১৯৪৭ সালে ভারত ও পাকিস্তান নামে দুটি রাষ্ট্রের জন্মের সময় সৃষ্ট দাঙ্গায় বহু লোকের প্রাণহানী ঘটে। ইতিহাসে এর প্রমাণ বিদ্যমান।
কিন্তু এর এক বছর পর ১৯৪৮ সালে মধ্য ভারতে আর একটি নৃশংস মুসলিম গণহত্যা ঘটে, তা সম্পূর্ণ লুকিয়ে ফেলে ভারতীয় যালিম হিন্দুরা। সম্প্রতি খুঁজে পাওয়া এক গোপন তদন্ত প্রতিবেদনে সেই সত্য উন্মোচিত হয়েছে। ঘটনাটি ঘটে ভারতের হায়দারাবাদে। দিনটি ছিল ১৭ই সেপ্টেম্বর ১৯৪৮ ঈসায়ী। কিন্তু পরবর্তীতে এই ইতিহাস সম্পূর্ণরূপে লুকিয়ে ফেলে উগ্র-হিন্দুত্ববাদী কংগ্রেস নেতারা।
উল্লেখ্য, ১৯৪৭ সালে স্বাধীন হওয়ার আগ পর্যন্ত ভারতে প্রায় ৫৪৪টি স্বাধীন রাজ্য (অঞ্চল) ছিল। এর অন্যতম ছিল মুসলমান নিজাম বা নবাব শাসিত হায়দারাবাদ রাজ্য। এটি না ছিল ভারত ইউনিয়নের অংশ, না ব্রিটিশ শাসিত এলাকা। রাজ্যটির ছিল নিজস্ব মুদ্রা, রেল ব্যবস্থা, ডাক বিভাগ, বিচার বিভাগ এবং নিজস্ব সেনাবাহিনী। হায়দারাবাদের আয়তন বর্তমান ফ্রান্সের আয়তনের প্রায় দ্বিগুণ।
স্বাধীন হওয়ার পর প্রায় সব রাজ্য ভারতের অঙ্গে পরিণত হতে রাজি হলেও নিজাম, মাহবুব আলী খান রাজি হননি। তিনি স্বাধীন থাকতে চেয়েছিলেন। ফলে ক্ষিপ্ত হয়ে উঠে নতুন দিল্লির হিন্দুত্ববাদী কংগ্রেস নেতারা। তাদের দাবি, এটি হিন্দুত্ববাদীদের দেশ, আর এর বুকের মাঝে থাকবে একটি মুসলমান দেশ! তা কখনোই মেনে নেয়া সম্ভব নয়।
১৭ই সেপ্টেম্বর ১৯৪৮ ঈসায়ী তারিখে হিন্দু যালিম সেনাদের লেলিয়ে দেয়া হয় হায়দারাবাদের নিরস্ত্র এবং অপ্রস্তুত মুসলমানদের উপর। গান্ধী পরিবারের অন্যতম এবং তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরু আগ্রাসনের অজুহাত হিসেবে দাঁড় করায়, হায়দারাবাদের হিন্দুদের চলে যাওয়ার জন্য হুমকি-ধামকি দেয়া হচ্ছে।
শুরু হয়ে যায় গণহত্যা। এই গণহত্যা ইতিহাসে ‘অপরেশন পোলো’ নামে কুখ্যাত। সেই দিন মুসলিম জনগোষ্ঠীর উপর হিংস্রতাবাদী হিন্দুরা যে নৃশংস গণহত্যা চালিয়েছিল ইতিহাসে তার নজির নেই। লক্ষ লক্ষ মুসলমানকে সেইদিন লাইনে দাঁড় করিয়ে গুলি করে হত্যা করে ভারতীয় যালিম সেনারা।
ঠিক কতজন মুসলমানকে সেইদিন শহীদ করা হয়েছিল তার সঠিক হিসেব পাওয়া যায় না, একটি রিপোর্টে পাওয়া যায় ২৭-৪০ হাজার, অন্য একটি রিপোর্টে দুই লক্ষ, আরেকটি রিপোর্ট পাওয়া যায় ১০ লক্ষ। সেই দিন কোনো বয়স্ক মুসলিম পুরুষকে রেহাই দেয়নি যালিম হিন্দুরা। হায়দারাবাদের নদীর পানি সেই দিন লাল বর্ণ ধারণ করে। সম্ভ্রমহানী করা হয় অগণিত মুসলিম মা-বোনকে। ইতিহাসবিদগণের মতে, শুধু সম্ভ্রম বাঁচাতে পালাতে গিয়ে লক্ষাধিক মা-বোন সেই দিন নদীতে পড়ে মারা যায়।
গণহত্যা শেষে হাজার হাজার ট্রাক ভরে লুটপাটকৃত সম্পদ নিয়ে যায় লুটেরা হিন্দুরা। একই সাথে ধ্বংস করে দেয়, বহুদিন ধরে গড়ে উঠা হায়দারাবাদের মুসলিম ঐতিহ্য, শিল্প ও সংস্কৃতি।
গণহত্যার পরে হিন্দুত্ববাদী নেতারা এটিকে “পুলিশি অভিযান” বলে প্রচারণা দেয়। মিথ্যা বলা হয়, এই অভিযানে বেসামরিক নাগরিকদের উল্লেখযোগ্য মৃত্যু ছাড়াই নিজামের বাহিনী পরাজিত হয়।
বিষয়টিকে নিয়ে সে সময় একটি তদন্ত কমিটিও গঠন করা হয়। এর নেতা ছিলো এক হিন্দু কংগ্রেস সদস্য সুন্দরলাল। সে রিপোর্টে উল্লেখ করে, ‘আমরা রাজ্যের কয়েক ডজন গ্রাম ঘুরে দেখে এবং ঘটনা তদন্ত করে সুস্পষ্ট প্রমাণ পেয়েছি যে, ভারতীয় সেনাবাহিনী ও স্থানীয় পুলিশের সদস্যরা সেখানে মুসলমানদের সম্পদ লুটপাট ও অন্যান্য অপরাধে অংশ নিয়েছে। তারা হিন্দু জনতাকে মুসলমানদের ঘরবাড়ি, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান লুট করতে কেবল উৎসাহিতই নয়, বরং বাধ্যও করেছে। তারা মুসলমানদের নিরস্ত্র করেছে, কিন্তু হিন্দুদের অস্ত্র বহনে বাধা দেয়নি।’
তদন্তকারী সুন্দরলাল উল্লেখ করে, ‘মুসলমান হত্যায় ভারতীয় সেনারা সক্রিয়ভাবে অংশ নিয়েছে। তারা প্রাপ্তবয়স্ক মুসলমান পুরুষদের ধরে ধরে ঠা-া মাথায় হত্যা করেছে।’
তার রিপোর্টে ওই দাঙ্গায় নিহত মুসলমানদের সংখ্যা উল্লেখ করা হয় ২৭ হাজার থেকে ৪০ হাজার।
রিপোর্টের সঙ্গে যুক্ত কনফিডেনশিয়াল নোটে হিন্দুদের নৃশংসতা কত ভয়াবহ ছিল, তার বর্ণনা দিতে গিয়ে রিপোর্টের লেখকরা বলেছে- ‘অনেক জায়গায় আমাদেরকে মৃতদেহ ভর্তি কুয়া দেখানো হয়েছে। ভেতরে মৃতদেহ পচছে। ওর মধ্যে মায়ের স্তন পান করতে থাকা অবস্থায় মারা যাওয়া মা-সন্তানের লাশও ছিল। অনেক জায়গায় পোড়া লাশ দেখেছি আমরা। পোড়া হাড়গোড়, খুলি দেখেছি।’
সুন্দরলালের রিপোর্ট এতদিন অপ্রকাশিত ছিল। কেন ছিল? অবশ্যই সেই হিন্দুত্ববাদী শাসকরাই তা লুকিয়ে রেখেছিল।
তবে সম্প্রতি সেটা অবমুক্ত করা হয়েছে। দিল্লির নেহরু মেমোরিয়াল মিউজিয়াম অ্যান্ড লাইব্রেরীতে সবার জন্য উন্মুক্ত আছে সে রিপোর্ট।