একটা ঘুনে ধরা চৌকি, একটা টেবিল, ভাঙা একটা চেয়ার।
দেয়ালের হুকে ঝোলানো দুটো শার্ট, একটা প্যান্ট।
টিমটিমে একটা ষাট ওয়াটের বাতি। বাতির পাশে বিনে ভাড়ার চিরস্থায়ী বাসিন্দা দুটো টিকটিকি।
রাতের বেলার অতিথি দুই একটা ইঁদুর, আরশোলা।
দুই ফিট বাই তিন ফিটের একটা জানালা। জানালার ওপারে আকাশ, কার্নিশে একটা নিয়মিত চড়ুই।
এই নিয়ে আমার পৃথিবী।
না, ভুল হল একটু। আরেকজনের কথা বলা হয়নি।
আমার একটা বন্ধু আছে। মাঝে মাঝে, নিশুতি রাতে যখন আকাশে তারা গুলো ছাড়া আর কেউ জেগে থাকে না তখন সে আমার ঘরে আসে। আমি তাকে দেখতে পাই না, তবে সে আসলেই অদ্ভুত একটা সুগন্ধে আমার এই চিলেকোঠার ছোট্ট ঘরটা ভরে যায়। পৃথিবীর বুকে যেন কিছুক্ষণের জন্য নেমে আসে স্বর্গের ছোট্ট এক টুকরো বাগান!
আমার বন্ধুটা খুব কম কথা বলে। আর তার কথা বলার ধরনটাও আলাদা। আর কেউ তার কথা শুনতে পায় না, শুধু আমার মমে হয় তার কথাগুলো আমার মাথার ভেতর থেকেই ভেসে আসছে। সে আমাকে মাঝেমধ্যেই সাহায্য করে। এই তো সেদিন বাসস্ট্যান্ডে দাড়িয়ে ছিলাম বাসের জন্য। একটু পর একটা বাস এসে থামল। উঠতে যাব, হঠাৎ আমার বন্ধুর কন্ঠ শুনতে পেলাম। বাসে উঠতে নিষেধ করছে আমাকে। আমি পিছিয়ে এলাম। বাসটা আমার সামনে দিয়ে হুশ করে চলে গেল। সেদিন বাসায় ফিরেছিলাম হাটতে হাটতে।
পরদিন সকালে খবরের কাগজটা নিয়ে পাতা উল্টোতেই খবরটা চোখে পড়ল। গতকাল আমি যে বাসে উঠতে গিয়েছিলাম সেটা কিছুদূর গিয়েই এক্সিডেনট করে। অনেক হতাহত হয়েছে।
বন্ধুর প্রতি কৃতজ্ঞতায় ছেয়ে গেল আমার ভেতরটা। সেদিনের পর থেকে আমি আমার বন্ধুর প্রতিটা কথা শোনার চেষ্টা করি। আমি জানি সে আমার কোন খারাপ চাইবে না।
গত এক সপ্তাহ ধরে বন্ধুর দেখা নেই। ও তো কখনও এত লম্বা সময় আমার সাথে দেখা না করে থাকে নি? জানি না কি হয়েছে। আমার উপর রাগ করল কোন কারনে? কিন্তু রাগ হওয়ার মত কিছু তো করিনি আমি।
বন্ধুটাকে ছাড়া আমার একেবারেই ভাল লাগে না। গত পরশু গ্রামের বাড়ি থেকে ওই লোকটা ফোন করেছিল। ওই যে, যে লোকটা নিজেকে আমার বাবা বলে পরিচয় দেয়। কতবড় ঠগ, জোচ্চোর এটা ভাবলেই আমার মাথায় রাগ চড়ে যায়। ওর সাথে যে মহিলা থাকে সেই নাকি আমার মা। হুহ, ভেবেছে আমি কচি খোকা, কিছুই বুঝি না।
আমি আমার বাবা মায়ের একমাত্র সন্তান। তারা আমাকে খুবই ভালবাসত। গতবছর তারা চট্টগ্রাম বেড়াতে গিয়েছিল। আমি যেতে পারিনি। যখন তারা ফিরে এলো তখন তাদের দেখেই বুঝতে পেরেছিলাম কোন একটা সমস্যা আছে। কয়েকদিন পরেই সমস্যাটা চিহ্নিত করলাম। এরা আমার বাবা মা নয়!
ওদের আচার আচরনে ব্যবহারে আমি কেমন যেন একটা কুটিলতা লক্ষ্য করলাম। আমার পেছনে ফিসফাস করে কথা বলত, আমাকে ফলো করত সবসময়। একদিন বাবার বইপত্রের ভাজে একগাদা সিডেটিভ আবিষ্কার করলাম। বুঝলাম, এগুলো আমার জন্যেই। আমার আসল বাবা মার কি হয়েছে আমি জানি। বদমাশ দুটো চট্টগ্রামেই খুন করেছে তাদের, তারপর তাদের ছদ্মবেশ নিয়ে এ বাড়িতে ঢুকেছে। এখন আমাকে সরিয়ে দিতে চায় ওরা। তাহলেই আর আমাদের সম্পত্তি ভোগদখল করতে আর কোন বাধা থাকবে না। সুযোগ বুঝে একদিন পালিয়ে আসলাম ঢাকায়।
তারপর থেকে এই চিলেকোঠার ঘরেই আমার বাস। দরকার না পড়লে ঘর থেকে বের হই না, কারও সাথে দেখাও করি না। করা নিরাপদও নয়, কারন আমি জানি এই বিশাল শহরে এত মানুষের মাঝেও আমি নিরাপদ নই। ওই ঠগবাজদের চর ছটিয়ে আছে সব জায়গায়। আমাকে ধরতে পারলেই স্রেফ খুন করে ফেলবে। তারপর লাশটা কয়েক টুকরো করে ডাস্টবিনে ফেলে দেবে, নাহয় বস্তাবন্দী করে বুড়িগঙ্গায় ভাসিয়ে দেবে। এত বড় শহরে আমার বন্ধু বলতে শুধু এই একজন।
কিন্তু ওর কি হয়েছে? আসছে না কেন? জরুরী পরামর্শ দরকার। জোচ্চোরটা ফোনে খুব কান্নাকাটি করেছিল, যেন ওর মায়াকান্না দেখেই আমি গলে গিয়ে বাড়ি ফিরে যাব। শেষে বলে দিয়েছি, তোর কাছে আমি জীবনেও যাব না। তোরা দুইজন আমার বাবা মাকে মেরেছিস, আমাকেও মারতে চাইছিস। বলেই ফোন বন্ধ করে রেখে দিয়েছি। আমি জানি ওদের হাত অনেক লম্বা। বেশিদিন এখানে থাকা যাবে না, অন্য কোথাও চলে যেতে হবে।
কিন্তু কোথায় যাব? মাথায় কোন বুদ্ধি আসছে না। ইশ, এ সময় যদি আমার বন্ধুটা কাছে থাকত! এখন ও থাকলে চুপচাপ পুরো সমস্যাটা শুনত, তারপর একটা না একটা সমাধান বের করে দিত। আমি ওর কাছে পরামর্শ চেয়ে কখনও বিফল হইনি।
বসে বসে যখন এসব আকাশ পাতাল ভাবছি ঠিক তখনই সেই খুব চেনা সুগন্ধটা ভেসে এল। সচকিত হয়ে উঠলাম আমি। এই তো, চলে এসেছে আমার বন্ধু!
*************
দুই দিন পর।
যৎসামান্য যা কিছু আছে আমার তাই গুছিয়ে একটা ব্যাগে নিয়ে নিয়েছি। টাকা ছিল না বেশি তাই একমাত্র দামি জিনিস মোবাইল ফোনটা বেঁচে দিলাম। বেশি টাকা পাওয়া যায় নি, তবে সপ্তাহখানেক চলার জন্য যথেষ্ট।
চিলেকোঠার দরজায় তালা ঝুলিয়ে দিয়ে নিচে নেমে এলাম। রুমটা থেকে আমার সব চিহ্ন মুছে দিয়ে এসেছি। ওই জোচ্চোরগুলো যদি আমাকে খুঁজতে খুজতে এখানে চলেও আসে তবু কিছু সন্দেহ করতে পারবে না।
ঠিক করেছি এখান থেকে চলে যাব। অন্য কোথাও, দূরে, নির্জন কোন যায়গায়। মানুষের উপস্থিতি এখন আমার একেবারেই সহ্য হয় না। কোথায় কোন ছদ্মবেশী গুপ্তচর লুকিয়ে থাকে তা কে বলতে পারে? তার চেয়ে মানুষের সঙ্গ একেবারে এড়িয়ে চলাই ভাল।
অবশ্য আমি একা যাচ্ছি না। সাথে যাচ্ছে আমার বন্ধু। ও কথা দিয়েছে আমাকে, এর পর আমাকে ছেড়ে আর কোথাও যাবে না। এই অজ্ঞাতবাসের সঙ্গী হবে শুধু সে।
আমরা দুজন হারিয়ে যাব, বহু দূরে চলে যাব। বাবা মার জন্য মাঝে মাঝে খুব কষ্ট হয়। কিন্তু কিছু করার নেই। ওই জোচ্চোর গুলোর প্রতি মনের গভীরে একটা ক্রোধ খেলা করে। নিজেকে বুঝিয়েছি, ওদের ছাড়বো না। একদিন, একদিন...প্রতিশোধ নেব। আমি আর আমার বন্ধু।
দুজন হাটতে হাটতে একটা মোড়ে এসে দাড়ালাম। আমার বন্ধুর মনটা বোধহয় কোন কারনে খুব ফুরফুরে হয়ে আছে। কথা বলছে, গান গাইছে গুনগুন করে। আর ওর খুশিতেই তো আমার খুশি। ছোট্ট একটা চুটকি বলল আমাকে। হা হা হা করে হেসে উঠলাম আমি। রাস্তার লোকজন চমকে উঠে আমার দিকে তাকাচ্ছে। একা একা হাসাহাসি করতে দেখে পাগল ভাবছে বোধহয়। ভাবুক। আমি এসবের পরোয়া করি না। যতক্ষণ আমার বন্ধু আমার সাথে আছে ততক্ষণ আর কিছু দরকার নেই আমার।
হঠাৎ কানের কাছে আমার বন্ধুর ফিসফিসে গলা শুনতে পেলাম, বাঁচতে চাইলে পালাও! চলে এসেছে ওরা!
কাদের কথা বলছে সে বুঝতে অসুবিধে হল না। রাজপথে চলমান মানুষের স্রোতে ইতিউতি চোখ বুলালাম, দেখতে চেষ্টা করছি কোন দিক দিয়ে আসছে ওরা। কাধের ব্যাগটা চেপে ধরে ঘুরে দাড়িয়েছি, সামান্য বেগতিক দেখলেই দৌড় দেব।
ওই তো! সেই ঠগবাজ মেয়েলোকটা। নিজেকে আমার মা বলে পরিচয় দেয় যে। রাস্তার ওইপাশে দাড়িয়ে আমার দিকেই তাকিয়ে আছে। দৌড় দিতে যাব, আমার কাধে চেপে বসল কারও হাত। তাকিয়ে দেখি আর কেউ নয়, আমার বাবার ছদ্মবেশ ধরে দাড়িয়ে আছে সেই দ্বিতীয় জোচ্চোর।
ঝটকা মেরে নিজেকে ছাড়িয়ে নেয়ার চেষ্টা করলাম। পাগলের মত চিৎকার শুরু করলাম, বন্ধুকে ডাকছি। কোথায় গেল ও? ধস্তাধস্তি করতে করতে আমার শার্টের কিছুটা অংশ ছিড়ে চলে গেল লোকটার হাতে। লোকটার বজ্রমুষ্টি থেকে ছাড়া পেয়েই উদ্ভ্রান্তের মত দৌড় দিলাম আমি।
কয় পা এগিয়েছি মনে নয়, প্রচন্ড এক ধাক্কায় ছিটকে পড়লাম রাস্তার উপর। একটা ট্রাক ধাক্কা দিয়ে চলে গেছে আমাকে। চোখের সামনে আঁধারের ভারি পর্দা নেমে এল। জ্ঞান হারানোর আগ মূহুর্তে দেখলাম আমার মুখের উপর ঝুকে আছে সেই বদমাশদুটো। দাঁতে দাঁত চেপে গালি দিলাম ওদেরকে। তারপর সব অন্ধকার।
************
আমাকে ওরা একটা কামরায় বন্দী করে রেখেছে। এখানে সব কিছু সাদা রঙের। দেয়াল, জানালার পর্দা, বিছানার চাদর-সব। এত সাদার মাঝে দমবন্ধ হয়ে আসে আমার।
কতদিন ধরে আছি এখানে? মনে নেই। চোখ বুজলেই আঁধার, চোখ খুললে সেই একঘেয়ে সাদার রাজত্ব। একটু রং দেখার জন্য মনটা আকুপাকু করে ওঠে মাঝে মাঝে।
কামরার এক পাশে, বেশ কিছু কুৎসিত যন্ত্রপাতি যেখানে রাখা আছে, তার পাশে দেয়ালে একটা চৌকো ফোকর। সাদা পর্দায় ঢাকা ওপাশে পুরু কাঁচ। মাঝে মাঝে পর্দাটা সরে যায়। ওই দুই ঠগবাজকে দাড়িয়ে থাকতে দেখি। আমাকে দেখিয়ে নিজেদের মধ্যে কি যেন শলাপরামর্শ করে।
অনেকদিন পর আজ বিছানা থেকে ওঠার শক্তি পাচ্ছি শরীরে। আস্তে আস্তে উঠে বসলাম। জানি এ সময় কেউ আমাকে বিরক্ত করবে না।
রুমের চারদিকে নজর দিলাম। আমাকে এখান থেকে পালাতে হবে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব। ওরা কেউ এসে পড়ার আগেই। এখানে পড়ে থাকলে জীবনেও মুক্তি মিলবে না।
কিন্তু আশে পাশে চোখ বুলিয়ে এমন কিছু চোখে পড়ল না যাতে মুক্তির সামান্যতম সম্ভাবনাটুকুও উঁকি দিতে পারে। হতাশ হয়ে পড়ছি আস্তে আস্তে।
হঠাৎ জানালার দিকে চোখ পড়ল। পর্দার ফাকে উকি দিচ্ছে এক টুকরো নীল। মনটা হু হু করে উঠল। কতদিন আকাশ দেখি না!
এগিয়ে গিয়ে জানালার পর্দাটা সরিয়ে দিলাম। দুচোখ ভরে পান করছি শরতের গাঢ় নীল আকাশ আর পেজা তুলোর মত মেঘের সৌন্দর্য।
নিচের দিকে তাকালাম। অনেক অনেক নিচে দেখা যাচ্ছে ব্যস্ত রাজপথ, পুতুলের মত মানুষ আর খেলনার মত গাড়িঘোড়া। ব্যস্ত সবাই। এই মেঘের কাছাকাছি উচ্চতায় যে একটা মানুষ বন্দী হয়ে আছে সেদিকে কারও খেয়াল নেই।
বিদ্যুৎ চমকের মত মাথায় একটা কথা ভেসে আসল। তাই তো, কি বোকা আমি! পালানোর এত সহজ একটা রাস্তা সামনে রেখে কি না এই বদ্ধ ঘরে বন্দী হয়ে আছি!
জানালাটা খুলে দিলাম আলতো করে। হু হু বাতাস এসে ধাক্কা দিল আমার গায়ে। চুলের মাঝে খেলা করছে, বিলি কেটে দিচ্ছে। ছোটবেলায় ঘুমাতে যাওয়ার আগে আমার মা যেমন চুলে হাত বুলিয়ে দিত তেমন। মায়ের কথা মনে হতেই চোখ ভিজে এল আমার।
আস্তে করে জানালার কার্নিশে নেমে এলাম। নিচের দিকে তাকাচ্ছি না, চোখ সোজা সামনের দিকে। শেষ মূহুর্তে যদি ভয় পেয়ে যাই? বন্ধুর কথা মনে হচ্ছে। জানি ও আশে পাশেই আছে, অভয়ের হাসি ছুড়ে দিচ্ছে আমার দিকে। সেই অতি পরিচিত সুগন্ধ ভেসে এল আবার। বুক ভরে টেনে নিলাম সেই মন মাতানো সৌরভ।
ভয় কি তোমার? বন্ধুর কন্ঠ শুনতে পেলাম। আমি তো সাথেই আছি। সব ঝামেলা, ভয় থেকে মুক্তি পাওয়ার এটাই সবচেয়ে সহজ উপায়। কয়েক সেকেন্ড মাত্র, তারপরেই চিরকালের জন্য মিলে যাবে পরম আরাধ্য সেই মুক্তির স্বাদ!
আর কিছু ভাবতে চাইলাম না আমি। হাতদুটো ছড়িয়ে দিলাম দুপাশে, ডানা মেলার মত করে। পায়ের নিচ থেকে সরিয়ে দিলাম কার্নিশের মায়া, তীব্র বাতাসে ভাসিয়ে দিলাম আমার শরীর।
সাই সাই করে কানের পাশ দিয়ে চলে যাচ্ছে বাতাস। নিচের খেলনা দুনিয়াটা খুব দ্রুত উঠে আসছে আমার দিকে। হঠাৎ চোখের সামনে ভেসে এল দুটো মুখ। আমার মা আর বাবার। হাসছে আমার দিকে তাকিয়ে, দুজনের চোখে কি অপার ভালবাসা!
দুজনের চোখে চোখ রেখে অতল অন্ধকারে ডুব দিলাম আমি।