somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। বৃষ্টিস্নাত রমনায় সবুজের উল্লাস

০১ লা আগস্ট, ২০২৫ দুপুর ১:০০
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :






রমনা উদ্যানের গাছগুলো বৃষ্টিতে ভিজছে, ভিজছে মাটি ও মাটির ওপরের ঘাসগুলো। বর্ষায় রমনার রূপ হয় দেখার মতো। চারদিকে কেবল সবুজ আর সবুজ। বসন্তের মতো ফুল নেই তো কী হয়েছে? আছে শ্যামল রূপ, আছে অপার স্নিগ্ধতা। বুকভরে ধুলাহীন নিশ্বাস নেওয়ার অবকাশ, প্রকৃতির উদার আমন্ত্রণ।

‘পাগলা হাওয়ার বাদল-দিনে’ ঢাকার রমনা পার্কের গাছের পাতাগুলো এখন আরও সবুজ। টলটলে জলের নয়নাভিরাম ঝিলটা টইটম্বুর। ধুলাময়লাহীন পায়ে চলার পথ। আর গাছের পাতার ফাঁকে রয়েছে অজস্র ফুল। কোনোটা লাল, কোনোটা বেগুনি আবার কোনোটা সাদা। বৃষ্টির মধুর আশকারা পেয়ে রমনা পার্কে এখন সবুজের উল্লাস।

এই পার্কটিকে ঢাকার ফুসফুস বলা হয়। এর যথেষ্ট কারণ আছে অবশ্য। এ রকম প্রগাঢ় নিরেট সবুজ এ শহরে কমই আছে। রমনা তাই ঢাকার জনজীবনের স্পন্দন। এটি কেবল একটি পার্ক নয়, বরং নাগরিক জীবনের পরম আনন্দ-আশ্রয়।

সম্প্রতি ‘বৃষ্টি নেশাভরা’ এক বিকেলে অরুণোদয় ফটক দিয়ে রমনা পার্কে প্রবেশ করলাম। অনেকে শরীরচর্চায় ব্যস্ত। কেউ দল বেঁধে করছেন, কেউ একাকী। কোনো দল ব্যায়াম করে ভোরে, কেউ আবার বিকেলে বা সন্ধ্যায়। আবার অনেকে আছেন দুই বেলাই হাঁটাহাঁটি করেন। হাঁটা সেরে কেউ কেউ লেকের পাশে এসে দুদণ্ড জিরিয়ে নেন। লেকে চলছিল বোট।








বর্ষার ফুলের উৎসব

বর্ষা এলেই রমনা পার্ক যেন রঙের নতুন ভাষা শেখে। আমাদের ঋতুচক্র অনুযায়ী, বসন্ত ও গ্রীষ্মকালেই এ দেশে ফোটে অধিকাংশ ফুল। তবে বর্ষারও নিজস্ব কিছু ফুল আছে, আর গ্রীষ্মের কিছু ফুল টিকে থাকে বর্ষা পর্যন্ত। সেদিন রমনায় গিয়ে এমনই কিছু ফুল চোখে পড়ল—বৃষ্টিভেজা পাতার ফাঁকে তাদের রং যেন আরও উজ্জ্বল হয়ে উঠেছিল। মনে হলো, প্রকৃতির এই নিঃশব্দ উৎসবেও কত কথা লুকিয়ে থাকে!

রমনার গোলাপবিথি সেদিন দর্শনার্থীদের সবচেয়ে বেশি মনোযোগ কাড়ছিল। সারি সারি ঝোপে ফুটে আছে হরেক রঙের গোলাপ—লাল, সাদা, হলুদ, কমলা, গাঢ় গোলাপি। বর্ষার ভেজায় যেন আরও সতেজ, আরও তাজা হয়ে উঠেছে প্রতিটি পাপড়ি। নরম আলো আর বৃষ্টিজলে ভেজা ফুলগুলোর সৌন্দর্য মোহিত করেছে পথচলার মানুষকে। কেউ থেমে দাঁড়িয়ে ছবি তুলছেন, কেউ ভিডিও করছেন—মুঠোফোনে বন্দী হচ্ছে বর্ষার রঙিন রমনা।







আর যে ফুলটি এখনো বিশেষভাবে দেখা যাচ্ছে, তা হলো বিলেতি জারুল। জারুল যাঁরা ভালোবাসেন তাঁরা জানেন, এই ফুলের বেগুনি রং যেমন আকর্ষণীয়, তেমনি শোভন-সুন্দর তার পাপড়ির নমনীয় কোমলতা। গ্রীষ্মের এই ফুল হয়তো আর কিছুদিন সৌন্দর্য বিলিয়ে যাবে।

এর বাইরে রমনা উদ্যানে গেলে আপনাকে স্বাগত জানাবে চালতা ফুল। ‘আমি চলে যাব বলে, চালতা ফুল কি আর ভিজিবে না শিশিরের জলে—নরম গন্ধের ঢেউয়ে?’ এমন আক্ষেপের কথা কবিতায় লিখেছিলেন কবি জীবনানন্দ দাশ। বর্ষার প্রকৃতিতে শুদ্ধতা আনে দৃষ্টিনন্দন এই চালতা ফুল।

এ ছাড়া প্রিয় পাঠকেরা এখন রমনায় গেলে বেলি, টগর, বকুল, নাগকেশর, রঙ্গন, গন্ধরাজ, কাঞ্চন, চন্দ্রমল্লিকা, বাগানবিলাস, মোরগফুলের দেখা পেতে পারেন।

হাঁটতে হাঁটতে পাচ্ছিলাম বকুল ফুলের ঘ্রাণ। বিকেল তখন সন্ধ্যার পথযাত্রী। কিন্তু গাছটা ঠাওর করতে পারছিলাম না। হঠাৎ পায়ের কাছেই যেন দুটি বকুল ফুল ঝরে পড়ল। কুড়িয়ে নিলাম। কী তাজা ঘ্রাণ। শৈশবের দিনগুলো যেন হাজির হলো সামনে!

কত বৈচিত্র্যপূর্ণ গাছ যে আছে এই পার্কে! প্রায় ৪০০ প্রজাতির ৫ হাজারের বেশি উদ্ভিদ রয়েছে এখানে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য প্রজাতিগুলো হলো ছায়াদানকারী মেঘশিরীষ, কড়ই, কৃষ্ণচূড়া, রাধাচূড়া, অর্জুন, জারুল, বট, অশ্বত্থ ও কাঁঠাল। আছে অঞ্জনগাছ, রক্তকাঞ্চন, বুদ্ধনারিকেল, বাওবাব, নাগলিঙ্গম, মালি আমগাছ, শতবর্ষী বটগাছ, রুদ্র পলাশ, অর্জুনগাছ, পান্থপাদপ, বোতল পাম, এরিকাপামের মতো জানা-অজানা অনেক নামের গাছ।

বরেণ্য উদ্ভিদবিদ অধ্যাপক দ্বিজেন শর্মা রমনা পার্কে দুলিচাঁপা, মাকড়িশাল, কনকচাঁপা, পালাম, কাউয়াঠুঁটিসহ অনেক দুর্লভ গাছ রোপণ করেন। সেসব গাছে এখন নিয়মিত ফুল ফুটছে। অধিকাংশ গাছের নিচে নাম-পরিচয় লিখে দেওয়া আছে। তবে কিছু গাছের নাম নিয়ে নিসর্গীদের মধ্যে প্রশ্ন আছে। উদ্ভিদ ও প্রকৃতিবিষয়ক লেখক মোকারম হোসেন বললেন, এ ধরনের ভুল নামফলক সংশোধন করা উচিত। না হয় ভুল নামগুলো ছড়িয়ে পড়বে।


ইতিহাস কতটা জানি

অনেকেই আছেন, যাঁরা নিয়মিত রমনায় বেড়াতে যান। পরিবার নিয়ে সময় কাটান। কিন্তু আমরা কি রমনার ইতিহাস জানি?

রমনা পার্কের ফটকের বোর্ডে লেখা বিবরণী থেকে জানা যায়, রমনা নামটি মোগলদের দেওয়া এবং ১৬৬০ সাল থেকে এলাকাটি এই নামে পরিচিত। ঢাকা থেকে মুর্শিদাবাদে সুবা বাংলার রাজধানী স্থানান্তরিত হলে রমনা জঙ্গলাকীর্ণ হয়ে ওঠে। ১৮২৫ সালে ঢাকার তৎকালীন ম্যাজিস্ট্রেট চার্লস ডয়েস জেলখানার কয়েদিদের দিয়ে জায়গাটা পরিষ্কার করান সম্ভবত মশা নিধন, ম্যালেরিয়া দূরীকরণ কর্মসূচি হিসেবে।

দ্বিজেন শর্মার নিসর্গ, নির্মাণ ও নান্দনিক ভাবনা বই থেকে জানা যায়, ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গের পর ঢাকা পূর্ববঙ্গ-আসাম নিয়ে নবগঠিত নতুন প্রদেশের রাজধানী হলে রমনা অঞ্চলে বাড়িঘর তৈরি ও গাছপালা লাগানো হয়।

দ্বিজেন শর্মা লিখেছেন, ‘বর্তমান রমনা পার্ক অবশ্য অনেক পরের সৃষ্টি। ১৯৫২ সালে পত্তন। ৬৫.৫ একর জমি ও ৮.৭৫ একর ঝিল নিয়ে পার্কটি গড়ে ওঠে। ফজলুল করিমের হাতেই সূচনা, যিনি ইতঃপূর্বে কলকাতার ইডেন উদ্যানে কর্মরত ছিলেন। ১৯৫২ সালের হিসাবটি সম্ভবত কাগজপত্রে, আসলে নির্মাণ শুরু হয়েছিল ১৯৫৫-৫৬ সালের কোনো এক সময়, কেননা আমার মনে আছে, একদিন ওই মাঠের বটতলায় বসে ছিলাম সকালে, তখনই একটি ট্রাক্টর সেখানে মাটি চষতে লাগলে ড্রাইভারকে জিজ্ঞেস করে পার্ক তৈরির কথা জানতে পারি।’

এই নিসর্গীর কথায়, ‘এক অর্থে এই পার্কের জন্মদিন থেকেই তার সঙ্গে পরিচয় এবং গোটা বিকাশটিই ঘটেছে চোখের সামনে। আমাদের যৌবনের বহু স্মৃতির সঙ্গে পার্কটি জড়িত এবং রমনার শোভা আমাদের সর্বদা আবিষ্ট রেখেছে।’









এক বর্ষা-বিকেল

রমনা পার্ক প্রতিদিন সকাল ৮টা থেকে সন্ধ্যা ৭টা পর্যন্ত খোলা থাকে। সপ্তাহে সাত দিনই খোলা। পার্কে প্রবেশ করতে কোনো টিকিটের প্রয়োজন হয় না।

কর্তৃপক্ষ পার্ক ব্যবহারে কিছু নিয়ম বেঁধে দিয়েছে। পার্কে ধূমপান করা, ফুটবল বা ক্রিকেট খেলা নিষেধ। বাচ্চারা হাওয়ার বল নিয়ে খেলে, এটা দেখতে ভালো লাগে। গাছের ফুল ছিঁড়তে মানা। খাবার নিয়ে পার্কে প্রবেশ করা যাবে না। পার্ক ব্যবহারকারীরা সাধারণত এসব নিয়ম মেনে চলেন। কিছু ব্যতিক্রমও যে ঘটে না, তা নয়। তবে ভ্রাম্যমাণ হকারদের উৎপাত রয়ে গেছে। আছে ‘পেশাদার ক্যামেরাম্যান’দের অনাহূত উপস্থিতি।

রমনা আসলেই রমণীয়। বর্ষার স্পর্শে পার্কের ঘাস, গাছ ও ফুল নতুন প্রাণে ভরে উঠেছে। গাছের পাতার ওপর বৃষ্টি পড়ার শব্দ এবং মাটির ঘ্রাণ এক অন্য রকম প্রশান্তি দেয়। একটা বর্ষামুখর বিকেল রমনার সবুজে বিহার করা যেতেই পারে।

শীত হোক, বর্ষা হোক—আট বছর ধরে নিয়মিত রমনায় হাঁটতে যান শেখ সুলতানা মেহেরুন মেরী। কখনো দুই ছেলেকে নিয়ে, কখনো একা। শান্তিনগর এলাকার এই বাসিন্দার কথায়, বর্ষার রমনা পার্কে সকালের হাঁটা একপ্রকার রিফ্রেশমেন্ট, শরীর আর মনের জন্য উপহার—যা দিনের ক্লান্তি মুছে দেয় এবং নতুন উদ্যম জোগায়। এ যেন দেহ–মন রিচার্জের এক অনিবার্য ঠিকানা।




সংগৃহীত




সর্বশেষ এডিট : ০১ লা আগস্ট, ২০২৫ দুপুর ১:০১
৩টি মন্তব্য ২টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

বিজয়ের আগে রাজাকারের গুলিতে নিহত আফজাল

লিখেছেন প্রামানিক, ১৬ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৫:১৩


ঘটনা স্থল গাইবান্ধা জেলার ফুলছড়ি থানার উড়িয়া ইউনিয়নের গুণভরি ওয়াপদা বাঁধ।

১৯৭১সালের ১৬ই ডিসেম্বরের কয়েক দিন আগের ঘটনা। আফজাল নামের ভদ্রলোক এসেছিলেন শ্বশুর বাড়ি বেড়াতে। আমাদের পাশের গ্রামেই তার... ...বাকিটুকু পড়ুন

৫৫ বছর আগে কি ঘটেছে, উহা কি ইডিয়টদের মনে থাকে?

লিখেছেন জেন একাত্তর, ১৬ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৫:৫৮




ব্লগের অনেক প্রশ্নফাঁস ( Gen-F ) ১ দিন আগে পড়া নিউটনের ২য় সুত্রের প্রমাণ মনে করতে পারে না বলেই ফাঁসকরা প্রশ্নপত্র কিনে, বইয়ের পাতা কেটে পরীক্ষার হলে নিয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

নিজামী, মুজাহিদ, বেগম জিয়াও বিজয় দিবস পালন করেছিলো!!

লিখেছেন জেন একাত্তর, ১৭ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৭:২০



মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে বেগম জিয়ার মুরগী মগজে এই যুদ্ধ সম্পর্কে কোন ধারণা ছিলো না; বেগম জিয়া বিশ্বাস করতো না যে, বাংগালীরা পাকীদের মতো শক্তিশালী সেনাবাহিনীকে পরাজিত করতে পারে;... ...বাকিটুকু পড়ুন

১৯৭১ সালে পাক ভারত যুদ্ধে ভারত বিজয়ী!

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ১৭ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৯:০৯


দীর্ঘ ২৫ বছরের নানা লাঞ্ছনা গঞ্জনা বঞ্চনা সহ্য করে যখন পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বীর বাঙালী অস্ত্র হাতে তুলে নিয়ে বীরবিক্রমে যুদ্ধ করে দেশ প্রায় স্বাধীন করে ফেলবে এমন সময় বাংলাদেশী ভারতীয়... ...বাকিটুকু পড়ুন

ইন্দিরা গান্ধীর চোখে মুক্তিযুদ্ধ ও বাংলাদেশ-ভারত-পাকিস্তান সম্পর্ক: ওরিয়ানা ফলাচির সাক্ষাৎকার থেকে

লিখেছেন শ্রাবণধারা, ১৭ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ১১:৫৫


১৯৭২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ইতালীয় সাংবাদিক ওরিয়ানা ফলাচি ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সাক্ষাৎকার নেন। এই সাক্ষাৎকারে মুক্তিযুদ্ধ, শরনার্থী সমস্যা, ভারত-পাকিস্তান সম্পর্ক, আমেরিকার সাম্রাজ্যবাদী পররাষ্ট্রনীতি এবং পাকিস্তানে তাদের সামরিক... ...বাকিটুকু পড়ুন

×