
সকালে স্কুলে যাওয়ার আগে নিচে নেমে রান্না ঘরে ঢুকে খেতে বসেছি , কাকিমা বললেন কাল রাতে আমাদের মহিষগুলো দড়ি ছিঁড়ে গেট ভেঙ্গে পালিয়ে গেছে । বেশ চমকিত খবর । স্কুলে যাওয়ার আগে রাস্তার মোড়ে দাদা আর দু তিনজন আলাপ করছেন দাড়িয়ে । দাড়িয়ে শুনলাম দু তিন মিনিট । মমিনুদ্দিন মিয়া রওনা হয়ে গেছে হুড়কার পথে । সময়টা মহিষদের ঘাস খাবার , কয়েকদিন দেরি হয়েছে ব্যাস রেগে মেগে দড়ি ছিঁড়ে নিজেরাই সম্ভবত চলে গেছে । এইটাই যুক্তিযুক্ত সিদ্ধান্ত । স্কুল থেকে ফিরে বাড়ির উঠোনে মিয়া আর দাদা আলাপ করছে , তাদের ঘিরে বাড়ির অন্য মানুষেরা । আমিও দাড়িয়ে পড়লাম । হুড়কার এক হিন্দু গেরস্থ সকাল সকাল ১৪ টি মোষ একসাথে যাচ্ছে দেখে বুঝলেন কিছু বিপত্তি হয়েছে । রাখালহীন এই মহিষ পালিয়েছে । তিনি কায়দা করে মোষ গুলোকে খাবারের লোভ দেখিয়ে বাড়ির ভেতরে আটকে ফেললেন । মিয়া ১১ টা নাগাদ হাজির ঐ বাড়িতে । বাইরে থেকে দেখাই যাচ্ছিল মোষগুলো আমাদের । মিয়াকে পেয়ে তারা সমস্বরে হাম্বা হাম্বা শুরু করল । মিয়া তাদের গায়ে হাত বুলিয়ে গেরস্থকে মোষের মালিকের পরিচয় দিতেই তিনি শ শ ব্যাস্ত হয়ে আরও কিছু খড় কুটো আর চেয়ার এনে দিলেন । গেরস্থকে অনুরধ করলেন তাদের কাছাকাছি ঘাসের সন্ধান থাকলে কাউকে দিয়ে কেটে খাওয়াতে , টাকা পয়সা যা খরচ হয় দিয়ে দেব বলে অনুরোধ । সব রক্ষা হল মায়কি সন্ধ্যায় ভুষি খাওয়ানোর প্রতিশ্রুতি দিলেন গেরস্থ । মিয়া আগামিকাল ভোরে নাস্তা খেয়েই একটা নৌকা ধরে হুড়কার ঐ গ্রামে গিয়ে মোষ নিয়ে বাজুয়া যাবে পশুর নদী পার হয়ে । রাতে কিষানদের থাকার জায়গায় বসে মিয়ার সাথে আড্ডা । মিয়া আমায় বললেন মোষরাও রাতের আকাশে তারা দেখে চলে । বুড়ো মোষ গুলো অনেক দফা বাজুয়া গেছে লালন পালনের জন্য ।
মোষ খুব স্পর্শকাতর প্রাণী গরুর চেয়েও । মিয়া কাল ভোরে রওনা হবেন , আমি হুক্কাতে দুটো টান দিয়ে দোতালায় আমার থাকার রুমে চলে এলাম । চাদের আলোয় সয়লাব চারিদিক । ইজি চেয়ারে বসে একটা সিগারেট ধরিয়ে বেশ ভাবনায় ডুবে গেলাম মোষের জীবন আর প্রকৃতির রুপ নিয়ে ।
আজ রবিবার । ভোরে উঠেই নাস্তা না খেয়ে আমাদের বাথানে চলে এলাম । বাঁশের গেট ভেঙ্গেছে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে । ভেতরে শক্ত কাঠের খুঁটির সাথে পুরাতন মোটা দড়ি যেভাবে ছিঁড়েছে দেখে আশ্চর্য স্তম্ভিত হয়ে গেলাম । কেউ সাহায্য করেনিত !! না তেমন লক্ষন নেই । চাচাত ভাই এসে গেছে , তার সাথে দাড়িয়ে একটা সম্ভাব্য পরিনতির কথা গাতথে লাগলাম । আমরা একই ক্লাসে পড়ি , একই রুমে ঘুমাই । শেষ প্রান্তে গরুগুলো নির্জীব দাড়িয়ে , ওরাই একমাত্র সাক্ষী ঐ রাতের ঘটনার । ভাই তাদের দিকে চেয়ে বলল তোদের চান্স নেই তাই তোরা পারিসনি দড়ি ছিঁড়তে । বোকা হাদারাম । আসলে মহিষের সাথে গরুগুলোও যায় , এবার মিস হয়ে গেল ।
মাথার মধ্যে মহিষ ঘুরছে । খেতে খেতে কাকিমাকে গোয়াল ঘরের গল্প বললাম । বাড়ির অন্যান্য মহিলারা রান্না ঘরের বারান্দায় বসে আমার গল্প বলা শুনছিল । কাকিমা অভয় দিলেন দেখ ওরা ঠিক সময়ে বাজুয়া পৌঁছে চার মাস বাদে এসে পড়বে । কাণ্ডারি ঐ মিয়া মাত্র । তাকেও পশুর নদী সাঁতরে পার হতে হয় মোষদের সাথে । কুমির আছে নদীতে । মিয়া হেসে ফেলেছিলেন আমার আতঙ্ক দেখে ।
বাজুয়া বাধ ঘেরা বিশাল এলাকা । এখানে সবুজ কচি ঘাস ভর্তি । দেখভাল করার মানুষেরা চুক্তি করে নেয় তবে মাদি মোষ পয়দা হলে তারা রেখে দেয় । এঁড়ে মোষ চলে মায়ের সাথে , কয়েক বছরে সেও জোয়াল টানতে শিখে যায় , তারপর আমৃত্যু তার সেবা গ্রহন করি আমরা ।
মিয়া ওদের পৌঁছে দিয়ে ফেরত এসেছিল পরদিন । চারমাস পরে আবার বাজুয়া গিয়ে মোষ নিয়ে ফেরত এলো মিয়া । আমি বাথানে গিয়ে মোষগুলোকে হাত বুলিয়ে আদর করতে লাগলাম । বাবা জীবিত থাকতে আমার নামে দুটো মোষ কিনেছিলেন । মিয়া দেখিয়ে দিলেন কোন দুটো তারা । ওরা সবাই সিমেন্টের ট্যাঙ্কি থেকে গরম ভুষি খাচ্ছে । আমি আদর করছি আমার মোষ দুটোকে । বাথানের গেটে ভিড় জমেছে গায়ের ছেলেপিলের । তারা পালিয়ে যাওয়া মহিষ দেখতে এসেছে ।
কপিরাইটঃ শাহ আজিজ
সর্বশেষ এডিট : ১৯ শে এপ্রিল, ২০২২ রাত ১০:০৯

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




