(হে অন্তরসমূহের নিয়ন্ত্রণকারী! আমার অন্তরকে তোমার দ্বীনের উপর সুদৃঢ় করে দাও)
দৃশ্য ১: সিতারা বেগমের ছোট বোন তাকে ফোন করে পাচ্ছেনা। তাই রাকিবের নাম্বারে ফোন দিল। রাকিব মায়ের কাছে ফোনটা দিয়েই তার নিজের রুমে চলে গেল। তিনি কথা বলছেন,কিন্তু লাইনটা হঠাৎই কেটে গেল। এন্ড্রোয়েড ফোনের অপারেটিং তিনি খুব একটা ভালো বুঝেন না। আবার কল করার চেষ্টা করছেন। কিন্তু পারছেন না। উল্টাপাল্টা টেপাটিপি করতে গিয়ে তিনি ফোন গ্যালারীতে চলে গেলেন। আর তাতেই তার চক্ষু চড়কগাছ। পর্ণ ছবিতে সয়লাব গ্যালারী। সিতারা বেগম বিব্রত। কি করবেন বুঝতে পারছেন না। কোনরকমে ফোনটা বন্ধ করে ছেলের ফোন ছেলের রুমে দিয়ে আসলেন। গুলশান ট্রাজেডির পর কলেজ পড়ুয়া ছেলে নিয়ে উদ্বিগ্ন মা তবু কোথাও একটা স্বস্তি খুঁজে পেলেন যেন।
দৃশ্য ২: নাসিম সাহেব মসজিদে যাওয়ার জন্য তাড়াহুড়ো করছেন। জুমার দিন আজ। দরজা লাগানোর সময় স্ত্রীকে জিজ্ঞেস করলেন ছেলে কোথায়, ও যাবেনা? স্ত্রী প্রত্তুত্তরে বললেন, ছেলে ঘুমাচ্ছে। মূহুর্তেই দু'জনের দৃষ্টি একে অন্যের উপর স্থির। একটা ঠান্ডা হিম স্বস্তি যেন বয়ে গেল দু'জনের চোখেমুখে। নাসিম সাহেব দ্রুত মসজিদের দিকে এগিয়ে গেলেন।
দৃশ্য ৩: আজমল সাহেবের বড় ভাইয়ের ছেলে তার বাসাতেই থেকে পড়াশুনো করছে। তিনি আজ অফিস থেকে ফেরার পর তাকে নিয়েই তাদের স্বামী-স্ত্রীতে একচোট ঝগড়া হয়ে গেল। আজমল সাহেবের স্ত্রী বলছেন, তোমার ভাইয়ের ছেলেকে আমার বাসায় রেখে আমি আমার ছেলেমেয়ের বিপদ ডেকে আনতে পারবোনা। মারমুখো হয়ে আজমল সাহেবও বললেন, আমার ভাইপো তোমাদের কি ক্ষতি করছে? তখন তার স্ত্রী বললেন, আজ দুপুরে ওর নামে একটা বইয়ের পার্সেল আসছে, কি নাকি অনলাইনে অর্ডার করছে!
- তো, তাতে তোমাদের সমস্যা কি?
- কি বই পার্সেল আসছে তুমি জানো?
- কি বই!
- তাফসীর ইবনে কাছির।
এবার আজমল সাহেব পুরোই দমে গেলেন।দুশ্চিন্তা যেন তাকেও পেয়ে বসেছে।
দৃশ্য ৪: সাব্বির'রা ক'জন বন্ধু মিলে গেছে সুন্দরবন।পাঁচদিনের ট্যুর। কিন্তু যাওয়ার পথে মাথায় ভুত চাপলো আগে রামপাল হয়ে যাবে। ওখানে ব্যাপারটা আসলে কি হচ্ছে একটু সরেজমিনে বুঝা দরকার। আর এই ছেলেমানুষি করতে গিয়ে বনে ডুকলো ২দিন পরে। করমজল, হারবাড়িয়াতে মোবাইল নেটওয়ার্ক যতটা পাওয়া যায় ওটাই বেস্ট নেটওয়ার্ক সুন্দরবনের। এরপর গভীরে গেলে কটকা কিম্বা কচিখালী ট্যুরিস্ট পয়েন্টগুলোতে থেকে থেকে নেটওয়ার্ক। এছাড়া বাকীটা বন বন্যতায় লীন, নো নেটওয়ার্ক। আর তাতেই এদিকে হৈচৈ পড়ে গেল ঢাকাতে।
যে ছেলের দল পাঁচ দিনের মধ্যে ঢাকায় ফেরার কথা বলে ঘর থেকে বের হয়েছে, আজ সাতদিন হয়ে গেলো তাদের কোন খবর নেই। সবগুলো মোবাইল একযোগে বন্ধ! কোথায় তারা? মা-বাবারা টেনশনে কাঁদতে ভুলে গেছে। থানায় রিপোর্ট করবে নিখোঁজ বলে? তাহলে যদি মিডিয়াতে ফলাও হয়, আত্মীয়-স্বজনদের মুখ দেখাবে কি করে?
দৃশ্য ৫: পিস টিভি বন্ধের পিস নিয়ে মুফতি লুৎফুর রাহমান সাহেবের প্রথম ক'দিন ভালোই কেটেছিল, আহালে হাদীসদের একহাত দেখে নেয়া গেছে বলে। কিন্তু দিনে দিনে ঘটনার ঘনঘটায় ঘটনাগুলোর কিছুই মাথায় ঢুকছেনা। ছাত্রসেনারা মাদ্রাসা কেন্দ্রিক হলেও সেনাপতিরা সব বেরুতে লাগলো বিশ্ববিদ্যালয়গুলো থেকে। এই আজাব বন্ধ হবে কেমনে? ইসলাম তো এমন না। আহালে হাদীসের সাথে সুন্নির মূল্যবোধের দ্বন্দ্ব থাকলেও কোনদিন তো এমন সংঘাত হয়নি। শত্রু আসলে কে, স্বজাতি না বিজাতি?
দৃশ্য ৬, দৃশ্য ৭, দৃশ্য ৮, দৃশ্য ৯, দৃশ্য অযুত...
এবার গল্প নয় সত্যি :
ঘটনা ১: সাত-সকালে বাসা থেকে রিক্সাতে করে যাচ্ছি থেরাপি দিতে। পথের মাঝে দেখি পুলিশের বিশেষ চেক পোস্ট। তল্লাশির জন্য অলস ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে। আমাকে প্রথমে খেয়াল করেনি। পাশ কাটিয়ে চলে গেল আমার রিক্সা। হঠাৎই ডাক পরলো পিছন থেকে। তারপর দু'জন পুলিশ ছুটে এলো আমার রিক্সার কাছে। অল্প কিছুদিনের পরিবর্তনে আমার মুখের দাঁড়ি এখন ইঞ্চি চারেক। সন্দেহের এটাই মূল কারণ। তারপর তল্লাশি চললো। কিছু না পেয়ে বললো ম্যানিবেগ বের করতে। সেটাও চেক হলো। তারপর রাজ্যের হতাশা নিয়ে ছেড়ে দিল।
ঘটনা ২: বন্ধুদের সাথে শ্রীমঙ্গল যাচ্ছি। উদয়ন এক্সপ্রেসে। আমরা সাতজন। কম্পার্টমেন্ট ভর্তি মানুষ। অথচ শায়েস্তাগঞ্জ পার হওয়ার পর রেল পুলিশের একজন হঠাৎ এসে শুধু আমাকেই জিজ্ঞেস করলো, 'হুজুর কোথায় নামবেন?' প্রথমে বুঝতে পারিনি কাকে বলছে, হতচকিত হয়ে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলাম। যে আমি দ্বীন থেকে দূরে সরতে সরতে ঠিক ভাবে কুরআন পড়তেই ভুলে গেছিলাম, তাকেই বলছে কিনা হুজুর! তাও শুধু আমাকে!! বললাম, 'শ্রীমঙ্গল'। এরপর কম্পার্টমেন্টের আর কাউকে কিছু জিজ্ঞেস না করে সোজা চলে গেল।
অত:পর...
সেই কিশোর ছেলেটার কথা আজ খুব মনে পড়ছে।যদিও নামটা মনে নেই। তবে খুব বেশীদিন আগের কথা নয়। এই সেদিনের। গুলশান ট্রাজেডির কিছুদিন আগে। ডাক্তারের চেম্বারে বসে আছি সিরিয়ালের অপেক্ষায়। ছেলেটা আমার পাশে বসা।বাবার ফোনে গেম খেলছিল। এন্ড্রোয়েড ফোন। এভাবে গেম খেলে সময় নষ্ট করছে দেখে ভাব জমানোর চেষ্টা করলাম। ছেলেটা আমাকে একবার ভালো করে দেখলো, তারপর কেমন আড়ষ্ট হয়ে ছিল। তবে কথা বললো। জানলাম ক্লাস নাইনে পড়ে। মুসলমান। বাবার সাথে এসেছে। বাবা স্কুল শিক্ষক। জিজ্ঞেস করলাম, 'নামাজ পড়ো?' উত্তর দিলো, 'মাঝে মাঝে।' বললাম, 'ওযুতে মাথা মাসেহ করার পর ঘাড় মাসেহ করো?' বললো, 'হ্যাঁ, করি!' বললাম, 'কিন্তু আমাদের রাসূল (সাঃ) এটা করতেন তা কোন সহী হাদীসে পাওয়া যায়না, তাই এটা বিদায়াত।' ছেলেটা কি বুঝলো না বুঝলো, তাকিয়েই থাকলো। আমি বললাম, 'তোমার মোবাইলে 'share it' আছে।' বললো, 'হ্যাঁ, আছে তো!' তখন বললাম, 'আমি তোমাকে একটা ভিডিও লেকচার দি আব্দুল্লাহ আল কাফীর, সঠিক ভাবে অযু ও নামাজের নিয়মগুলো তাহলে জানতে পারবে।' ছেলেটা রাজী হলো। আমি দ্রুত ফাইলটা ট্রান্সফার করে দিলাম আর বললাম, 'বাসায় গিয়ে আব্বু-আম্মুকে দেখাবে। বন্ধুদেরও।' ছেলেটা মাথা নাড়লো। কিছুক্ষণ পর ওর সিরিয়াল আসাতে চলে গেল। যাওয়ার আগে খুব হাসি মুখে একটা সালাম দিয়ে বললো, 'ভাইয়া যাই।'
সেই ছেলেটার কথা আজ খুব মনে পড়ছে। আর ভয় হচ্ছে এই ভেবে, স্কুলে টিফিন ব্রেকের আড্ডায় ছেলেটা তার বন্ধুদের বলছে, " জানিস, আমার সাথে একদিন এক জঙ্গির দেখা হয়েছিল, মুখে বড় বড় দাঁড়ি, শুকনো-পাতলা, কেমন করে যেন কথা বলে ঠিক গুলশানের জঙ্গিগুলোর মতো...! "
সর্বশেষ এডিট : ০৬ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৬ সকাল ৮:০৭

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




