ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার্স ইন্সটিটিউশন গত বছর থেকে দুই/তিন দফা দাবি আদায়ের আন্দোলন করছে। পাঠক, কি তাদের দাবি?? কি হবে যদি এই দাবি বাস্তবায়িত হয়??
আসুন একটু ধর্য্য ধরে পড়ুন।-
যে দুই দফা দাবি নিয়ে আন্দোলন -
(তাদের লিফলেট থেকে প্রাপ্ত)
১) বেতন বৈষম্য ও পেশাগত সমস্যা সমাধানে সরকারের দুটি আন্তমন্ত্রণালয় কমিটির সুপারিশ অবিলম্বে বাস্তবায়ন করা।
২) দেশের ইঞ্জিনিয়ারিং সার্ভিসে টাইমবার পদোন্নতি প্রথা প্রবর্তনসহ ইঞ্জিনিয়ারিং সার্ভিসকে ডেস্ক ও ফিল্ড ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে ভাগ করে একাডেমিক ব্যাকগ্রাউন্ড অনুযায়ী ডিগ্রিধারী ইঞ্জিনিয়ারদের ডেস্ক এবং ডিপ্লোমাদের ফিল্ডের দায়িত্ব প্রদান এবং সব প্রশাসনিক পদে কারিগরি পেশাজীবীর নিয়োগ বন্ধ করে জেনারেল ব্যাকগ্রাউন্ডের লোকদের নিয়োগ দেওয়া।
দাবি মাত্র দুটি হলেও এই দুই দাবির মধ্যে যাবতীয় সব দাবি লুকিয়ে রাখা হয়েছে। এই দুটি দাবির মধ্যে দেশের প্রকৌশল সেক্টরে মেধার অবমূল্যায়ন করে এই সেক্টরকে ধ্বংস করার রূপরেখা তৈরি করা আছে।
(মাননীয় প্রধানমন্ত্রী প্রাথমদিকে তাদের দাবি দাওয়া বিবেচনার আশ্বাস দেন। মন্ত্রণালয় থেকেও এসব দাবী বিবেচনার সুপারিস করা হয় পরবর্তিতে তাদের দাবিগুলো পর্যালচনার পর সঙ্গত কারণেই প্রধানমন্ত্রী তা বাস্তবায়ন না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন।
পাঠক লখ্যকরুন, তারা এখন তাদের ১ নং দাবী সরাসরি জনগণের কাছে না বলে মন্ত্রণালয়য়ের সুপারিস এবং প্রধানমন্ত্রীর আশ্বাসের কথা বলে বেড়াচ্ছেন। ওই অযৌক্তিক দাবী জনগণকে বললে কেউ তা সমর্থন করবেনা সেটা তাদের ভালোই জানা আছে। )
দেখুন তাদের ১নং দাবি বাস্তবায়িত হলে কি হবে?
আপনারা জানেন, ইঞ্জিনিয়ারিং সেক্টরে “প্রথম শ্রেণীর গেজেটেড” পদে সরাসরি নিয়োগ পেতে হলে স্বীকৃত বিশ্ববিদ্যালয় থেকে BSc ইঞ্জিনিয়ারিং পাস করে বিসিএস পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে (প্রায় দুই লাখ মেধাবী প্রার্থীর সাথে প্রতিযোগিতা করে) দীর্ঘ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে নিয়োগ পেতে হয়।
ডিপ্লোমাদের দাবি বাস্তবায়িত হলে গেজেটেড পদের ৫০% ডিপ্লোমাদের জন্য ছেড়ে দিতে হবে।
অর্থাৎ যদি “প্রথম শ্রেণীর গেজেটেড” পদে ১০০ জন নিয়োগ দিতে হয় তবে ৫০ জন- BSc ইঞ্জিনিয়ারিং পাস করে বিসিএস পরীক্ষা দিয়ে আসবে, আর বাকি ৫০ জন- ডিপ্লোমারা প্রমোশন পেয়ে আসবে।
পৃথিবীর সবখানে এই হার যখন ০% এ নামিয়ে আনা হচ্ছে সেখানে বাংলাদেশে এটা কি হচ্ছে???
(এমন হলে ডিপ্লোমারা SSC পাস করে নিকটস্থ কোন পলিটেকনিকে পড়ে একটি ২য় শ্রেণীর পদে ঢুকে দিন গুনবে কখন ৫০% কোটায় তারা ১ম শ্রেণীর গেজেটেড অফিসার হবে। অপরপক্ষে, সাধারণ ছেলেমেয়েদের কষ্ট HSC তে ভালো রেজাল্ট করে, ভর্তিযুদ্ধে লড়াই করে “প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে” পড়ে এবং ধৈর্যের পরীক্ষা “বিসিএস” পাড়িদিয়ে প্রথম শ্রেণীর গেজেটেড পদে এসে দেখবে ৫০% পদে ডিপ্লোমা !!!)
বেতন বৈষম্য বলতে আসলে কি বোঝাচ্ছে তা যেনে নিন। একজন “বিসিএস ক্যাডার প্রথমশ্রেণীর অফিসার” ৯নং গ্রেডে যে স্কেলে বেতন পান, একজন ডিপ্লোমা ১০ম গ্রেডে (২য় শ্রেণীর স্কেল) বেতন পায় প্রথম শ্রেণীর চেয়ে মাত্র ৩ হাজার টাকা কম স্কেলে।
তারা চাচ্ছেন পোষ্ট ২য় শ্রেণীর রেখেই তাদের প্রথম শ্রেণীর অফিসারদের মত ৯ম গ্রেডে বেতন দেয়া হোক।
এখন দেখি তাদের ২য় দাবি বাস্তবায়িত হলে কি হবে?
২য় দাবিটির কয়েকটি অংশ আছে।
প্রথম অংশঃ “দেশের ইঞ্জিনিয়ারিং সার্ভিসে টাইমবার পদোন্নতি প্রথা প্রবর্তনঃ”
তাদের টাইমবার পদ্ধতির মূল কথা হচ্ছে- একজন Diploma ধারী ২য় শ্রেণীর চাকুরী করে ৫ বছরের অভিজ্ঞতাসম্পন্ন হলেই তাকে BSc ইঞ্জিনিয়ারিং পদের যোগ্য বিবেচিত করে প্রমোশন দিতে হবে।
>> ২য় দাবির ২য় অংশঃ “ইঞ্জিনিয়ারিং সার্ভিসকে ডেস্ক ও ফিল্ড ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে ভাগ করে একাডেমিক ব্যাকগ্রাউন্ড অনুযায়ী ডিগ্রিধারী ইঞ্জিনিয়ারদের ডেস্ক এবং ডিপ্লোমাদের ফিল্ডের দায়িত্ব প্রদানঃ”
খুবই মজার দাবি। আচ্ছা বলুন তো, ইঞ্জিনিয়াররা ডেস্কে বসে থাকলে ইঞ্জিনিয়ারিং কিভাবে হয়?? একটি বড় প্রজেক্টের প্রজেক্ট ম্যানেজার, প্রজেক্ট ইঞ্জিনিয়ার, কোয়ালিটি কন্ট্রোল ইঞ্জিনিয়ার, সেফটি ইঞ্জিনিয়ার ইত্যাদি অনেক পোষ্ট আছে। বিশ্বে ইঞ্জিনিয়ারিং সেক্টরের ৮০% গ্রাজুয়েট বা PHD ইঞ্জিনিয়াররা ফিল্ড বা প্রজেক্টে প্রোডাকশন ওরিয়েন্টেড কাজ করে।
বাংলাদেশের গ্রাজুয়েট ইঞ্জিনিয়ারদের ডেস্কে বসিয়ে আমলা বানিয়ে পুরো ইঞ্জিয়ারিং সেক্টর ডিপ্লোমাদের দিয়ে দিলে এই দেশের ভবিষ্যৎ কি হবে তা সহজেই অনুমেয়।
২য় দাবির শেষ অংশঃ “প্রশাসনিক পদে কারিগরি পেশাজীবীর নিয়োগ বন্ধ করে জেনারেল ব্যাকগ্রাউন্ডের লোকদের নিয়োগ দেওয়া”
বন্ধুরা, প্রশাসন মানেই কিন্তু মাঠ পর্যায়ের প্রশাসন নয়। রাষ্ট্রীয় উচ্চ পদে এবং বিশেষ কিছু নিতিনির্ধারক পদে বা অধিদপ্তরে (যেমন পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়য়) বা বিভিন্ন ব্যাক্তিবর্গের উপদেষ্টা হিসেবে পেশাজীবী অভিজ্ঞ লোকজন দরকার হয়। অনেক পেশাজীবীই তাদের যোগ্যতা প্রমাণ করে সচিবালয়ে এবং নিতিনির্ধারক পদে কাজ করে থাকেন। দেশে অনেক পেশাজীবী সংসদ সদস্যও আছেন। এতে দেশের সার্বিক লাভ ছাড়া ক্ষতি নেই। খুবই যুক্তিসঙ্গত কারনে এসব পদে উচ্চশিক্ষিত প্রকৌশলীরাই যায়। সঙ্গত কারণেই এখানে ডিপ্লোমাদের সুযোগ নেই।
ডিপ্লোমারা নিজেদের ইঞ্জিনিয়ার দাবি করছে অথচ প্রতিহিংসা বশত তারা আন্দোলন করছে যেন কোন ইঞ্জিনিয়ারকে নিতিনির্ধারক পদে যেতে না দেয়া হয় !!! কি অদ্ভুত মানসিকতা!!!
পাঠকদের উদ্দেশ্যে কিছু কথাঃ
প্রিয় বন্ধুরা, আমাদের এই ছোট গরিব দেশ। এটা সত্যি যে এই দেশের প্রকৌশল সেক্টর ইউরোপ, আমেরিকা বা জাপানের মত উন্নত হয়ে যায়নি। এদেশে সবারই সীমাবদ্ধতা আছে। এদেশে মিস্ত্রি দিয়ে ৩-৪ তলা ভবন তৈরি হয়ে যায়। কিন্তু এর পরও বাবা-মায়েরা স্বপ্ন দেখে তাদের সন্তানকে উচ্চ শিক্ষিত বানাবে। ডাক্তারি, ইঞ্জিয়ারিং বা BBA, MBA পড়াবে। আমরা এমন কোন দাবী সমর্থন করবনা যাতে আমাদের ছেলেমেয়েরা উচ্চ শিক্ষায় আগ্রহী না হয়ে SSC পাস করার পর একটি ডিপ্লোমা করে জীবন কাটিয়ে দেবার সিদ্ধান্ত নেয়।
এদেশে এখন হাজার হাজার গ্রাজুয়েট ইঞ্জিনিয়ার বেকার।
একটু ভেবে দেখুন, “ডিপ্লোমা ইন নার্সিং” পাস করে যদি কেউ বলে যে তাকে টাইমবার পদ্ধতিতে নির্দিস্ট সময় পর গ্রাজুয়েট ডাক্তারের পদে প্রমোশন দিতে হবে তখন কি অবস্থা হবে??
বিশ্ববিদ্যালয়ের ল্যাব সহকারী এবং ডেমনেস্ট্রেটররা কিছুদিন পর প্রভাষক পদে প্রমোশন চাইবে !!
( সরকারী গেজেট অনুসারে প্রকৌশলে স্নাতক ডিগ্রীধারী ও আইইবি'র সদস্য হওয়া সাপেক্ষে নামের পূর্বে Engr. লিখতে পারবেন বলে উল্লেখ আছে । এটি আন্তর্জাতিক বিধিবিধানের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ ।
আমাদের দেশে অন্যান্য পেশাজীবি যথাঃ ডাক্তার, আইনজীবি, ইত্যাদি পেশাজীবিগণ সংশ্লিষ্ট স্নাতক ডিগ্রী ছাড়া সংশ্লিষ্ট পেশাজীবি পরিচয় নামের সাথে ব্যবহার করতে পারেন না।)
ডিপ্লোমা ভাইদের উদ্দেশ্যে কিছু কথাঃ
ভাই, আপনারা ১৫/১৬ বছর বয়সে আর্টস/সায়েন্স/কমার্স থেকে SSC পাস করেছেন। এর পর পলিটেকনিকে গিয়ে ২০/২১ বছর বয়সে ডিপ্লোমা সার্টিফিকেট নিয়েছেন। এত অল্প বয়সে চাকুরী করতে না গিয়ে গ্রাজুয়েশনটা করেই ফেলুন। এদেশে এখন সাধারণ মানের ছাত্ররাও অনার্সে ভর্তি হয়ে মাস্টার্স পর্যন্ত সহজেই পড়ালেখা করে। আপনরা HSC সমমানের সার্টিফিকেট নিয়ে সারা জীবন কাটিয়ে দেবার কথা ভাবছেন কেন??
আর্থিক সমস্যা থাকলে কয়েক বছর চাকুরী করে নিন, এর পর শুরু করুন। এখন দেশে অন্তত ২৫টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আছে যেখানে সারাদিন চাকুরী করেও সন্ধ্যার পর ক্লাস করে অনেকে গ্রাজুয়েশন করছে। এছাড়া গাজীপুরে DUET আছে, IEB থেকেও গ্রাজুয়েশন করানো হয় AMIIE এর মাধ্যমে।
এছাড়া আপনার ভবিষ্যৎ সন্তানদের কথা ভাবুন। আপনার ছেলে/মেয়ে যদি কেউ ইঞ্জিনিয়ার হবার স্বপ্ন দেখে তখন তাকে কি পলিটেকনিকে পাঠাবেন? নাকি তাকে একটি প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি করার চেষ্টা করবেন?? আমি নিশ্চিত আপনি ২য় টাই করবেন।
তাই, এসব অযৌক্তিক দাবি করে নিজেদের ভবিষ্যৎ সন্তানদের অধিকার হরণ করবেন না।
সব শেষেঃ
ডিপ্লোমা ভাইয়েরা, আপনারা “প্রথম শ্রেণীর গেজেটেড” পদ চাইলে পিএসসির কাছে আন্দোলন করুন যেন আপনাদের BCS পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে দেয়া হয়!!!!!! সেই আন্দোলনে আমিও সরিক হব। আসুন, যোগ্যতা প্রমাণ করুন। যোগ্যতা প্রমাণ করে শুধু ৫০% কেন? পারলে ১০০% পদই নিয়ে যান। কোন আপত্তি নেই।
সামনের দরজা দিয়ে আসুন। দেশের হাজারো তরুণের স্বপ্ন “বিসিএস” এর ৫০% পদ পেছনের দরজা দিয়ে দখলের চেষ্টা করবেন না।

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।


