
বাসে উঠেই মেজাজটা খারাপ হয়ে গেলো রফিক সাহেবের।
আজকাল অতি অল্পতেই কেনো জানি মেজাজ হারিয়ে ফেলেন রফিক সাহেব। এর জন্য এই জঞ্জাল শহর ঢাকাকেই দায়ী করতে চান ওনি।
রফিক সাহেব এই শহরকে আবার প্রানের শহর বলেও ডাকেন। ওনার ধারণা শুধু প্রাণ বাঁচাতেই নাকি মানুষ এই শহরে অবস্থান করে।
জীবনকে উপভোগ করতে নয়।
তাই এটা প্রানের শহর।
এই প্রাণের শহরে রফিক সাহেব একটা সফটওয়ার কোম্পানিতে কাজ করেন। তাই ওনি মেনেই নিয়েছেন প্রাণ বাঁচাতে এই প্রাণের শহর তার আর ছাড়া হবে না।
তাই বলে হাল ছেড়ে দিলে তো আর হবে না। ওনি স্বাস্থ্যের কথা ভেবে মেজাজ, রাগ এই গুলো ধরে রাখার চেষ্টা করে যান।
আজ রফিক সাহেব তার গ্রামের বাড়ি থেকে ঢাকা ফিরছেন।
বাস কাউন্টারে আসার পর থেকেই মেজাজ খারাপের পর্ব শুরু। বাস কাউন্টারে এসেই আবিষ্কার করলেন অসংখ্য যাত্রী এবং এরই সাথে বাসের স্বল্পতা। শুক্র শনিবারের ছুটির সাথে ২১ সে ফেব্রুয়ারির ছুটি মিলিয়ে ঈদের ছুটি হয়ে গেছে। তাই ঢাকা ফেরার এই বাড়তি চাপ।
কাউন্টার কর্তৃপক্ষ অবগত করলেন বাসের জন্য কমপক্ষে ১ ঘন্টা অপেক্ষা করতে তো হবেই, আবার বাসের শেষের দিকের একটিমাত্র সিট বিক্রির বাকি আছে। তড়িঘড়ি করে রফিক সাহেব সেই টিকেটটি নিলেন।
সেই থেকে মূলত মেজাজ একটু একটু করে খারাপ হতে থাকে।
রফিক সাহেবের মন খারাপের কারণ হলো সে বাসে উঠেই আবিষ্কার করলো তার পাশের সিটটি এক মেয়ের দখলে । বাসে চড়লে রফিক সাহেব একটু করে ঘুমাতে বড্ড ভালোবাসেন। হেলে দুলে বাস যখন চলে তখন তার কাছে দোলনায় ঘুমানোর মতো মনে হয়।
তাছাড়া লম্বা পথ পাড়ি দেয়ার সময় একটু ঘুমালে রাস্তাও খুব দ্রুত ফুরিয়ে আসে।
কিন্তু পাশে কোন মেয়ে বসলে সেই আয়েশি ঘুমটা আর হয়ে উঠেনা।
কারণ তখন একটা টেনশন কাজ করতে থাকে ঘুমের মধ্যে মাথা যদি ঐ দিকে হেলে যায় তাহলে তো বিশ্রী ব্যাপার হয়ে যাবে।
তাই আজ আর ঘুমানোর সুযোগ নেই। রফিক সাহেব সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলো যে, মোবাইলে মিউজিক প্লে করবে এবং চোখ বন্ধ করে কানে হেডফোন গুজাবে।
মেয়েটির দিকে এক ঝলক তাকিয়ে সিটে বসে পড়লেন।
বয়স ২২/২৩ এর বেশি হবেনা। মাস্ক ও ভারী চশমায় চেহারার প্রায় পুরোটাই ঢেকে আছে। এর মধ্যেও মনে হলো যথেষ্ট ফর্সা ও সুশ্রী।
চুল গুলো অনেকটাই ভেজা এবং ভীষণ এলোমেলো। এমন বয়সের কোন মেয়ের চুল এতোটা এলোমেলো করে রাখেনা।
কেমন যেনো উদাসীন !
স্বচ্ছ চশমার ভেদ করে চেহারায় এক দুশ্চিন্তার ছাপ দেখা যাচ্ছে। রফিক সাহেবের নিকট একটু অস্বাভাবিক মনে হতে লাগলো।
'যাক তাতে আমার কি?'
রফিক সাহেব এই ভেবে চোখ বন্ধ করলেন।
বাস ছুটে চলেছে। বিকেলের রোদ জানালা দিয়ে এসে পড়ছে কোলের উপর। ফেব্রুয়ারির এই সময়টায় আবহাওয়া খুব ভালোলাগে। তেমন শীত ও থাকেনা আবার গরম ও লাগে না।
মেয়েটি বাসে উঠার পর থেকেই ফোনে কথা বলে যাচ্ছে। একের পর এক কল আসছে। কারো সাথেই স্বাভাবিক ভাবে কথা হচ্ছে না। মাঝে মাঝে উচ্চ স্বরে আবার মাঝে মাঝে কান্নায় ভেঙে পড়ছে। রফিক সাহেব সহ আসে পাশের যাত্রীরা ও মেয়েটির এই অস্বাভাবিক বিষয়টি খেয়াল করেছেন।
রফিক সাহেব চোখ বন্ধই করে আছেন।
'আমার কি তাহাতে?'
কিন্তু সহসাই পাশ থেকে একটা কন্ঠ শুনা গেলো।
'ভাইয়া আপনার ফোনে কি এক মিনিট কথা বলা যাবে?'
রফিক সাহেব চোখ খুললো। মেয়েটির দিকে একটু তাকাতেই মেয়েটি পুনরায় অনুরোধ করলো।
রফিক সাহেব একটু ভাবনায় পড়ে গেলেন। এই ঢাকা শহর তার নাগরিককে নেগেটিভ ভাবনায় অভ্যস্ত করে তুলে। চারপাশে এতো এতো নেগেটিভ ঘটনা ঘটতে থাকে যে সমস্ত কিছু শুরুই হয় নেগেটিভ দিয়ে। রফিক সাহেবের মনে এ যাবৎ কালের যত নেগেটিভ ঘটনা শুনেছে বা দেখেছে সব ফ্ল্যাশ ব্যাক হতে থাকলো।
ভয় শঙ্কা নিয়েই মোবাইলটা এগিয়ে দিলো। কোন ঝামেলায় পড়তে যাচ্ছে না তো?
মেয়েটি একজনের সাথে মিনিট খানেক কথা বলে মোবাইলটি রফিক সাহেবের দিকে এগিয়ে দিয়ে বললো:-
'ভাইয়া আমার মামার সাথে একটু কথা বলেন।'
রফিক সাহেবের দুশ্চিন্তার মাত্রা আরো বাড়তে থাকলো। কি সব উদ্ভট ঝামেলায় পড়তে যাচ্ছে!
রফিক সাহেব হ্যালো বলতেই অপর পাশ থেকে এক পুরুষ কন্ঠ ভেসে আসলো।
'ভাই কি ঢাকা আসবেন?'
রফিক সাহেব:- 'জি'।
পুরুষ কন্ঠ:-
'ভাইয়া আপনার পাশে যে মেয়েটি সে আমার ভাগ্নি। ও একটা বড় বিপদে পড়েছে। আপনার কাছে অর্পণ করলাম। আপনি সাথে করে নিয়ে আসবেন প্লিজ।'
রফিক সাহেবের কাছে এটাকে 'অনুরোধে ঢেঁকি গিলা ' না। রাইস মিল গিলার মতো মনে হচ্ছে। রফিক সাহেবের দুশ্চিন্তা শুধু বাড়তেই থাকলো। কেমন যেন গরম গরম লাগছে। ভয়ে ও দুশ্চিন্তায় একটু একটু ঘেমে যাচ্ছে বোধহয়। বললো:-
'জি। অবশ্যই । কোন সমস্যা হবে না।'
লোকটি ধন্যবাদ জানিয়ে ফোন রাখলো।
রফিক সাহেব এইবার মেয়েটির দিকে একটু পাশ ফিরে বসলেন।
মেয়েটি তার চশমাটা খোলে হাতে নিলেন। সে রফিক সাহেবের দিকে তাকালো।
এক জোড়া অসহায় ক্লান্তি চোখ। জগতের সকল ক্লান্তি যেন গ্রাস করে রেখেছে। মেয়েটি মাথা নিচু করে বলতে লাগলো।
'ভাইয়া আমার সাথে বড় এক বিপদ ঘটে গেছে। আমি এইখানে জীবনে কোনদিন আসেনি। আমি জানিনা আমি এখানে কিভাবে এসেছি।'
কথা বলতে বলতে মেয়ের কন্ঠ ভারী হয়ে আসছে। কেমন যেন কেঁপে কেঁপে উঠছে।
রফিক সাহেব বললো:-
'আপনি খোলে বলুন। কোন ভয় নেই। এই বাস খুবই নিরাপদ। তাছাড়া আমি তো আছি। বিশ্বাস রাখতে পারেন।'
মেয়েটি আবারও রফিক সাহেবের দিকে এক ঝলক তাকালো। যখনই তাকাচ্ছে তখনই রফিক সাহেবের মধ্যে এক মায়া কাজ করতে লাগলো।
মেয়েটি বলতে লাগলো:-
'ভাইয়া। আমার বাসা ঢাকা আজিমপুরে। আমি সকাল বেলায় মগবাজারে আমার এক কাজিন এর বাসা থেকে ২ লক্ষ টাকা নিয়ে বাসায় ফিরছিলাম। সিএনজি নিলাম যেনো তাড়াতাড়ি বাসায় পৌঁছতে পারি। সিএনজিতে উঠার কিছুক্ষনের মধ্যে আমি কেমন যেন দুলতেছিলাম। তারপর আর কিছু বলতে পারি না।
যখন সজাগ হই তখন দেখি আমি কোন একটা রেস্টুরেন্টে। আমার সামনে খাবার ও একটা পানির বোতল রাখা। পানির বোতলটি আমি চিনতে পারলাম বোতলটি আমারই ক্রয় করা এবং বোতলটি আমার ব্যাগে ছিলো।
কিন্তু আমি দেখতে পেলাম ভেতরের পানির রং যেনো কেমন। রঙিন!
আমি তখনও পুরোপুরি ঠিক ছিলাম না। কেমন জানি দুলতে ছিলাম।'
মেয়েটি একটু চুপ মেরে গেলো। একটা বড় নিঃস্বাস নিয়ে রফিক সাহেবের দিকে একবার তাকালো এবং বললো:-
'খুব তৃষ্ণা পেয়েছে। এই বোতলের পানি খেতেও সাহস পাচ্ছি না।'
মেয়েটির হাতে এক বোতল পানি দেখিয়ে বললো।
রফিক সাহেব:- 'এটা কি সেই পানির বোতল?'
মেয়েটি:- 'সেই বোতল না। তবে এটা কোথা থেকে আমার হাতে এসেছে আমার মনে নেই।'
রফিক সাহেব:- ' আমার ব্যাগে পানি আছে । আমি কি আপনাকে দিবো?'
মেয়েটি সম্মতিসূচক মাথা নাড়লো। রফিক সাহেব পানি বের করে দিলেন।
মেয়েটি পানি খাচ্ছে।
রফিক সাহেব এবার অনেকটাই মেয়েটির বরাবর ঘুরে বসলো:-
'তারপর কি হয়েছে?'
মেয়েটি আবার বলতে লাগলো:-
'তারপর হঠাৎ করে দেখি আমি একটা সিএনজিতে বসে আছি। আর দুটো লোক ড্রাইভারকে সিএনজি ছাড়তে বলছে।
তখন আমার আবার মনে হলো আমি এখানে কেনো?
আমি চিৎকার করে বললাম: -
'আমি এখানে কেন? আমি কোথায় যাবো?'
লোক দুটো বললো:-
'আমরা বাগানে ঘুরতে যাবো।'
তৎক্ষণাৎ আমি সিএনজি থেকে নেমে পড়তে চেষ্টা করতে ছিলাম। কিন্তু সিএনজি ড্রাইভার সহ তিন জন আমাকে টানতে শুরু করলো।
আমি আসে পাশের মানুষ গুলোকে চিৎকার করে বলতে লাগলাম।
'এরা আমার কেউ না। আমাকে কেউ বাঁচান প্লিজ।'
লোক দুটো তখন আমাকে পাগল বলে সবার কাছে প্রচার করতে থাকলো।
আল্লাহর রহমতে একটা লোক এগিয়ে আসলো। আর আমিও প্রাণপণ চেষ্টা করেছিলাম। জানিনা আমার এতো শক্তি তখন কিভাবে এলো?
মেয়েটি আবারো থেমে গেলো। তার চোখে মুখে সেই ভয় এখনো তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে। মেয়েটির সাথে ঘটে যাওয়া ঘটনা রফিক সাহেবের মাঝে ছড়িয়ে যাচ্ছে।
রফিক সাহেব:-
'জায়গাটা কি চিনতে পেরেছেন?'
মেয়ে:-
'সিএনজিতে তখন উঠাইতে ছিলো তখন আমি একটা সাইনবোর্ডে লিখা দেখেছি। পানসি রেস্টুরেন্ট, মাধবপুর' ।
রফিক সাহেব:- 'তারপর কি হলো?'
রফিক সাহেবের নিকট বিষয়টি ভয়াবহ মনে হতে লাগলো।
মেয়ে:-
'কয়েকজন আমাকে বাসে তুলে দিলো। বলেন তো যদি সেই সময় আমার হিতাহিত জ্ঞান না আসতো- আমি হয়তো লাশ হয়ে যেতাম। তাই না ভাইয়া?'
রফিক সাহেব মেয়েটির পরিস্তিতি অনুভব করতে পারছে। সে ভাবছে মেয়েটিকে বিশ্রাম ও অভয় দেয়াটা খুব জরুরি।
রফিক সাহেব:-
'এই বিষয় নিয়ে আপনি মোটেও দুশ্চিন্তা করার দরকার নেই। আপনি এখন পুরোপুরিই নিরাপদ। টাকা চলে গেছে কোনই ব্যাপার না। আল্লাহ পাকের রহমত ছিলো বেঁচে গেছেন। মনে করুন এটা একটা দুঃস্বপ্ন ছিল।'
কাউকে সান্তনা দেয়া রফিক সাহেবের কাছে বিশাল কঠিন ব্যাপার মনে হয়।
মেয়ে:- 'আচ্ছা ভাইয়া। এরা যে বাগানের কথা বলেছিল, সেটা কি বাগান?'
রফিক সাহেব:-
'এখানকার আসে পাশে চা বাগান আছে।'
রফিক সাহেবের বাড়ি এখানে হওয়ায় সে এলাকার
সম্পর্কে অবগত আছে।
মেয়েটির ঘটনা রফিক সাহেবের ভেতর নাড়িয়ে দিলো। মেয়েটিকে এখন তার কাছে অন্য রকম লাগছে। মেয়েটির জন্য মায়া জন্মে গিয়ে কেমন যেনো দায়িত্ব চলে আসছে।
রফিক সাহেব বাসের জানালা আরেকটু খোলে দিয়ে বললো:-
'আপনি মাস্ক খোলে নেন। চশমাটা ও খোলে নিয়ে জানলার পাশে মাথা রাখুন।
আর ভাবুন এটা জাস্ট একটা দুঃস্বপ্ন ছিলো। এখন স্বপ্ন ভেঙ্গে সকাল হয়ে গেছে।
মেয়েটি হ্যা না কিছুই বললো না। তবে সে চশমা ও মাস্ক খোলে নিলো।
বাস ছুটে চলেছে। মেয়েটির দৃষ্টি বাসের জানালা হয়ে অনেকদূর চলে গিয়েছে। কিন্তু সে বোধহয় দেখছে না কিছুই । কারণ তার ভাবনায় সেই দুঃসহ স্মৃতি ভেসে বেড়াচ্ছে।
রফিক সাহেব মেয়েটিকে চোখ বন্ধ করে একটু ঘুমানোর চেষ্টা করতে বললো। মেয়েটি তাই করলো।
মেয়েটি বাসের জানালার দিকে মাথা কাথ করে চোখ বন্ধ করে আছে। বাতাস তার ভেজা চুল গুলো উড়িয়ে দিয়ে যাচ্ছে।
চোখ বন্ধ থাকলে মানুষকে দেখতে খুব নিষ্পাপ লাগে। মেয়েটিকেও নিষ্পাপ দেখাচ্ছে কিন্তু তার চেহেরায় ভয় ও অসহায়ত্ব ফুটে আছে।
রফিক সাহেব মেয়েটিকে নিয়ে ভাবতে শুরু করলো।
ঘটনার পেছনে উদ্দেশ্যে কি হতে পারে?
যদি শুধু টাকা নেয়াই উদ্দেশ্যে হয়ে থাকে তবে সেটা তো ঢাকাতেই সেরে ফেলেছে। মেয়েটিকে প্রায় ১৫০ কিলোমিটার দূরে হবিগঞ্জ নিয়ে আসার কি দরকার ছিলো? না কি অন্য কোন রহস্য আছে? কাছের কেউ কি জড়িত হতে পারে?
সে যে দুই লক্ষ টাকা বহন করছে সেটাও তো কারো জানার কথা না। কারণ টাকা নিয়েছে সে কাজিনের বাসা থেকে।
তবে কি হতে পারে?
টুকরো টুকরো ভাবনা এসে ভিড় করছে।
ভাবনা গুলো কোথাও লিখা দরকার ছিলো। ভাবতে হয় টুকরো টুকরো করেই। তারপর সব ভাবনা গুলো একটার পর একটি সাজিয়ে মোটিভ বের করার চেষ্টা করতে হয়।
রফিক সাহেবের ভাবতে আর ভালো লাগছে না। বার বার মেয়েটির একটি কথাই মনে ভেসে উঠছে।
'ভাইয়া। আর ৫ টা মিনিট পরে যদি আমি বুঝতে পারতাম। তাহলে আমি নিশ্চিত খবরের শিরোনাম হয়ে যেতাম। তাই না? এরা তো আমাকে সিএনজি তে তুলেই ফেলেছিল প্রায়।'
সত্যিই তো তাই। এমনটি তো আসলে হতেই যাচ্ছিল।
হবিগঞ্জের সাতছড়ি পাহাড়ি অঞ্চলে এই রকম অনেক ঘটনার ইতিহাস আছে। এতোটা গহীন ও নির্জন যে কোন মোবাইল নেটওয়ার্ক ও থাকে না।
গতকালই এমন একটা ঘটনা ঘটেছে। স্বামী তার অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রীকে নিয়ে ঘুরতে এসে গহীন জঙ্গলে নিয়ে মেরে চলে গেছে।
রফিক সাহেব আর ভাবতে পারছেনা। এটা বুঝতে পারছে মেয়েটি এক ভয়াবহ অবস্থার মধ্যে দিয়ে গেছে।
রফিক সাহেব মেয়েটির দিকে তাকালো। মেয়েটি মনে হয় ঘুমিয়ে আছে।
চেহারাটা কত শান্ত। মনে হচ্ছে এক ভয়ঙ্কর ঘূর্ণিঝড় শেষে পরিবেশ এখন শান্ত ও কোমল।
ঘুমাচ্ছে। ঘুমাক। ঘুমানোটা খুব দরকার।
এই রকম পরিস্তিতিতে জ্ঞান ফিরতে অনেকের কয়েকদিন পর্যন্ত ও না কি সময় লেগে যায়।এই দিক দিয়ে মেয়েটির ভাগ্য যথেষ্ট ভালো। সঠিক সময় জ্ঞান না ফিরলে আজ হয়ত কোন মর্গে ঠাই হতো।
রফিক সাহেব আর ভাবতে চায় না। তার ভাবনা গুলোতে ভয়ানক দুঃস্বপ্ন এসে ভিড় করছে।
বাস দ্রুত গতিতে ছুটে চলেছে। সন্ধ্যা পার হয়ে ধীরে ধীরে অন্ধকার গভীর হচ্ছে। শীতের ঠান্ডা বাতাস প্রচন্ড বেগে বাসের ভেতরে প্রবেশ করছে। কোট পড়া সত্ত্বেও রফিক সাহেবের ঠান্ডা লাগছে।
রফিক সাহেব খেয়াল করলেন মেয়েটির মাথা হেলে একেবারে বাসের জানালার উপরে চলে গিয়েছে। আর সিট বাসের পেছনে হওয়ায় ঝাঁকুনি ও হচ্ছে। ওনি মেয়েটিকে সজাগ করতে চেষ্টা করলেন যাহাতে মাথা সরিয়ে নিয়ে আসে। রফিক সাহেব খেয়াল করলেন -এখন অব্দি মেয়েটির নামই জানা হলো না।
তাই হ্যালো, হ্যালো, আপু, এই যে অনেক ভাবে ডাকার চেষ্টা করলেন। কিন্তু মেয়েটির ঘুম আর ভাঙছেনা।
ঘুম ভাঙছেনা দেখে রফিক সাহেবের টেনশন বেড়ে যাচ্ছে।
আবারো অজ্ঞান হয়ে গেলো না কি?
টেনশন বেড়েই যাচ্ছে। মেয়ে মানুষ - শরীরের কোথায় যে ধাক্কা দিবে ভেবে পাচ্ছেনা রফিক সাহেব। হাত দিয়ে মাথা নাড়িয়ে দিলো। তাতেও ঘুম ভাঙছেনা। টেনশনের মাত্রা দ্রুত বাড়ছে।
পাশ থেকে একজন যাত্রী পরামর্শ দিলো মুখে পানি ছিটা দেন।
রফিক সাহেব যাত্রীর পরামর্শ অনুযায়ী মুখে পানি ছুড়ে দিলো।
মেয়েটি চোখ খোললো। চোখ মুখে রাজ্যের ক্লান্তি। মনে হচ্ছে কয়েক যুগ ধরে এই চোখে ঘুম নেই।
রফিক সাহেব:-
'আমি খুবই দুঃখিত যে, আপনার মুখে পানি দিয়েছি। আমি ভেবেছি আবারও অজ্ঞান হয়ে গেলেন না কি? খুবই দুঃখিত।'
মেয়ে:-
'না ঠিক আছে। আমি হয়তো ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। আমি অনেক টায়ার্ড ভাইয়া।'
এক জোড়া বিষণ্ণ চোখ নিয়ে রফিক সাহেবের দিকে তাকালো। বড় মায়াবী সে চোখ।
রফিক সাহেব খুবই আশ্চর্য্য হচ্ছেন এই ভেবে যে, একটু আগেও যে মেয়েটিকে দেখে তার মেজাজ খারাপ হয়েছিল। তাকে এখন তার মায়া লাগছে। ভীষণ মায়া লাগছে।
মানুষ বড়ই বিচিত্র।
বাস ছুটে চলেছে প্রানের ঢাকার দিকে।
রফিক সাহেব:-
'আপনার মাথা জানালায় চলে গিয়েছিল। ঝাকুনিতে ব্যাথা পাইতেন। তাছাড়া ঠান্ডা বাতাস আসছে খুব। জানালা কি বন্ধ করে দিবো?'
মেয়ে:- 'বাতাস ভালো লাগছে। থাকুক।'
রফিক সাহেব:- আপনি তো মনে হয় অনেক ক্ষুধার্ত। খাবেন কিছু?
মেয়ে:- আমি খুব তৃষ্ণার্ত। কোল ড্রিংকস খেতে ইচ্ছে করছে। আচ্ছা ভাইয়া, আমি যদি ঐ সময় বুঝতে না পারতাম। তাহলে তো আমি এতক্ষনে লাশ হয়ে যেতাম!
রফিক সাহেব লক্ষ্য করলো মেয়েটি কোন ভাবেই সেই দুঃসহ স্মৃতি ভুলতে পারছেনা। ভুলতে পারাটা সহজ ও না। রফিক সাহেব শান্তনা দেয়ার চেষ্টা করে যাচ্ছে।
রফিক সাহেব:-
যা ঘটেছে সব ভুলে যান। মনে করেন এটা একটা বাজে রকমের দুঃস্বপ্ন ছিলো। এখন আপনার ঘুম ভেঙে সকাল হয়ে গেছে। ভয় বলতে আর কিছু নেই।
আর আমি আপনার জন্য ড্রিংকস এর ব্যবস্থা করছি।
রফিক সাহেবের সান্তনা কাজ হলো বলে মনে হলো না। মেয়েটির দৃষ্টি আবারো জানালা ভেদ করে দূর পানে। সে দৃষ্টি কিছু দেখে না। শুধু তাকিয়েই থাকে।
মেয়ে:- আমরা এখন কোথায় আছি?
রফিক সাহেব:- আমরা নরসিংদী জেলায় ঢুকেছি মাত্র। নরসিংদী পাড়ি দিতে আমাদের অনেক সময় লাগবে।
মেয়ে:- আমি ভাইয়া এই দিকে কোনদিন আসিনি। আমি কিছুই চিনিনা।
রফিক সাহেব:- আপনার কিছুই চিনতে হবে না। আপনার আর ভয়ের ও কিছু নেই। আপনি নিরাপদে পৌঁছে যাবেন। ইনশাআল্লাহ। আপনি বসেন। আমি বাসের সুপারভাইজার কে জিজ্ঞাস করি কোথায় বাস স্টপেজ দিবে?
মেয়েটি মাথা নেড়ে সম্মতি দিলো।
সুপারভাইজারের কথা শুনে রফিক সাহেব খুবই হতাশ হলো। বাস নাকি ঢাকার পূর্বে আর স্টপেজ দিবে না।
রফিক সাহেব সুপারভাইজারের হাতে কিছু টাকা দিয়ে বললো:-
'বাস রাস্তায় জ্যামে পড়লে দোকান থেকে খাবারের কিছু নিয়ে আসবেন । আর সাথে ড্রিংকস এবং পানি। '
সুপারভাইজার বিরক্তি ভাব নিয়েও সম্মত হলো।
বাস কোথাও থামবেনা শুনে মেয়েটি বললো:-
ভাইয়া আমার ওয়াশরুমে যেতে হবে। সেই সকালে গিয়েছিলাম।
রফিক সাহেব টেনশনে পড়ে গেলেন। রফিক সাহেব আবার এটাও ভাবছেন যে, ওনি এতো টেনশন নিচ্ছেন কেন? মেয়েটি তো তার কিছুই হয় না। উপকার করতে পারলে ভালো। না পারলে তো নেই। টেনশন নেয়ার কি আছে?
কিন্তু রফিক সাহেব টেনশন নিচ্ছেন। কিন্তু কেন নিচ্ছেন সেটা ওনি জানেন না। মেয়েটির জন্য টেনশন হচ্ছে।
মেয়েটির ওয়াশরুমে যাওয়াটা হয়তো জরুরীই হবে। নতুবা আমাদের দেশের মেয়েরা পারত পক্ষে কোন অপরিচিত লোকের কাছে ওয়াশ রুমে যাওয়ার কথা বলতে চায় না।
রফিক সাহেব সুপারভাইজার কে অনেক অনুরোধ করে বাস স্টপেজ এর জন্য রাজি করালেন। সামনে কোন একটা তেলের পাম্পে স্টপেজ দিবে বলেছে। রফিক সাহেব বাহিরে নজর রাখছেন তেলের পাম্প আসছে কি না।
বাস ছুটে চলেছে তার গন্তব্যের দিকে। চারিদিকে অন্ধকার। রাস্তার ডান পাশ দিয়ে মাঝে মধ্যে সাই সাই করে একটা দুটা গাড়ি ছুটে চলেছে।
রফিক সাহেব চুপ হয়ে ভাবছে। তার ভাবনা গুলো খুবই এলোমেলো।
কত কত মানুষ ছুটে যাচ্ছে। সবার মনেই কিছু না কিছু ভাবনা কাজ করছে। যেমনটি ভাবে মেয়েটি ভাবছে। সবাই ব্যাস্ত।
আমরা শুধু আমাদের নিজের ভাবনা গুলোই জানি। কেউ কারো ভাবনা জানিনা। অথচ আমরা সবাই পাশাপাশি।
এই মুহূর্তে রফিক সাহেব নিজেকে নিয়ে কিছু ভাবছেন না। তার ভাবনায় এখন মেয়েটি কাজ করছে। কত বড় বিপদ থেকেই না মেয়েটি রক্ষা পেলো।
মেয়েটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ল তে পড়ছে। বাবা মা এর একমাত্র মেয়ে। বাবা মা এর সাথে আজিমপুর বাস করেন। রফিক সাহেব মেয়েটি সম্পর্কে এই পর্যন্তই জেনেছেন।
মেয়েটি ফোনে কথা বলছে। মেয়েটির একটু পর পর অনেক ফোন আসছে। কিছুক্ষণ পূর্বে তার হবু বর এর সাথে কথা হয়েছে। ওই ভদ্রলোক রফিক সাহেবের সাথেও কথা বলেছে। ওনি সায়েদাবাদ বাস স্ট্যান্ডে অপেক্ষা করছে।
কিছুক্ষণ পর ড্রাইভার সাহেব একটি পাম্পে বাস স্টপেজ দিয়েছেন। মেয়েটি একটি স্বস্তির নিঃস্বাস ফেললো। সাথে রফিক সাহেব ও।
রফিক সাহেব মেয়েটিকে নিয়ে বাস থেকে নামলেন।
মেয়েটি তার হাতের ব্যাগ রফিক সাহেবের নিকট রেখে ওয়াশরুম সারলেন। তারপর কোল ড্রিংকস, বিস্কিট ও পানি কিনে নিয়ে বসে উঠলেন।
কিন্তু বাসে উঠার পর থেকে রফিক সাহেবের মধ্যে সেই ভয়টা আবার কাজ করতে লাগলো, যে ভয়টা সে প্রথমে পেয়েছিল। কোন প্রকার ঝামেলায় পড়ে যাওয়ার ভয়।
ভয়টা আবার ফিরে আসার কারণ হলো, বাস থেকে নামার পর সুপারভাইজার চুপিসারে এসে বলে গেলো:-
'ভাই, জানি মেয়েটিকে নিয়ে ঝামেলায় পড়েছেন। তবে বাস থেকে নেমেই দৌড় দিবেন।'
সুপারভাইজার বা বাস ড্রাইভারদের অনাকাঙ্ক্ষিত অনেক ঘটনার অভিজ্ঞতা হয়ে থাকে। সেই সূত্র ধরে সুপারভাইজার এই সতর্কবার্তা দিয়েছে।
রফিক সাহেবের কেনো জানি খুব বেশি ভয় লাগছে না। মেয়েটিকে কোন ভাবেই ওনার কাছে ওই রকম মনে হচ্ছে না।
বাস আবার ছুটে চলেছে। মেয়েটি রফিক সাহেবকে আবারো ধন্যবাদ দিলো।
মেয়েটির ফোন আসছে অবিরত। রফিক সাহেবের সাথেও কথা বলেছে ৩/৪ জন। সবাই উদ্বিগ্ন। যারা বিষয়টি জানছে। সবাই ফোন করে খোঁজ নিচ্ছে।
রফিক সাহেব লক্ষ্য করলো এখন পর্যন্ত মেয়েটার নামই জানা হলো না।
তাই ভাবলো নাম জানা যাক:-
'আপনার নামটাই জানা হলো না।'
মেয়ে:- 'আমার নাম ইন্দু।'
রফিক সাহেব:-
' সুন্দর নাম তো।
আলহামদুলিল্লাহ। ইন্দু এর গায়ে কোন কলঙ্ক লাগে নি।'
ইন্দু:- 'আপনি হাসালেন!'
ইন্দু এই প্রথম একটু হাসলো বলে রফিক সাহেবের কাছে মনে হলো।
রফিক সাহেব লক্ষ্য করলেন ইন্দু এর নিকট যারা ফোন দিয়েছে তারা সবাই এই বিষয়টিকে ভিন্ন ভিন্ন ভাবে নিয়েছে।
বাবা মা টেনশন করবে বলে ইন্দু বাবা মা কে মিথ্যে করে বলেছে যে, সে একটু দূরে এসেছে এবং তার সাথে তার বান্ধবী বিনথি আছে।
কিন্তু বাবা মা যখন বিষয়টি অন্য জায়গা থেকে জানতে পারলো তখন ইন্দু এর উপর তার মা খুব রাগ দেখালো।
রাগটা এমন ভাবে দেখালো যে ইন্দু মেয়েটা হতাশ হয়ে গেলো। শুধু ইন্দু এর পাশের কথা শুনেই মনে হলো তার মা বলছে:-
'তুই আমাদেরকে কলঙ্কের মধ্যে ফেলেছিস। তুই আর বাসায় আসার দরকার নেই।'
কথা গুলো ইন্দুকে একেবারে ভেঙে দিলো। রফিক সাহেব বুঝতে পারছে না কিভাবে সান্তনা দিবে।
রফিক সাহেব:-
'কোন সমস্যা বাসা থেকে?'
ইন্দু:-
'আর বললেন না ভাই। বাসা থেকে উল্টো বুঝতেছে।'
মেয়েটি বোধহয় এখন পড়েই যাবে।
রফিক সাহেব ভাবতে লাগলেন মেয়েটির পাশে এখন তার পরিবারের বা কাছের এমন কেউ একজন থাকা দরকার যে তাকে একটু জড়িয়ে ধরে রাখতে পারবে।
ভূমিকম্পে যেমন সবকিছু ভেঙে ধূমড়ে মুচড়ে যায়। ইন্দু মেয়েটিও এখন ধূমড়ে মুচড়ে যাবে।
রফিক সাহেব:-
আপনি কারো কথায় কোন কান দিবেন না। সবার আগে নিজের জীবন। এই মুহূর্তে আপনার পাশে আপনার খুব কাছের কেউ থাকা দরকার ছিলো। যে আপনাকে একটু জড়িয়ে রাখতো।
রফিক সাহেব ভাবনায় পড়ে গেলেন। মা এমন ভাবে কথা বলবে কেন? একমাত্র মেয়ে বেঁচে ফিরছে সেটা কি বড় কথা না? পরক্ষনে মনে হলো বিয়ে সংক্রান্ত বিষয় এখানে কাজ করলো কি না!!
ইন্দু এর চেহারায় জোৎস্না তো নেই ই। যেনো অমাবস্যা এসে ভর করেছে। অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। মনে হচ্ছে বিকট শব্দে একটা চিৎকার দিবে।
রফিক সাহেব লক্ষ্য করলেন যারাই ফোন দিচ্ছে কেউই ইন্দু এর এই ভয়ংকর ঘটনার প্রতি আগ্রহ দেখাচ্ছে না।
আরেকজনের সাথে ইন্দু এর কথা হলো। সে শুধু বার বার টাকার কথাই বলতে চাচ্ছে।
'সব টাকাই নিয়ে গেছে?'
'টাকা কি ব্যাগেই ছিলো?'
'এত টাকা তুই নিলে কেনো?'
'ব্যাংক বন্ধের দিন তুই টাকা নিয়েছিস কেন?'
'আর সিএনজিতে উঠেছিলে কেন? উঠেছিস তো সতর্ক থাকতে হবে না'
ঘুরে ফিরে অপর পাশের ব্যাক্তিটি টাকার মধ্যেই সীমাবদ্ধ। এই অবস্থায় ইন্দু একটু রেগেই গেলো।
ইন্দু:- তুই তো শুধু টাকা নিয়েই আছিস। আমার সাথে আর কি ঘটলো পুরোটা একটু শুন আগে।
ইন্দু রাগ করে ফোন রেখে দিলো। চোখ টলমল করছে। রফিক সাহেবের নিকট থেকে টলমল চোখ লুকাতে বাহিরে তাকিয়ে আছে।
রফিক সাহেব ইন্দু এর দিকে তাকিয়ে আছে। ভাবছে মেয়েটির উপর দিয়ে কতটা ঝড় ভয়ে যাচ্ছে।
মা বাবা একমাত্র মেয়ের বেঁচে ফেরাতে খুশি না দেখিয়ে কি সব বলছে। হবু বর এর সাথে আর কথপোকথন হয়েছে কি না রফিক সাহেব বুঝতে পারেনি। তার কাছের মানুষ গুলো টাকা হারানোর বিষয়টিকে প্রাধান্য দিচ্ছে।
সান্তনা দেয়ার কাজটি রফিক সাহেব খুব একটা ভালো পারেন না। তবুও চেষ্টা করে যাচ্ছেন।
রফিক সাহেব:-
আপনি কারো সাথে আর কথা বলার দরকার নেই। বাসায় গিয়ে ভালোভাবে বুঝিয়ে বলবেন। ফোনে হয়তো সবাই আপনার ব্যাপারটি ভালোভাবে বুঝেনি।
ভারী গলায় ইন্দু বললো:-
দেখেনতো ভাইয়া। পুরো টাকাটাই আমার । আমার টিউশনি করার কষ্টের জমানো টাকা। এদের কারোর টাকা না। তবুও এদের কাছে টাকাটাই বড়। আমি যে এতক্ষণে লাশ হয়ে যেতে পারতাম সেটা কারোর মাথা ব্যাথা না।
বলতে বলতে ইন্দু এর কন্ঠ আরো ভারী হয়ে আসলো। টলমল চোখ দুটো আবারও লুকানোর চেষ্টা।
ইন্দু:- ভাইয়া । আমার মনে হয় জ্বর চলে আসছে। শীত শীত লাগছে খুব।
রফিক সাহেবের খুব ইচ্ছে হলো ইন্দু এর কপালে হাত রেখে জ্বরের বিষয়টি চেক করা। রফিক সাহেব জানে কপালে হাত রাখলে মেয়েটির জ্বর মোটেও কমবে না। তবে সে মানসিক শক্তি পাবে। সে এখন কাউকে কাছের মানুষ ভাবতে পারছেনা। সে চাচ্ছে কেউ তাকে একটু বুঝুক। তাকে জড়িয়ে ধরে বলুক:-
'টাকা পয়সা হারিয়েছে কোন ব্যাপার না। আলহামদুলিল্লাহ। তুই বেঁচে ফিরেছিস। এটাই সব কিছু। আমাদের কাছে তুই ই সব।'
কিন্তু রফিক সাহেব কপালে হাত দিলেন না। ওনার কাছে মনে হলো অপরিচিত মানুষ হয়ে এটা করা একটু বাড়াবাড়ি হয়ে যাবে।
এটা করলে বরং রফিক সাহেবের উপর মেয়েটির আস্থায় ফাটল ধরতে পারে। রফিক সাহেবের উপর মেয়েটি ভরসা করতে শুরু করেছে। ব্যাক্তিগত অনেক কিছুই রফিক সাহেবের সাথে শেয়ার করেছে।
রফিক সাহেবের ধারণা মানুষ কোথাও না কোথাও আস্থা বা ভরসা পেতে চায়। মেয়েটি যখন দেখেছে তার কাছের মানুষ গুলো তাকে বুঝতে পারছেনা তখন রফিক সাহেবের আন্তরিক সঙ্গ তাকে তার প্রতি আস্থা এনে দিচ্ছে।
বাস ছুটে চলেছে দুর্বার গতিতে। রাস্তায় আজ খুব একটা জ্যাম নেই। ইন্দু একটা বিষণ্ণ মন নিয়ে বাহিরে তাকিয়ে আছে। যদিও বাহিরে দেখার মতো কিছুই নেই। চারদিকে অন্ধকার নেমে এসেছে। অন্ধকারেরও একটা সৌন্দর্য্য থাকে।
রফিক সাহেব চোখ বন্ধ করে ভাবছেন। মেয়েটির মনের অবস্থার অনেকটাই রফিক সাহেবকে পেয়ে বসেছে।
দুজনের ছোট খাটো কতোপকথনে বাস এগিয়ে যাচ্ছে।
রফিক সাহেব সায়েদাবাদ বাস স্ট্যান্ডে যাওয়ার আগেই যাত্রাবাড়ীতে নেমে যাবার কথা। যাত্রাবাড়ী থেকে সায়েদাবাদ ৫ মিনিটের দূরত্ব।
বাস যাত্রাবাড়ীর কাছাকাছি চলে আসছে।
রফিক সাহেব:-
আমি কি আপনার সাথে সায়েদাবাদ পর্যন্ত যেতে হবে? যাত্রাবাড়ী থেকে সায়েদাবাদ খুবই কাছে। আমি বাসের সুপারভাইজার কে বলে দিলে আপনাকে একবারে কাউন্টারে নামিয়ে দিবে। আর আপনি বললে আমি যেতেও আপত্তি নেই।
ইন্দু:-
না ভাইয়া আমি যেতে পারবো। আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ। আপনি যদি ওনাকে একটু বলে দিতেন!
রফিক সাহেব:- কাহাকে বলবো?
ইন্দু:- আমার ফিয়ন্সি (হবু বর)। যিনি আপনার ফোনে কথা বলেছিল।
রফিক সাহেব ইন্দু এর হবু বরের সাথে কথা বলে বিষয়টি বললেন। হবু বর বললো:-
'সমস্যা নেই। আমরাও যাত্রাবাড়ী চলে এসেছি।'
রফিক সাহেব স্বস্তি পেলো। তাহলে মেয়েটিকে আর একা ছাড়তে হলো না।
কিন্তু রফিক সাহেবের ভাবনায় এটা কাজ করছে না যে, ইন্দু এর হবু বর যে যাত্রাবাড়ী পর্যন্ত এগিয়ে এসেছে সেটা ইন্দু জানেনা কেনো?
রফিক সাহেব:-
ভালোই হলো। আপনার হবু বর যাত্রাবাড়ী চলে এসেছে। ওনি রাস্তায় এই বাসে উঠে যাবেন।
রফিক সাহেবের এই গুরুত্বপূর্ণ খবরে ইন্দুর কোন পরিবর্তন আসলো না। সে 'হ্যা' বা 'না' কোনটাই বললো না। ইন্দু এর দৃষ্টি জানালার কাঁচ ভেদ করে দূর পানে।
রফিক সাহেব:-
আমার নাম্বার তো আপনার হবু বর এর কাছে আছেই-যেহেতু আমার থেকে ফোন দিয়েছেন। বাসার পরিস্তিতি জানালে ভালো লাগবে ।
ইন্দু:-
নিশ্চয়ই। আপনার নাম্বারটি আমায় একটু বলবেন প্লিজ। আর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ঐদিকে বেড়াতে আসলে খুশি হবো।
ইন্দু রফিক সাহেবের নাম ও নাম্বার সেভ করে নিলো এবং ইন্দুর নাম্বারটি রফিক সাহেব নিয়ে নিলো।
তারপর কিঞ্চিৎ সময়েই বাস যাত্রাবাড়ীতে প্রবেশ করলো।
দুই জন ব্যাক্তি বাসে উঠলেন। একজন যথেষ্ট লম্বা। আরেকজন তুলনা মূলক একটু খাটো। ইন্দু লম্বা মানুটিকে দেখিয়ে ধীরে ধীরে রফিক সাহেব কে বললো:-
'এটা আমার ফিয়ন্সি (হবু বর)। '
মানুষটি যথেষ্ট লম্বা। মুখে মাস্ক পড়ে থাকায় চেহারা পুরোপুরি দেখা যাচ্ছে না। রফিক সাহেব তার সিট ভদ্রলোকের উদ্দেশ্যে ছেড়ে দিয়ে বললেন:-
'আপনি এখানে বসুন। আমি এখনই নেমে পড়বো।'
ভদ্রলোক বুঝতে পারলো রফিক সাহেব ই সেই লোক। তাই সে পরিচয় করিয়ে দেয়ার জন্য ইন্দুর জন্য অপেক্ষা করলো না।
ভদ্রলোক:- 'ধন্যবাদ।'
আর ড্রাইভারের উদ্দেশে বললেন:-
'ড্রাইভার আপনি থানার সামনে বাস রাখেন।'
ভদ্রলোক রফিক সাহেবকে ধন্যবাদ দিলো সত্য কিন্তু সেটার মধ্যে আন্তরিকতার ছোয়া ছিলো না। দিতে হবে তাই দেয়া। রফিক সাহেবের ধারণা লোকটি সম্ভবত হয়তো কোন সামরিক বাহিনীতে চাকরিরত। কারণ যারা সামরিক বাহিনীতে জব করে তারা এই রকম কমান্ডিং হয়ে থাকে। ড্রাইভারকে সে কোন অনুরোধ করেনি। কমান্ড করেছে।
ইন্দু তো তার অনেকের সম্পর্কে বিস্তারিত বলেছে। কিন্তু তার হবু বর সম্পর্কে তেমন কিছু বলছে বলে রফিক সাহেব মনে করতে পারছেনা।
রফিক সাহেব ভদ্রলোককে সিট ছেড়ে দেয়ার অর্থ ছিলো ইন্দু মেয়েটার পাশে তার খুব আপন একটা মানুষ দরকার যার বুকে নিঃস্বাস ফেলে দুঃসহ স্মৃতি টা কিছুটা হলেও ভুলতে পারে। কিন্তু রফিক সাহেব খেয়াল করলেন ভদ্রলোকটি ততক্ষন পর্যন্ত বসলেন না।
ভদ্রলোকটি দাঁড়িয়ে থেকেই ইন্দু কে বলছে:-
'আমি ওসির সাথে কথা বলেছি। নেমেই ওনাকে বিস্তারিত বলবো। এই ড্রাইভার তুমি থানার সামনে থামাবে।'
আবার ড্রাইভারকে বললেন।
ভদ্রলোককে খুব অস্থির দেখাচ্ছে। ইন্দু ভদ্রলোকের কথার জবাব দিচ্ছে।
রফিক সাহেব আর কথা না বাড়িয়ে বাস থেকে নেমে পড়লেন।
রফিক সাহেবের নেমে পড়লেন শুধু তার ব্যাগ নিয়ে নয়। অসংখ্য ভাবনা, অসংখ্য প্রশ্ন মাথায় নিয়ে।
পৃথিবীর মানুষ গুলো কত বিচিত্র। বিচিত্র তাদের চিন্তা ভাবনাও।
রফিক সাহেবের ভাবনায় ছিলো - ইন্দু এর হবু বর বাসে উঠেই ইন্দু মেয়েটার মাথা বুকের সাথে চেপে ধরে বলবে:-
কিচ্ছু হয়নি এটা একটা দুঃস্বপ্ন ছিলো। স্বপ্ন চলে গেছে এবং ইন্দু মেয়েটা একটা শান্তনার জায়গা পেতো, বড় একটা নিঃস্বাস নিতে পারতো।
রফিক সাহেব হাঁটা শুরু করলেন। তার ভাবনায় অনেক গল্প জমে আছে।
প্রানের ঢাকার রাস্তাঘাট ডিজিটাল বাতির আলোয় ঝলমল করছে। বাস ধীরে ধীরে রফিক সাহেবের নিকট থেকে দূরে চলে যাচ্ছে- সাথে ইন্দু মেয়েটিও।
বি: দ্র:- গল্পের রফিক সাহেব চরিত্রটি আমি নিজেই। আর এটা গল্প ছিল না। বাস্তব।
সর্বশেষ এডিট : ২৫ শে ফেব্রুয়ারি, ২০২২ দুপুর ১:২৯

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।



