somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

আবার কলকাতা ৯

২৮ শে জুন, ২০১৫ ভোর ৪:২০
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আবার কলকাতা ৮

গুগল ম্যাপে ৮ থিয়েটার রোড
পার্ক সার্কাসের পশ্চিম কোনায় যেখানে পার্কস্ট্রিট আর সার্কাস এভিনিউ মিলে একটি ত্রিভুজ রচনা করেছে সেখান থেকে বেরিয়ে পার্কস্ট্রিট আর আচার্য জগদিশ চন্দ্র বসু (এজেসি) রোডের প্রায় সমান্ত্রাল একটি সড়ক পশ্চিমে জওহার লাল রোড পর্যন্ত গিয়েছে। আড়াই কিলোমিটার দীর্ঘ সড়কটির নাম শেক্সপিয়ার সরণী। এই সড়কেরই পুরনো নাম থিয়েটার রোড। এখন অবশ্য কলামন্দিরের কাছে একটি যাত্রীছাউনি ছাড়া থিয়েটার রোড নামটি আর কোথাও চোখে পড়েনা। শেক্সপিয়ার সরণী বিখ্যাত হবার অনেক কারন। পূর্ব দিকের সঙ্গীত কলা মন্দির আর পশ্চিমের এসি মার্কেট এই সড়কের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য দু’টি ল্যান্ড মার্ক। এছাড়া শেক্সপিয়ার সরণী থানা, মহারানা প্রতাপ উদ্যান, স্বামী অরবিন্দের আশ্রমের জন্যেও সড়কটি মানুষের কাছে পরিচিত।
সকাল থেকে এই সড়কে অভিজাত প্রাতঃভ্রমণকারিদের আড্ডা শুরু হয়। রং বেরঙের টি সার্ট, ট্র্যাক স্যুট, জগিং শর্টস পরে নানান রকমের মানুষ এই রোডের পাশে চেয়ার পেতে বসে মাটির ভাড়ে চা খান আর অন্যদেরকে চাখান। রাস্তার মোড়ে মোড়ে ফলের ঝুড়ি নিয়ে বসে যান হকাররা।
আমার অবশ্য সেরকম কোন কাজ নেই। আমি এখানে কাক ভোরে আসি ৮ থিয়েটার রোডে খুঁজে বের করতে। কলকাতার পিচ তেঁতে ওঠার আগে প্রায় প্রতিদিনই শুরু হয় আমার এই অভিযান। ৮ নম্বর থিয়েটার রোডে ছিলো প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের প্রথম অফিস।
আমি শেক্সপিয়ার রোডের বয়স্ক হাটিয়েদের (শব্দটি ঠিক হলনা,আমি প্রাতঃ ভ্রমণ কারিদের বুঝাতে চাইছি) জিজ্ঞাসা করেছি তারা আমার মুখের দিকে তাকিয়ে থেকেছেন। উত্তরদিতে পারেননি।

প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের প্রধান মন্ত্রীর অফিস

৮ নম্বর থিয়েটার রোডে স্বামী অরবিন্দের আশ্রম। দুই একটি বইয়ে লেখা হয়েছে, এখানেই ছিলো স্বাধীন বাংলা সরকারের সদরদপ্তর।।৩টি কারণে কথাটা মানতে পারিনি,
এক, এই ভবনের কোথাও সেটির উল্লেখ নেই।
দুই, এই রোডের ছেলে বুড়ো অনেকের কাছেই, জয় বাংলার অফিসের কথা জানতে চেয়েছি, কেউ কিছু বলতে পারেনি।
তিন, স্বামী অরবিন্দ আশ্রমের এই ভবনটিরই আগের নম্বর ছিলো ৪ থিয়েটার রোড।

আগে ছিলো ৪ থিয়েটার রোড

এক সকালে শেক্সপিয়ার সরণি থানায় হাজির হলাম। ডিউটি অফিসার বেশ মনোযোগ দিয়ে শুনে বললেন, আপনাদের ডেপুটি হাইকমিশন আছে কলকাতায়, সেখানে যোগাযোগ করে দেখুন।

একেবারে পার্ক্সট্রিট থেকে শুরু করে জওহরলাল নেহেরু রোড পর্যন্ত অনেকগুলি রাস্তা শেক্সপিয়ার সরণিকে উত্তর দক্ষিণে এফোঁড় ওফোঁড় করছে । পূবদিক থেকে ধরলে প্রথমে রাউডন স্ট্রিট, তারপরে লাউডন স্ট্রিট, আউটরাম স্ট্রিট, হাঙ্গারফোর্ড স্ট্রিট, উডস্ট্রিট, ক্যামাক স্ট্রিট, আর সবচেয়ে পশ্চিমে লর্ড সিনহা রোড। লর্ড সিনহা রোডেরও একটু গুরুত্ব আছে আমার কাছে। কারণ এই রোডের ১০ নম্বর বাড়িটি আমাদের প্রথম সরকারের গুরুত্ব পূর্ণ কিছু মন্ত্রীর বাস ভবন হিসাবে বরাদ্দ করেছিলো। পশ্চিমবঙ্গ সরকার। ১০ নম্বর বাড়িটি খুঁজে পেলেও সুবিধা হয়নি। বাড়িটি ভেঙ্গে এখন বহুতল ভবন হয়েছে। নাম অংকুর এপার্টমেন্টস। ১৯৭১ সালের কথা শুনে এবাড়ির বাসিন্দারা তাকিয়ে থেকেছেন। ব্যাস ওই পর্যন্তই।

অংকুর বিল্ডিংস, ছবি ইন্টারনেট থেকে নেওয়া

আমার বেশ কয়েকবারের প্রচেষ্টায় শিখেছি, শেক্সপিয়ার সরণীর দক্ষিণ পাশের বাড়ি গুলি জোড় সংখ্যার আর বেজোড় সংখ্যা গুলি উত্তরে। তবে ১৪ নম্বর বাড়ির পর আবার একটি যন্ত্রণা আছে, ১০ এ,বি’র কারণে বাড়ি খুঁজতে ঝামেলা হয়।
যখন দেখলাম ৮ নম্বর থিয়েটার রোডের বাড়িটির আগের নম্বর ছিলো ৪, মনে হল কোন কারণ ৪টি নম্বর পরে সংযোজিত হয়েছে। থিয়েটার রোড শেক্সপিয়ার হয়েছে ১৯৬৪ সালে, সে সময় সম্ভবত স্বামী অরবিন্দের ভবনের নম্বর ৪ ছিলো। হিসেবমত এর চারটি বাড়ি পরে আমাদের প্রবাসী সরকারের অফিস হবার কথা। কিন্তু যে বাড়িটির চেহারার সাথে ছবির বাড়িটির চেহারা মেলে, সেটি ১৪ নম্বর। মাঝে ১০ এ,বি’র মত আরও বাড়ি যদি হয়ে থাকে তাহলে ১৪ নম্বরটিকেও সেই ঐতিহাসিক বাড়ি ধরে নেয়া যায়। মুশকিল হল, এই বাড়িটি ৩ তলা, আমাদের বাড়িটি ছিলো দোতলা। স্বামী অরবিন্দ আশ্রমের সামনে দাঁড়িয়ে এসব সাত পাঁচ ভাবছি।

৪টি বাড়ি পরে এই বাড়িটি দেখতে অনেকটা ৮ নম্বর বাড়ির মতই তবে এটি ৩ তলা

গেটের ভিতর থেকে গার্ড বলে উঠলো বাবু কিছু খুঁজছেন?
মনে হল, স্বামী অরবিন্দ আশ্রম ভালো মত দেখার একটা মওকা পেলাম। বললাম আশ্রমে ঢুকবো? তিনি বললেন আসুন বাবু।ভিতরে আসুন আপনাদের জন্যেই তো আশ্রম।
বললাম এখানে কতদিন?
মনে হলো আমার কথায় খুশিই হলেন। বললেন ‘সেই আঠারা বরস থেকে এখানে আছি এখোন চৌষাট। আগে ধুতি কুর্তা পরে ডিউটি নিভাতাম আর এখোন পেন্ট সার্ট পরছি, সে বাবু ওনেক দিন’।
লোকনাথ নামের এই ভদ্রলোক, জয়বাংলার কথা একটু একটু মনে করতে পারলেন। বিহার থেকে কলকাত্তা এসেছিলেন কাজের খোঁজে। প্রথমে এমনিই থাকতেন আশ্রমে, এক সময় চাকরি হয়ে গেলো, দেশে গিয়ে বিয়ে করলেন, তারপরই পাকিস্তান থেকে বাঙ্গালরা কলকাত্তায় আসতে শুরু করলো, যুদ্ধের কথা শুনতে লাগলেন, কিন্তু ‘এই মকানে জোয় বাংলারা কভি আসেননি ওফিসভি হোয়নি’।

লোকনাথ; প্রায় ৪৬ বছর কাছে থেকেও চিনতে পারেননি জয় বাংলার অফিস

লোকনাথের কথা শুনে সন্দেহ নিয়ে ফিরে এলাম, বাংলাদেশ সরকারের প্রথম সদর দপ্তর খুঁজে বের করা হলনা। বাংলাদেশ সরকার কলকাতাসহ পৃথিবীর অনেক দেশে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি বিজড়িত স্থানগুলিকে চিহ্নিত করেছে। কলকাতায়ই বেকার হোস্টেলে বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘর হয়েছে শুনেছি। আর আমার মত নাদান মানুষ তিন তিনবার কলকাতায় গিয়েও প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের প্রধান অফিসটি খুঁজে পায়নি। দিল্লিতে আমাদের হাইকমিশনে কথা বলার সৌভাগ্য হয়েছে। তাঁরা বাড়িটিকে আনুষ্ঠানিক ভাবে প্রথম অফিস হিসাবে চিহ্নিত করার ব্যবস্থা করবেন বলে জানিয়েছেন।
আমাদের প্রথম অফিস হোক না হোক অরবিন্দ আশ্রমের বেশ কিছু ছবি তুলে এনেছিলাম।

গাড়ি বারান্দা

৮ থিয়েটার রোড, বাইরের দিকের ভবন

দেশে ফিরে নিশ্চিত হয়েছি। এটিই আমাদের সরকারের প্রথম অফিস। এখানে বসেই মুক্তি যুদ্ধ পরিচালনা করেছেন তাজউদ্দিন। মাত্র মাইল দুয়েক দূরে অন্যান্য মন্ত্রীদের মত তাঁরও বাসা বরাদ্দ হয়েছিলো সিআইটি রোডে।বাচ্চাদের নিয়ে সেখানে থাকতেন জোহরা তাজ উদ্দিন। অথচ দীর্ঘ নয় মাসের একটি রাতও দিন বউ বাচ্চার সাথে কাটাননি। তাঁর থাকা খাওয়া সবই ছিলো ৮ থিয়েটার রোড। এমন নেতা বাংলাদেশ আর কবে পাবে কে জানে।

তাজ উদ্দিন আহমেদ, আমাদের প্রথম প্রধান মন্ত্রী

মাত্র তিন কিলো মিটার দূরে ছিলো পারিবারিক বাসস্থান, অথচ দেশ স্বাধীন হবার আগে একদিনও থাকেননি
সর্বশেষ এডিট : ২৮ শে জুন, ২০১৫ ভোর ৪:২৭
৫টি মন্তব্য ৩টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

চুরি করাটা প্রফেসরদেরই ভালো মানায়

লিখেছেন হাসান মাহবুব, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:৫৩


অত্র অঞ্চলে প্রতিটা সিভিতে আপনারা একটা কথা লেখা দেখবেন, যে আবেদনকারী ব্যক্তির বিশেষ গুণ হলো “সততা ও কঠোর পরিশ্রম”। এর মানে তারা বুঝাতে চায় যে তারা টাকা পয়সা চুরি... ...বাকিটুকু পড়ুন

শিব নারায়ণ দাস নামটাতেই কি আমাদের অ্যালার্জি?

লিখেছেন ...নিপুণ কথন..., ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৫:৫৭


অভিমান কতোটা প্রকট হয় দেখেছিলাম শিবনারায়ণ দাসের কাছে গিয়ে।
.
গত বছরের জুন মাসের শুরুর দিকের কথা। এক সকালে হঠাৎ মনে হলো যদি জাতীয় পতাকার নকশাকার শিবনারায়ণ দাসের সঙ্গে দেখা করা সম্ভব... ...বাকিটুকু পড়ুন

ঘুষের ধর্ম নাই

লিখেছেন প্রামানিক, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:৫৫


শহীদুল ইসলাম প্রামানিক

মুসলমানে শুকর খায় না
হিন্দু খায় না গাই
সবাই মিলেই সুদ, ঘুষ খায়
সেথায় বিভেদ নাই।

হিন্দু বলে জয় শ্র্রীরাম
মুসলিম আল্লাহ রসুল
হারাম খেয়েই ধর্ম করে
অন্যের ধরে ভুল।

পানি বললে জাত থাকে না
ঘুষ... ...বাকিটুকু পড়ুন

প্রতি মাসে সামু-ব্লগে ভিজিটর কত? মার্চ ২০২৪ Update

লিখেছেন জে.এস. সাব্বির, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৯:০৮

মার্চ ২০২৪ সালে আমাদের প্রিয় সামু ব্লগে ভিজিটর সংখ্যা কত ছিল? জানতে হলে চোখ রাখুন-

গত ৬ মাসের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ভিউ ছিল জানুয়ারি মাসে। ওই মাসে সর্বমোট ভিজিট ছিল ১৬... ...বাকিটুকু পড়ুন

ইরান-ইজরায়েল দ্বৈরথঃ পানি কতোদূর গড়াবে??

লিখেছেন ভুয়া মফিজ, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:২৬



সারা বিশ্বের খবরাখবর যারা রাখে, তাদের সবাই মোটামুটি জানে যে গত পহেলা এপ্রিল ইজরায়েল ইরানকে ''এপ্রিল ফুল'' দিবসের উপহার দেয়ার নিমিত্তে সিরিয়ায় অবস্থিত ইরানের কনস্যুলেট ভবনে বিমান হামলা চালায়।... ...বাকিটুকু পড়ুন

×