somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। হেলাল হাফিজকে নিয়ে গুনের যত কথা

১৪ ই ডিসেম্বর, ২০২৪ দুপুর ১২:৩৪
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

১৯৮৫ সালে নারায়ণগঞ্জের সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে কবি আবুল হাসান, শামসুর রাহমান, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, শক্তি চট্টোপাধ্যায়, মোহাম্মদ রফিক, রফিক আজাদ, মহাদেব সাহা ও নির্মলেন্দু গুণের সঙ্গে হেলাল হাফিজ (সবার বাঁয়ে) ।। । কিছু একটা ভুল হচ্ছে , এটি ৮৫ সালের নয় , আরও আগের ।





দ্রোহ আর প্রেমের কবি হেলাল হাফিজের চেয়ে আরেক কবি নির্মলেন্দু গুণ বয়সে বছর তিনেকের বড়। দুজনেরই বাড়ি নেত্রকোণায় হওয়ায় তাদের জানাশোনা বহু দিনের; তারুণ্যে একসঙ্গে অসংখ্য আড্ডার স্মৃতি তাদের।

‘এখন যৌবন যার মিছিলে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়’র স্রষ্টার প্রয়াণের কয়েক ঘণ্টা বাদে শুক্রবার রাতে সেই স্মৃতির ঝাঁপি খুললেন নির্মলেন্দু গুণ।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের সঙ্গে আলাপচারিতায় গুছিয়ে কথা বলতে পারছিলেন না তিনি। বার্ধক্যের ভারে নুয়ে পড়া গুণ তবু স্মৃতি হাতড়ে তুলে আনলেন পুরনো দিনের কথা।

নির্মলেন্দু গুণ বললেন, “আমার শরীরটাও তো ভালো যাচ্ছে না। হেলালের মৃত্যুর খবরটা জানলাম। শেষের দিকে তো যোগাযোগ খুব একটা হতো না।

“তবে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময়ে আমি আর আবুল হাসান যে কত দিন-রাত হেলালের ইকবাল হলের (জহুরুল হক হল) রুমটাতে আড্ডা দিয়েছি, তার হিসাব নেই।”

অকৃতদার হেলাল হাফিজের জীবনের শেষ দিনগুলো কাটছিল ঢাকার শাহবাগের সুপার হোম নামের এক হোস্টেলে। শুক্রবার দুপুরে বাথরুমে পড়ে গেলে তার মাথায় রক্তক্ষরণ হয়। পাশের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় (বিএসএমএমইউ) হাসপাতালে নেওয়া হলে চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।

কবি নির্মলেন্দু গুণ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “ও তো লেখালেখি শুরু করেছে একটু পরে। ওর একটা বড় অভিমান ছিল, সেই অভিমানের কারণেই একাকী থাকতো।

“হেলালের বাবা কিন্তু কবি ছিলেন। কিন্তু হেলাল লেখালেখিতে এসেছে পরে।”

কবি হেলাল হাফিজের জন্ম ১৯৪৮ সালের ৭ অক্টোবর, নেত্রকোণার আটপাড়া উপজেলার বড়তলী গ্রামে। শৈশব, কৈশোর, তারুণ্য কেটেছে নিজের শহরেই।

১৯৬৭ সালে নেত্রকোণা কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে ভর্তি হন। উত্তাল ষাটের দশক হয়ে ওঠে তার কবিতার উপকরণ।

ষাটের দশকে হেলাল হাফিজের কক্ষে আড্ডা দেওয়ার স্মৃতি হাতড়ে গুণ বলেন, “আমি প্রথম যখন ঢাকায় আসি, তখন হেলালের বড় ভাই দুলালের রুমে উঠেছিলাম। পরে তো হেলালের রুম হয়ে গেল আমার আর আবুল হাসানেরও রুম।

“এই রুমে আমরা কত আড্ডা দিয়েছি- তা ভোলার নয়। এসব কিছু কিছু আমার আত্মজীবনীতে লিখেছি।” ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে হত্যাযজ্ঞ চালায় পাকিস্তানি সেনাবাহিনী, সেই রাতে বিশ্ববিদ্যালয়ে থেকেও প্রাণে বেঁচে যান হেলাল হাফিজ।

নির্মলেন্দু গুণ বলেন, “২৫ মার্চে মেসে ছিলাম। দেখতে পাচ্ছিলাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গোলাগুলি হচ্ছে। হেলালকে নিয়ে চিন্তিত ছিলাম।

“২৭ মার্চ কারফিউ শিথিল হলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যাই। তখন তো ধরেই নিয়েছিলাম ও আর বেঁচে নেই। পরে দেখলাম, ছোট্ট একটা পোঁটলা নিয়ে হেলাল এক কোণা থেকে বেরিয়ে আসছে। ওকে জড়িয়ে ধরেছিলাম। এগুলো এখন বলতে গেলে ভুলে যায়। আমার আত্মজীবনীতে লিখেছি।”

১৯৮৬ সালে প্রকাশিত হেলাল হাফিজের প্রথম কবিতাগ্রন্থ ‘যে জলে আগুন জ্বলে’ কবিকে নিয়ে যায় জনপ্রিয়তার শীর্ষে। প্রকাশকের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়ে বইটি প্রকাশের ব্যবস্থা করেছিলেন নির্মলেন্দু গুণ।

তিনি বলেন, “ওর প্রথম কবিতার বইটা বের করার সময় আমিই প্রকাশকের সাথে কথা বলিয়ে দিয়েছিলাম। (জাতীয়) প্রেস ক্লাবেও আমার সঙ্গেই ও প্রথম প্রথম যেতো। আমি তো বেশিদিন এক জায়গায় থাকি নাই। “আমি প্রেস ক্লাবে যাওয়া কমিয়ে দিলাম। কিন্তু দেখলাম হেলাল যেতো। পরে তো প্রেস ক্লাবের পাশেই একটা হোটেলের রুমে থাকতো। ওর অনেক অভিমান ছিল।”

শেষ দিকে তেমন যোগাযোগ না থাকলেও ‘আত্মিক যোগাযোগ’ ছিল বলে ভাষ্য গুণের।

হেলাল হাফিজ কেন হোটেলে থাকতেন, কী তার অভিমান ছিল? সেই প্রশ্নের নানা ব্যাখ্যা দেওয়ার চেষ্টা করেছেন অনেকে। হেলাল হাফিজও বিভিন্ন সময় এ নিয়ে অল্পবিস্তর বলেছেন। তবু যেন রহস্যই রয়ে গেছে কবির জীবন।

হেলাল হাফিজের ভাই দুলাল আবদুল হাফিজ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “সে তো কবিতার মানুষ। জাতীয় প্রেস ক্লাবের সঙ্গে তার নিবিড় সম্পর্ক। প্রেস ক্লাবের পাশেই একটি হোটেল কক্ষে একাকী থাকত।

“আমরা তাকে বাসায় নিয়ে রেখেছিলাম। কিন্তু সে থাকেনি। অসুস্থ হয়েছিল, তখন হাসপাতালে চিকিৎসা করিয়েছি। সুস্থ হয়ে আবার হোটেলেই থাকা শুরু করে।”

এক দশকের বেশি সময় হেলাল হাফিজ রাত্রিযাপন করেছেন হোটেলে। ২০২০ সালে যখন কোভিড মহামারী শুরু হল, তার আগে তিনি সেগুনবাগিচায় কর্ণফুলী হোটেলে থাকতেন।

মহামারীর শুরুতে লকডাউনের বিধিনিষেধ আরোপ হলে প্রেস ক্লাব বন্ধ হয়ে যায়। খাওয়া দাওয়া নিয়ে কষ্টে পড়ে যান কবি।

বড় ভাই দুলাল আবদুল হাফিজ তখন কবিকে নিয়ে যান তার ইস্কাটনের বাসায়। কিন্তু পরিস্থিতি একটু ভালো হলে আবার হোটেলে ফিরে যান তিনি।

বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বাড়তে থাকে নানা জটিলতা। ডায়াবেটিস, কিডনি রোগ আর গ্লুকোমা কঠিন করে তোলে হেলাল হাফিজের জীবনকে। কয়েকবার হাসপাতালেও যেতে হয়।

কোভিড পরবর্তী সময় থেকে হেলাল হাফিজ শাহবাগের সুপার হোম হোস্টেলে থাকতেন জানিয়ে দুলাল হাফিজ বলেন, “এখানেও সে অসুস্থ হয়ে পড়েছিল। পরে তাকে সবাই হাসপাতালে ভর্তির পরামর্শ দিয়েছে। কিন্তু সে হোস্টেলেই থাকত।”

কবি মামুন খানেরও বাড়ি নেত্রকোণায়। হেলাল হাফিজের মৃত্যু খবর জানার পর শুক্রবার সন্ধ্যায় ছুটে এসেছিলেন হাসপাতালে।

সেখানে মামুন খান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “নেত্রকোণার সঙ্গে হেলাল হাফিজের একটু অভিমান ছিল। কিন্তু অভিমানটা ছিল প্রেমের।

“নেত্রকোণার মানুষও তাকে খুব ভালোবাসেন। তার জন্মদিনে কিছু সংগঠন প্রতি বছরই সেখানে অনুষ্ঠান আয়োজন করেন।”

হেলাল হাফিজ সবশেষ যে হোস্টেলে থাকতেন, সেই সুপার হোমের আরেক কক্ষের বাসিন্দা রূপম রোদ্দুর। গত তিন বছর ধরে তিনিই কবির দেখভাল করতেন।

রূপম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “উনি তো বিগত কয়েক বছর ধরেই একাকিত্বে ভুগছিলেন। শারীরিকভাবেও কিছুটা অসুস্থ ছিলেন। হাঁটাচলা ঠিকমত করতে পারতেন না।

“আমরা তাকে হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার জন্য বলেছি। উনি হাসপাতালে থাকতে চাইতেন না। দুপুরের দিকে তিনি বাথরুমে পড়ে যান। পরে হোস্টেলের লোকজন উনাকে হাসপাতালে নেন; চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।”

১৯৬৯ সালে গণঅভ্যুত্থানের সময় রচিত ‘নিষিদ্ধ সম্পাদকীয়’ কবিতাটি তাকে কবিখ্যাতি এনে দেয়। তার কবিতা হয়ে ওঠে মিছিলের স্লোগান।

‘এখন যৌবন যার, মিছিলে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়/এখন যৌবন যার, যুদ্ধে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়’ কালজয়ী কবিতার এ লাইন দুটি বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। পরবর্তীতে নব্বইয়ের স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের সময়ও কবিতাটি মানুষের মাঝে তুমুল সাড়া জাগায়।

তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘যে জলে আগুন জ্বলে’র ৩৩টির বেশি সংস্করণ বেরিয়েছে। দীর্ঘসময় নিজেকে অনেকটা আড়ালে সরিয়ে নিয়েছিলেন হেলাল হাফিজ।

আড়াই দশক পর ২০১২ সালে তিনি পাঠকদের জন্য আনেন দ্বিতীয় বই ‘কবিতা একাত্তর’। তৃতীয় ও সর্বশেষ বই ‘বেদনাকে বলেছি কেঁদো না’ প্রকাশিত হয় ২০১৯ সালে।

খুব কম লিখেছেন হেলাল হাফিজ। তবে তার কবিতা যেমন হয়ে উঠেছিল মিছিলের স্লোগান, তেমনই আবার হয়ে উঠেছিল প্রেমের চিঠির অনুষঙ্গ। কবিতা যে বই ছাড়াও কার্ড হয়ে বের হতে পারে, তাও দেখা যায় হেলাল হাফিজের ক্ষেত্রে।

---------------------------------------------------------------------------------------
আমার কথা # যা সম্ভবত করোনা সময়ে হেলাল কোন সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন ।।
ছাত্র জীবনে প্রেমে জড়িয়েছিলেন হেলাল , ক্লাস মেট ছিলেন তিনি । হটাত একদিন লাইব্রেরির কোনে নির্দিষ্ট জায়গায় বসে প্রেমিকা হেলালকে বলল আমার বিয়ে ঠিক করেছে বাড়ির লোকেরা । তোমার সাথে আর দেখা হবে না । স্তব্দ হয়ে গেলেন হেলাল । প্রেম ভালবাসার উপরে অভক্তি এসে গেলো । বাকি জীবনে প্রেম বিয়ে নিয়ে আর মাথা ঘামাননি । একারনেই ঘর বাধা হয়নি , হোস্টেল হয়েছে ঘর সংসার ।
___________________________________________________________________________

"হয়তো তোমাকে হারিয়ে দিয়েছি নয়তো গিয়েছি হেরে,
থাক না ধ্রুপদী অস্পষ্টতা কে কাকে গেলাম ছেড়ে!"
হেলাল হাফিজ। কবি। একটিমাত্র বই লিখেছেন পুরোটা জীবনে (পরবর্তী বইটি এর বর্ধিত সংস্করণ মাত্র, এবং, দীর্ঘ ৩৪ বছর পরের তৃতীয়টিকে বলা যায় অণুকাব্য-সংকলন)। ছাপ্পান্নটি কবিতায় গড়া ১৯৮৬ সালে প্রকাশিত বইটি বাংলাদেশের ইতিহাসের সবচেয়ে বেশি পঠিত কাব্যগ্রন্থ, আজও। বইটি তিনি হৃদয়ে ক্ষত ধরে লিখেছিলেন। বইটির অধিকাংশ পঙক্তি লাখেলাখে বাঙালি তরুণতরুণীর মুখস্থ। কেন? বিরহী হেলাল হাফিজ জীবনে আর বিয়েই করলেন না বলে? না। কবিতাগুলোর প্রতিটি বর্ণের ভিতরে, তাঁর হেলেনের জন্য মেখে থাকা হৃদয়ের দাগ গেঁথে দিতে, পেরেছিলেন বলেই। অন্য ঘরে বিয়ে হয়ে যাওয়া হেলেনকে, তাঁর স্বামী যখন, হেলাল হাফিজের 'যে জলে আগুন জ্বলে' কাব্যগ্রন্থটির উৎসর্গ অংশটি দেখালেন, বুকের ভিতরটা মুচড়ে উঠেছিলো তরুণীর! সেই-যে তাঁর মস্তিষ্কে সমস্যা দেখা দিলো, মারা গেলেন সেভাবেই, পায়ে শেকল পরা অবস্থায়, হেলেন। বাংলা সাহিত্য কাঁপিয়ে দেওয়া বইটির উৎসর্গপত্রে লিখা আছে, কেবল, একটি নীলাভ অক্ষর─ 'হেলেন'। মানুষের বুকের ভিতরের দাগ বড্ড দুখী। বড্ড দুখী। দাগটির নাম─ ভালোবাসা।
"ইচ্ছে ছিল তোমাকে সম্রাজ্ঞী করে সাম্রাজ্য বাড়াবো,
ইচ্ছে ছিল তোমাকেই সুখের পতাকা করে
শান্তির কপোত করে হৃদয়ে ওড়াবো।
ইচ্ছে ছিল সুনিপুণ মেকাপ-ম্যানের মতো সূর্যালোকে কেবল সাজাবো,
তিমিরের সারাবেলা
পৌরুষের প্রেম দিয়ে তোমাকে বাজাবো, আহা তুমুল বাজাবো!
ইচ্ছে ছিল নদীর বক্ষ থেকে জলে-জলে শব্দ তুলে
রাখবো তোমার লাজুক দুই চঞ্চুতে,
জন্মাবধি আমার শীতল চোখ
তাপ নেবে তোমার দু’চোখের।
ইচ্ছে ছিল রাজা হবো─
তোমাকে সম্রাজ্ঞী করে সাম্রাজ্য বাড়াবো,
আজ দেখি─
রাজ্য আছে
রাজা আছে
ইচ্ছে আছে,
শুধু তুমি অন্য ঘরে।"
─ 'ইচ্ছে ছিল' (যে জলে আগুন জ্বলে, ১৯৮৬)
বলছিলাম 'যে জলে আগুন জ্বলে' নিয়ে। বাংলায় এমন কোনো সাহিত্যপ্রেমী নেই, যিনি এ-গ্রন্থের অন্তত একটি ছত্র আওড়াননি জীবনে! যুদ্ধক্ষেত্র থেকে প্রেমাঙ্গন, আটপৌরে উঠোন থেকে প্রেয়সীর দীর্ঘশ্বাস, সাম্রাজ্যবাদ থেকে সাম্যবাদ, কী নেই এ-কবিতাগুলোর ছত্রে-ছত্রে!
'নিষিদ্ধ সম্পাদকীয়' কবিতার─ "এখন যৌবন যার, যুদ্ধে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়।" কিংবা, 'ব্যবধান' কবিতার─ "অতো বেশি নিকটে এসো না, তুমি পুড়ে যাবে!" 'হৃদয়ের ঋণ' কবিতার─ "আমার জীবন ভালোবাসাহীন গেলে, কলঙ্ক হবে কলঙ্ক হবে তোর।' অথবা, 'অশ্লীল সভ্যতা' নামক মাত্র ৬ শব্দের অপূর্ব পুরো কবিতাটি: "নিউট্রন বোমা বোঝো, মানুষ বোঝো না!" 'অমীমাংসিত সন্ধি' কবিতাটিতে পাবেন অদ্ভুত অবসেশনে নারীপ্রেম! যদি বিস্ময়কর একটি হৃদয়ভাঙা কবিতা পড়তে চান, নির্দ্বিধায় ডুবে যান উপরোল্লিখিত 'ইচ্ছে ছিল' কবিতাটায়। যদি আমৃত্যু মনে রাখার মতো একটি কবিতা পড়তে চান, 'প্রস্থান' কবিতাটি একবার পড়ুন জীবনে─
"এখন তুমি কোথায় আছ কেমন আছ, পত্র দিয়ো৷
এক বিকেলে মেলায় কেনা খামখেয়ালী তাল পাখাটা
খুব নিশীথে তোমার হাতে কেমন আছে, পত্র দিয়ো৷
ক্যালেন্ডারের কোন্ পাতাটা আমার মতো খুব ব্যথিত
ডাগর চোখে তাকিয়ে থাকে তোমার দিকে, পত্র দিয়ো৷
কোন্ কথাটা অষ্টপ্রহর কেবল বাজে মনের কানে
কোন্ স্মৃতিটা উস্কানি দেয় ভাসতে বলে প্রেমের বানে
পত্র দিয়ো, পত্র দিয়ো৷
আর না-হলে যত্ন করে ভুলেই যেয়ো, আপত্তি নেই৷
গিয়ে থাকলে আমার গেছে, কার কী তাতে?
আমি না-হয় ভালোবেসেই ভুল করেছি ভুল করেছি,
নষ্ট ফুলের পরাগ মেখে
পাঁচ দুপুরের নির্জনতা খুন করেছি, কী আসে যায়?
এক জীবনে কতোটা আর নষ্ট হবে,
এক মানবী কতোটা আর কষ্ট দেবে!"
─ 'প্রস্থান' (যে জলে আগুন জ্বলে, ১৯৮৬)
আপনি হৃৎমন্থনে বিবশ হয়ে যেতে চাইলে পড়তে পারেন নিম্নোল্লিখিত 'যাতায়াত' কবিতাটি─
"কেউ জানে না আমার কেন এমন হলো!
কেন আমার দিন কাটে না রাত কাটে না,
রাত কাটে তো ভোর দেখি না,
কেন আমার হাতের মাঝে হাত থাকে না, কেউ জানে না!
নষ্ট রাখীর কষ্ট নিয়ে অতোটা পথ একলা এলাম,
পেছন থেকে কেউ বলেনি─ করুণ পথিক
দুপুর রোদে গাছের নিচে একটু বসে জিরিয়ে নিয়ো;
কেই বলেনি─ ভালো থেকো সুখেই থেকো।
যুগল চোখের জলের ভাষায় আসার সময় কেউ বলেনি─
মাথার কসম আবার এসো।
জন্মাবধি ভেতরে এক রঙিন পাখি কেঁদেই গেলো,
শুনলো না কেউ ধ্রুপদী ডাক;
চৈত্রাগুনে জ্বলে গেলো আমার বুকের গেরস্থালি,
বললো না কেউ─ তরুণ তাপস এই নে চারু শীতল কলস।
লণ্ডভণ্ড হয়ে গেলাম, তবু এলাম।
ক্যাঙ্গারু তার শাবক নিয়ে যেমন করে বিপদ পেরোয়
আমিও ঠিক তেমনি করে সভ্যতা আর শুভ্রতাকে বুকে নিয়েই দুঃসময়ে এতোটা পথ একলা এলাম শুশ্রূষাহীন।
কেউ ডাকেনি তবু এলাম, বলতে এলাম─ ভালোবাসি।"
─ 'যাতায়াত' (যে জলে আগুন জ্বলে, ১৯৮৬)
যদি বাংলা সাহিত্যের একটি অমর কবিতায় ঋদ্ধ হতে চান, পড়ুন 'ফেরিঅলা'─
"কষ্ট নেবে কষ্ট?
হরেক রকম কষ্ট আছে,
কষ্ট নেবে কষ্ট!
লাল কষ্ট, নীল কষ্ট, কাঁচা হলুদ রঙের কষ্ট,
পাথর চাপা সবুজ ঘাসের সাদা কষ্ট,
আলোর মাঝে কালোর কষ্ট,
‘মাল্টি-কালার’ কষ্ট আছে,
কষ্ট নেবে কষ্ট?
ঘরের কষ্ট, পরের কষ্ট, পাখি এবং পাতার কষ্ট,
দাড়ির কষ্ট,
চোখের বুকের নখের কষ্ট,
একটি মানুষ খুব নীরবে নষ্ট হবার কষ্ট আছে,
কষ্ট নেবে কষ্ট?
প্রেমের কষ্ট, ঘৃণার কষ্ট, নদী এবং নারীর কষ্ট,
অনাদর ও অবহেলার তুমুল কষ্ট,
ভুল রমণী ভালোবাসার
ভুল নেতাদের জনসভার
হাইড্রোজনে দুইটি জোকার নষ্ট হবার কষ্ট আছে,
কষ্ট নেবে কষ্ট?
দিনের কষ্ট, রাতের কষ্ট,
পথের এবং পায়ের কষ্ট,
অসাধারণ করুণ চারু কষ্ট, ফেরিঅলার কষ্ট,
কষ্ট নেবে কষ্ট?
আর কে দেবে আমি ছাড়া আসল শোভন কষ্ট,
কার পুড়েছে জন্ম থেকে কপাল এমন,
আমার মতো ক’জনের আর সব হয়েছে নষ্ট,
আর কে দেবে আমার মতো হৃষ্টপুষ্ট কষ্ট!"
─ 'ফেরিঅলা' (যে জলে আগুন জ্বলে, ১৯৮৬)
যুদ্ধ-পরবর্তী গণতন্ত্রে, প্রবঞ্চিত সাম্যবাদের জন্য আকুতি পাবেন আপনি 'একটি পতাকা পেলে' কবিতাটিতে─
"কথা ছিল একটি পতাকা পেলে
আমি আর লিখবো না বেদনার অঙ্কুরিত কষ্টের কবিতা।
কথা ছিল একটি পতাকা পেলে
ভজন গায়িকা সেই সন্ন্যাসিনী সবিতা মিস্ট্রেস
ব্যর্থ চল্লিশে বসে বলবেন─ ’পেয়েছি, পেয়েছি!’
কথা ছিল একটি পতাকা পেলে
পাতা কুড়োনির মেয়ে শীতের সকালে
ওম নেবে জাতীয় সংগীত শুনে পাতার মর্মরে।
কথা ছিল একটি পতাকা পেলে
ভূমিহীন মনুমিয়া গাইবে তৃপ্তির গান জ্যৈষ্ঠে-বোশেখে,
বাঁচবে যুদ্ধের শিশু সসম্মানে সাদা দুধে-ভাতে।
কথা ছিল একটি পতাকা পেলে
আমাদের সব দুঃখ জমা দেবো যৌথ-খামারে,
সম্মিলিত বৈজ্ঞানিক চাষাবাদে সমান সুখের ভাগ
সকলেই নিয়ে যাবো নিজের সংসারে।"
─ 'একটি পতাকা পেলে' (যে জলে আগুন জ্বলে, ১৯৮৬)
হেলাল হাফিজ বলেছিলেন, "'যে জলে আগুন জ্বলে' লিখে আমি আর কোনো কবিতা লিখিনি একটিই কারণে─ আমি প্রায় নিশ্চিত ছিলাম, এমন কবিতা আমি লিখতে পারবো না আর কখনোই।"
প্রিয় হেলেন, একটি মানুষ, আপনাকে ভুলতে পারলেন না তাঁর ইহজনমে, আপনি কি জানেন? হেলেন, আজ, বেলা ২:৪০ মিনিটে, ঢাকার পিজি হাসপাতালে এই জনম ত্যাগ করলেন, আপনার হেলাল। আপনাদের দেখা হোক ওইপারে, আপনাদের অন্তত একটিবার দেখা হোক জীবনের ওইপারে।
ওপারে ভালো থাকুন হেলেনের হেলাল।
হায়! "দুঃখের আরেক নাম হেলাল হাফিজ।"
#কে_কাকে_গেলাম_ছেড়ে
সর্বশেষ এডিট : ১৪ ই ডিসেম্বর, ২০২৪ বিকাল ৪:৫৩
২টি মন্তব্য ২টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

J K and Our liberation war১৯৭১

লিখেছেন ক্লোন রাফা, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৯:০৯



জ্যাঁ ক্যুয়ে ছিলেন একজন ফরাসি মানবতাবাদী যিনি ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইন্সের একটি বিমান হাইজ্যাক করেছিলেন। তিনি ৩ ডিসেম্বর, ১৯৭১ তারিখে প্যারিসের অরলি... ...বাকিটুকু পড়ুন

এবার ইউনুসের ২১শে অগাষ্ঠ ২০০৪ এর গ্রেনেড হামলার তদন্ত করা উচিৎ

লিখেছেন এ আর ১৫, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৯:৪০



এবার ইউনুসের ২১শে অগাষ্ঠ ২০০৪ এর গ্রেনেড হামলার তদন্ত করা উচিৎ


২০০৪ সালের ২১ শে অগাষ্ঠে গ্রেনেড হামলার কারন হিসাবে বলা হয়েছিল , হাসিনা নাকি ভ্যানেটি ব্যাগে... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাংলাদেশের রাজনীতিতে নতুন ছায়াযুদ্ধ: R থেকে MIT—কুয়াশার ভেতর নতুন ক্ষমতার সমীকরণ

লিখেছেন এস.এম. আজাদ রহমান, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ১২:৪৪



বাংলাদেশের রাজনীতিতে নতুন ছায়াযুদ্ধ: R থেকে MIT—কুয়াশার ভেতর নতুন ক্ষমতার সমীকরণ

কেন বিএনপি–জামায়াত–তুরস্ক প্রসঙ্গ এখন এত তপ্ত?
বাংলাদেশের রাজনীতিতে দীর্ঘদিন ধরে একটি পরিচিত ভয়–সংস্কৃতি কাজ করেছে—
“র”—ভারতের গোয়েন্দা সংস্থা নিয়ে রাজনীতিতে গুজব,... ...বাকিটুকু পড়ুন

নিশ্চিত থাকেন জামায়েত ইসলাম এবার সরকার গঠন করবে

লিখেছেন সূচরিতা সেন, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ৯:৪২


আমাদের বুঝ হওয়ার পর থেকেই শুনে এসেছি জামায়েত ইসলাম,রাজাকার আলবদর ছিল,এবং সেই সূত্র ধরে বিগত সরকারদের আমলে
জামায়েত ইসলামের উপরে নানান ধরনের বিচার কার্য এমন কি জামায়েতের অনেক নেতা... ...বাকিটুকু পড়ুন

প্রকৌশলী এবং অসততা

লিখেছেন ফাহমিদা বারী, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১১:৫৭


যখন নব্বইয়ের দশকে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার সিদ্ধান্ত নিলাম এবং পছন্দ করলাম পুরকৌশল, তখন পরিচিত অপরিচিত অনেকেই অনেকরকম জ্ঞান দিলেন। জানেন তো, বাঙালির ইঞ্জিনিয়ারিং এবং ডাক্তারিতে পিএইচডি করা আছে। জেনারেল পিএইচডি। সবাই... ...বাকিটুকু পড়ুন

×