বর্তমান পদক্ষেপ নেয়া সহজতর হয়। বর্তমানের পরিকল্পনা, কাজগুলোও তো প্রকৃতপক্ষে ভবিষ্যত্ অভিমুখী। অতীতের সমাজ-সংস্কৃতি ক্রমে রূপান্তরিত হয়ে বর্তমান ও ভবিষ্যতের দিকে অগ্রসরমাণ। তাছাড়া নিজেদের শেকড় সম্বন্ধে অবহিত হওয়ার ক্ষেত্রে ইতিহাসের ভূমিকাই মুখ্য। ইতিহাসের পদচিহ্ন ধরে অগ্রসর হলে মানবগোষ্ঠী একদিন ঠিকই পৌঁছবে সমৃদ্ধির সোনালি প্রান্তরে। ইতিহাসচর্চা মূলত দুইভাবে হয়ে থাকে— এক. জাতীয় পরিমণ্ডলে, দুই. আঞ্চলিক পরিমণ্ডলে।
তৃণমূল পর্যায় থেকে অর্থাত্ আঞ্চলিক পরিমণ্ডল থেকে ইতিহাসের পঠন-পাঠন শুরু করলে জাতীয় ইতিহাস জানা ও বোঝা সহজতর। সামগ্রিক ইতিহাসকে একটা ভবনের সঙ্গে তুলনা করলে আঞ্চলিক ইতিহাস অভিহিত হবে তার সিঁড়ি হিসেবে।
সিলেটের অর্থনীতি ও সমাজ বইটি রচিত হয়েছে সিলেটকে নিয়ে। বর্তমান সিলেট নয়, প্রাচীন সিলেট। অঞ্চলটি পরিচিত ছিল শ্রীহট্ট নামে। তাহলে বইয়ের নামে সিলেট শব্দটি কেন, লেখক যেখানে পরিচিত করাচ্ছেন প্রাচীন সিলেটকেই—প্রশ্ন জাগা স্বাভাবিক। ভূমিকাংশে লেখক এ প্রশ্নের উত্তরের পাশাপাশি যৌক্তিক ব্যাখ্যাও দিয়েছেন।
বইয়ে স্থান পেয়েছে দেশের সমৃদ্ধ একটি অঞ্চলের নির্দিষ্ট সময়ের ইতিহাস। যে ইতিহাসে ক্রমে উঠে এসেছে ঐতিহ্যের সোনালি আকর ও একটি জনগোষ্ঠীর ইতিবৃত্ত। সিলেট অঞ্চল নানাভাবে, নানারূপে বাংলাদেশের জন্য উল্লেখযোগ্য। সুপ্রাচীনকাল থেকে সিলেটের যে ইতিহাস, তা কালে কালে বিবর্তিত হয়েছে। রবীন্দ্রনাথের কলমে এভাবে ধরা পড়েছে সিলেট—মমতাহীন কালস্রোতে/বাংলার প্রান্তসীমা হতে/নির্বাসিতা তুমি/সুন্দরী শ্রীভূমি। কবির এ মূল্যায়নে ভালোবাসা যেমন আছে, তেমনি আছে ক্ষোভও। তত্কালীন বাংলায় সিলেট ছিল আসামের শাসনাধীনে। সঙ্গত কারণেই বৈষম্য ছিল, আর এ বৈষম্যে সিলেট দীর্ঘদিন থেকেছে উন্নয়নবঞ্চিত, অধিকারহীন। শাসনতান্ত্রিক জটিলতার কারণে আসামের সঙ্গে সিলেটের একীভূত হতে সময় লেগেছে।
এ বইয়ের লেখক ড. ইফফাত্ জাহান লেখালেখির ভুবনে পরিচিত মুখ নন। কিন্তু উদ্যমী এ মানুষ অসামান্য এক কাজ সম্পন্ন করেছেন যা প্রতিষ্ঠিত, প্রজ্ঞাবান ও যশস্বী লেখকও করতে পারেননি তথা করার সাহস করেননি। সিলেটকে নিয়ে কাজ কম হয়নি। কাজ বলতে গবেষণা, মূল্যায়ন, ইতিহাস-ঐতিহ্য ইত্যাদি ফিরে দেখা। তবে সে কাজের বেশিরভাগই ছড়ানো-ছিটানো এবং আনাড়ি হাতের করা। অনুল্লেখ্য। এত দীর্ঘ সময় বেছে নিয়ে সেটার চুলচেরা বিশ্লেষণ, এর আগে তেমন একটা হয়নি বললেই চলে। সুতরাং এ বইয়ের মূল্যায়ন তথা আলোকপাত, মূল্যবান ঐতিহাসিক দলিলও।
মোটামুটি বড়সড় কলেবরের এ বই প্রকৃতপক্ষে তাঁর পিএইচডি অভিসন্দর্ভ। কলকাতার যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে ড. অনুরাধা চন্দ ও ড. রতনলাল চক্রবর্তীর তত্ত্বাবধানে ২০০২ সালে এ গবেষণাকর্মের মাধ্যমে লেখক ডক্টরেট ডিগ্রিলাভ করেন।
স্মর্তব্য, তিনি সিলেটি নন, নন-সিলেটি। পাবনায় জন্মগ্রহণ করেও সিলেটের প্রতি অনুভব করেছেন এক নিবিড় টান। হাজার হোক দেশের মাটি তো! ‘সুন্দরী শ্রীভূমি’ সিলেটের প্রতি ভালোবাসা এবং দেশের অন্যতম সমৃদ্ধ এ জনপদ যে বহুলাংশে বিষয়বৈচিত্র্যে ভরপুর—দুয়ে মিলে তাঁকে উদ্বুদ্ধ করেছে পিএইচডি অভিসন্দর্ভের বিষয় হিসেবে এটাকে বেছে নিতে। ড. ইফফাত্ জাহান সময়কাল হিসেবে বেছে নিয়েছেন ১৭৬৫ থেকে ১৮৮৫ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত। এই ১২০ বছরের ইতিহাস প্রাঞ্জল ভাষায় মূর্ত হয়ে উঠেছে। তাঁর গদ্য ক্লান্তিমুক্ত। ঝরঝরে গদ্যের নিবিড় বুননে পাঠক নিবিষ্ট হয় খুব সহজেই।
লেখক মোট ৬টি ভাগে ভাগ করেছেন ১২০ বছরের সিলেটকে। অধ্যায়গুলো যথাক্রমে—বাংলাদেশের ইতিহাসচর্চা ও সিলেট প্রসঙ্গ, সিলেটের ভূমি রাজস্ব প্রশাসন ও ব্যবস্থাপনা, ঔপনিবেশিক আমলে সিলেটের অর্থনীতি, সিলেটে ঔপনিবেশিক শাসন ও স্থানীয় প্রতিক্রিয়া, সিলেটের শিক্ষা ও সংস্কৃতি, সিলেটের সমাজ।
পরিশিষ্ট অংশে যোগ করেছেন ৯টি অধ্যায়। পরিশিষ্টের শেষ অংশ অর্থাত্ সিলেটের বিদ্ব্যত্সমাজ শীর্ষক রচনায় আমরা পরিচিত হই তত্কালীন কিছু কৃতী ব্যক্তিত্বের সঙ্গে। কৃতী ব্যক্তিদের আখ্যানে লেখক কারও জন্ম-মৃত্যুর সন দুটোই উল্লেখ করেছেন। লেখক ইফফাত্ জাহানের বড় একটি সততা হলো, প্রতিটি তথ্যপ্রাপ্তির উত্স সম্বন্ধে নিশ্চিত করা। কেউ কেউ গোয়ার্তুমি করে বা নিজের ‘উচ্চ আসন’ বহাল রাখতে তথ্যঋণ স্বীকারের তোয়াক্কা করেন না।
সবমিলিয়ে বইটি সুন্দর। চমত্কার বাঁধাই, ঝকঝকে ছাপা, নির্ভুল অক্ষরবিন্যাস বইটিকে করেছে সুষমামণ্ডিত।
সিলেটের অর্থনীতি ও সমাজ
ড. ইফফাত্ জাহান
প্রকাশক : উত্স প্রকাশন, প্রকাশকাল : ফেব্রুয়ারি ২০১০, প্রচ্ছদ : নিলয় হাসান ও দাম ৪২০ টাকা
(দৈনিক আমার দেশ, সাহিত্য সাময়িকী, ২৩.০৯.২০১১)