আমার মেয়ে বলল ল্যান্ডিং ঠিক হল না । আমিও বললাম সত্যি ল্যান্ডিং ভাল হয়নি । আমার জীবনে সিঙ্গাপুরএয়ারলাইন্সের মত স্মুথ ল্যান্ডিং আর পাইনি । আমার ভাগ্নি মানে আমার শালীর মেয়ে প্রমা এসেছে আমাদের রিসিভ করতে । ও গেল ৫ বছর হয় কক্সবাজারে জব করছে । হোটেলের সামনে নেমেই দেখি সাগর রীতিমত গর্জন করছে , জোয়ার চলছে । কিন্তু একি ? এতোগুলো মরা তিমি পাড়ে শুয়ে আছে !! আমার পায়ের কাছে একটি ৪০ ফিট লম্বা । গন্ধ টন্ধ নেই । প্রমা বলল খালু চশমা মোছ , ওগুলো জিও লাইট ফ্যাব্রিকে বালু ঢুকিয়ে শক্ত করা হয়েছে ভাঙ্গন থেকে রক্ষা পেতে । রুমে গিয়ে বারান্দায় দাড়িয়ে আশ্চর্য এক দৃশ্য দেখছি । ঢেউ এর পর ঢেউ আছড়ে পড়ছে সৈকতে । ফেনায়িত ঢেউ আমার ভেতরে ঢেউ আর নর্তন তুলল , জামাই জিহান আমার পাশে দাড়িয়ে আনন্দে উছলে পড়ছে । হোটেল লোকেশন খুবই ভাল । সমুদ্র পাড়ে , নির্জন , নিরাপদ । হোটেল এক্সোটিকা সাম্পান ।
দুপুরে ঝাউতলা রেস্টুরেন্টে খেলাম । ঢাকা থেকে প্রতিজ্ঞা করেছি মাংস নয় মাছ হবে আমাদের মেইন কোর্স । বিকালের ভাটাতে হেটে হেটে সৈকতে ঘুরে ঘুরে কাটালাম । রাত ১১ টায় জোয়ারের অতিরিক্ত গর্জন কেন জানি খুব বেশি মনে হল । আমি শিহরিত , সাথে জিহান । সমুদ্র পাড়ে ৬ তালা থেকে ঢেউয়ের খেলা দেখায় একটা অদ্ভুত বোধ কাজ করে । ঢেউয়ের কনসার্ট অসাধারন । যেমন রাগ সমুন্দর বা রাগ গর্জন ।
কত গজরালে তুমি হও সমুদ্র
নিথর বহমান আমি হই নদী !!
আমি দুহাত তুলে কনসার্টে লিড দিতে থাকলাম ।
আমরা টেকনাফ যাব । মেরিন ড্রাইভ হোটেলের কাছ থেকেই শুরু হয়েছে । ব্যাটারি চালিত স্কুটার একদিকে উচু মাটির পাহাড় আর এক দিকে সমুদ্র পার হয়ে সামনে এগুচ্ছে । চিকন সুপারি গাছ , এতো এতো গাছ , বিস্মিত হলাম । মেরিন ড্রাইভের গাছপালা একটা অদ্ভুত শীতল হাওয়া বিতরন করছিল । খাড়া মাটির পাহাড় বিপজ্জনক যদিও এর নিচে কোন মানুষ বাস করে না । ঝাউ গাছের পরিমান বেশি মনে হল । সামনে চেক পোস্ট , একজন বি জি বি দাড়িয়ে । এটা সেই জায়গা যেখানে মেজর সিনহাকে হত্যা করা হয়েছিল । চালক সামনের স্কুটার চলে গেলে দাড়িয়ে থাকা গার্ডের পাশে দাঁড়ালো । গার্ড বলল আবারো ঘুরে পিছনে গিয়ে দাড়াও । আমরা ঘুরে পিছনে গেলাম বটে কিন্তু লাইনে দাঁড়ালাম না । প্রমা চালককে বলল চলো ফেরত যাই । আমি হতভম্ব । আমরা কক্সবাজার মুখী হলাম । ব্যাপারটা কি ? গার্ড এই স্কুটারকে ইশারা করার আগেই চালক তার কাছে কেন গেছে । আমাদের শুদ্ধ শাস্তি দিল । মনটা ভেঙ্গে গেল । আমাদের আগে পিছনে কোন যান ছিল না । বি জি বির মনে হয়েছে তাই আমার মত সিনিয়র নাগরিককে শাস্তি দিল , লজ্জা , ধিক । আমরা এগুচ্ছি আর পুরো স্কুটারে সবাই হো হো করে হাসছে । বিজিবি গার্ড আমাদের স্কুটারের দিকে নিস্পলক তাকিয়ে যদিও তিনটি গাড়ি লাইনে দাড়িয়ে গেছে । সে হয়ত ভাবছে কত্ত সাহস এই ব্লাডি সিভিলিয়ানদের । আমার আদেশ না মেনে ফেরত যাচ্ছে !!
ফেরার পথে অনেক সাম্পান শুকনো ডাঙ্গায় দাড়িয়ে , নেমে ছবি সেশন । এখানে একটা খাল ঢুকে গেছে ভেতরে তার পাশেই কমলা রঙের শ্বাসমুল সহ কেওড়া গাছ । সুন্দরবনের এই গাছ কেউ এনে লাগিয়েছে । বেশ তরতর করে বেড়েছে । হরিনের খাদ্য কেওড়া পাতা । এরা জঙ্গলের মত বাড়তে থাকে । হয়ত ভবিষ্যতে হরিন এনে ছাড়বে এখানে । সামনের অংশে কালো রঙের কোরাল , ফটো সেশন আবার ।
হিমছড়ি এসে প্রমা সিদ্ধান্ত নিল দুপুরে এখানেই খাবো । সামনেই বীচ , পাশের একটি কাত হয়ে থাকা দালান দেখিয়ে প্রমা বলল এই দালানে প্রথম বাস করেছি প্রথম কক্সবাজারে যখন আসি । বিশাল ঝড়ে দালান কাত হতে গেলে আমি কক্সবাজার গিয়ে থাকা শুরু করি । হিমছড়ি ঝর্না বন্ধ সেই লক ডাউন এর সময় থেকে । ছুরি মাছের অসাধারন ভর্তা খেলাম । সবাই প্রশংসা করল । লইটটা মাছের ফ্রাই বেস্ট সি ফুড কাফেতে । আবারো ফেরত যাওয়া । আমরা বাকি সময় বীচে , হোটেলের বারান্দায় কাটিয়েছি । শহরে ভিতর প্রাসাদ প্যারাডাইস আর শালিক খুব ভাল মাছের গ্রিল করে , সুস্বাদু । অতিরিক্ত ভিড়ের কারনে আমরা সুগন্ধা , কলাতলী বীচ এড়িয়ে গেছি । আমাদের হোটেলের বীচ চমৎকার । আসন্ন নভেম্বর থেকে টুরিস্ট সিজন চালু হবে বিধায় আমরা আগেভাগে ঘুরে এলাম । সমুদ্র মনকে বিশালতা দেয় , শুদ্ধ হাওয়া শরীরকে তাজা করে তোলে ।
ছাত্র ছাত্রীদের জন্য সরকার বিস্তীর্ণ মেরিন ড্রাইভে সস্তা ডরমিটরি করতে পারে । এদের অনেকেই বীচ চেয়ারে সস্তায় রাতে ঘুমায় । যা সবসময় নিরাপদ নয় । একটা টুরিস্ট জোন হিসাবে কক্সবাজার গড়ে ওঠেনি , টাকা লুট করার জোন হিসাবে গড়ে উঠেছে ।
সর্বশেষ এডিট : ১৯ শে অক্টোবর, ২০২১ রাত ৯:৪১