বাংলা , বাঙালি ও বাংলাদেশের উৎপত্তি
সূত্র: একুশের দলিল- এম আর আকতার মুকুল
চীনা ভাষায় ‘বংগ’ শব্দটির অর্থ হচ্ছে জলাশয় । অথ্যাৎ নদীমাতৃক এলাকা । বাংলাদেশ শব্দটির উৎপত্তি হচ্ছে এ রকম : বংগ -বংগদেশ - বংগীয় এলাকা - বংগ প্রদেশ -পূর্ব বংগ -পূর্ব বাংলা -বাংলাদেশ ।
উপমহাদেশে সর্বপ্রথম ইসলাম প্রচারের জন্য মো: বিন কাসেমের আগমন ঘটে । ইনি পাকিসত্মানের সিন্ধু প্রদেশ জয় করেন ।৯০০-১০০০ সাল পর্যনত্ম ইরান ও পার্শ্ববর্তী এলাকায় অসংখ্য সুফীসাধক ,পীর ফকির ,আউলিয়া ,দরবেশ ,দার্শনিক ও কবির আর্বিভাব ঘটে । ইমাম গাজজালীর মত শরীয়ত পন্থীদের প্রচেষ্টায় অচিরেই আরব,ইরাক,এমনকি সিরীয় অঞ্চল থেকেও সুফী মতবাদের গতি রুদ্ধ হয় । কিন্তু এর মধ্যেই পারস্যের ( ইরান) মুসলিম সাধকরা সুফী দর্শনের পতাকাকে সমুন্নত করে দেশ থেকে দেশানত্মরে বিশেষ করে ভারত উপমহাদেশে ছড়িয়ে পড়ে । পবিত্র ইসলামের বাণী বহন করে ১১০০ সালের গোড়ার দিকে সমরখন্দ,বোখরা,সিরিয়া,এমনকি আরব ভূমি থেকেও দলে দলে সুফী সাধকরা ভারত উপমহাদেশের তুর্কিস্থান থেকে শুরু করে সুদূর বাংলাদেশ পর্যনত্ম এই বিরাট ভূখন্ড শুধু ক্ষমতার দাপটে ইসলাম ধর্ম প্রচার করে তা স্থানীয় জনসাধারন মধ্যে স্থায়ী ভাবে গ্রহণযোগ্য করে তোলার পুরো কৃতিত্বটাই সুফী সাধকদের ।
১১৫০-১৪০০ সময় কালকে উপমহাদেশে সুফী মতবাদ প্রচারের গোড়াপত্তন ও বিকাশের যুগ বলা হয় ।সুফী মনীষিরা উপমহাদেশের প্রতিটি অঞলে পবিত্র ইসলাম ধর্মের মূল আদর্শকে অক্ষুন্ন রেখে আঞলিক সংস্কৃতি ,ভাষা ও লোকাচারকে সম্মান প্রদর্শন ও যতদূর সম্ভব গ্রহণ করায় ব্যাপক সফলতা অর্জন করেছিলেন ।এরই প্রেক্ষাপটে আমরা দেখতে পাই যে ,মওলানা দাউদ,কবি মিয়া সাধন ,কবি কুতুবন ,কবি মনঝন এবং মালিক মোং জায়সীর মতো সুফী সাধক ও কবিরা উপমহাদেশের উত্তর ভারতীয় অঞলে পদার্পন করে যখন উপলব্ধি করেন যে স্থানীয় জনসাধারন ফারসী ভাষায় অজ্ঞ , তখন এরা সবাই স্থানীয় ঠেট হিন্দী ভাষা শিক্ষা গ্রহণ করেন । এরপর এইসব কবি আঞলিক লোকগাথার কাহিনী Aej¤^b করে চন্দায়ন , মৈনাস তবনত্মী ,মৃগাবত,মধুমালতী এবং পদুমাবত এর মতো সুফী কাব্যে রচনা করেন ।
ঠেট হিন্দীতে লেখা এই সুফী কাব্য আঞলিক লোকগাথা ভিত্তিক হওয়ায় কয়েক শতাব্দী পর্যনত্ম উত্তর ভারতে জনপ্রিয়তার চরম শিখরে অবস্থান করেছিলো ।আবার বঙ্গীয় এলাকায় হিন্দী ভাষা বোধগম্য নয় দেখে এইসব সুফী কাব্যগ্রন্থ পরিবর্তিত পরিবেশে কবি দৌলত কাজী ,কবি আলাওল , মো: খাতের ,মো: কবীর প্রমুখ বাংলায় ভাবানুবাদ করেন । সুফী সাধক ,মনীষি ,পীর ও দরবেশেরা সুফী মতবাদের মাধ্যমে পবিত্র ইসলাম ধর্ম প্রচারের সময় সব সময়েই স্থানীয় ভাষা ,সংস্কৃতি,লোকাচার প্রভৃতিতে সর্বাধিক গুরত্ব আরোপ করেছিলেন বলেই তাদেও মিশন অভূতপূর্ব সাফল্য লাভ করেছিলো ।
মোগল সম্রাট হুমায়নের নিকট পাঠান সম্রাট শেরশাহ সুরীর পরাজয়ের পর যখন পাঠানরা দলে দলে পলায়ন করে পদ্মা,মেঘনা,যমুনা বিধৌত এলাকায় আশ্রয় নেন,তখন তারা উপলব্ধি করতে পারেন যে ,তাদের পক্ষে আর ¯^xq জন্মভূমিতে প্রত্যাবর্তন করা সম্ভব নয় ,ফলে অত্যনত্ম অল্প সময়ের মধ্যে এরা নিজস্ব ¯^KxqZvi পাশাপাশি বাংলার সংস্কৃতি ,লোকাচার এবং ভাষাকে গ্রহণ করেন । এমনকি স্থানীয়ভাবে এরা বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে সংসার ধর্ম পালনের মনোযোগী হন এবং কালক্রমে নিজেদের বাঙালী বলে পরিচয় দিতে কুন্ঠাবোধ করেননি ।
শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে এই দর্শন বাংলাদেশে সু প্রতিষ্ঠিত হয়েছে । তাই উপমহাদেশের পশ্চিমাঞলের পর প্রয় হাজার মাইলের ব্যবধানে একটা ভৌগিলিক সীমারেখায় বাঙালী মুসলমানরা ¯^xq বাংলা ভাষা ,কৃষ্টি ,সংস্কৃতি আলোকে নিজস্ব ¯^KxqZvi সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে বহু ঘাত ুপ্রতিঘাতের মাঝ দিয়ে ¯^vaxb বাংলাদেশ সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছে । অথচ দিল্লীতে প্রয় ৭০০ বছর রাজত্ব করেও মুসলমানরা সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করতে পারে নি ।
১৯৪৭ সালের ভারত বিভাগের পর তৎকালীন পূর্ব পাকিসত্মনে প্রায় ১২/১৪ লাখের মতো অবাঙালী ( বিহারী ) মুসলমানের আগমন হয়েছিল । ভারত ও পাকিসত্মান থেকে এক সময় হাজার হাজার ব্যবসায়ী আফ্রিকার কেনিয়া,উগান্ডা প্রভৃতি দেশে বসতি স্থাপন করেছিল । কিন্তু তারা স্থানীয় সংস্কৃতি ,লোকাচার , রীতি পদ্ধতি ইত্যাদি বর্জন করেছিল ।এমনকি স্থানীয় ভাষা পর্যনত্ম শেখাকে ঘৃন্য বলে বিবেচনা করেছে । এরই ফল হিসাবে এখন এরা আবার বাস্তুচ্যুত হয়ে বৃটেনে আসত্মানা গেড়েছে । এদের কোনও দেশ নেই ,কোনও ভাষা ুসংস্কৃতি নেই এবং কোনও ঐতিহ্য নেই । এক কথায় এদের গর্ব করার কিছুই নেই ।এরা সবাই করুনার পাত্র । এই প্রেক্ষাপটে বিচার করলে ১১০০ সাল থেকে শুরু করে সুফী মনীষিরা ইসলাম ধর্ম প্রচারের সময় যে উদার মনোভাবের পরিচয় দিয়েছিলেন তার সুদুরপ্রসারী ফল প্রমানিত হয়েছে ।
যে সব বহিরাগত মুসলমান বাংলাদেশে বসতি স্থাপন করেছে এবং যারা হিন্দু ধর্মের বর্ন ও শ্রেণী বিভাগের অত্যাচারে ধর্মানত্মরিত হয়েছে ,এরা সবাই এদেশেরই সনত্মান ,এখানকার পরিবেশে সৃষ্ট,এখানকার কৃষ্টি ও সংস্কৃতির দাবীদার এরাই এবং ¯^xq মাতৃভূমি হিসাবে বাংলাদেশকে নিয়ে এরা গর্ব অনুভব করে বলেই সবাই বাঙালী ও ধর্ম বিশ্বাসে মুসলমান ।
সর্ব প্রথম খীষ্ট্রপূর্ব ১৫০০-৬০০ অব্দ পযনর্ত্ম প্রাকৃত ভাষার অসিত্মত্বেও উল্লেখ পাওয়া যায় ।খৃ:পূর্ব ৬০০-২০০ অব্দ পযনর্ত্ম পলি ভাষার প্রচলন ছিল বলে জানা যায় ।ব্রাক্ষন্যবাদের পুনরুরুথানের ফলে ৬০০-১০০০ সাল পযনর্ত্ম বাংলা সাহিত্যে ব্যাকরনের বাধ ভেঙ্গে যাওয়ায় আর্য পন্ডিতেরা এ যুগকে বাংলা ভাষার “অপভ্রংশের যুগ ” বলে আখ্যায়িত করেন ।মাগধী অপভ্রংশ থেকে বর্তমান বাংলা ভাষার সূচনা ।১০০০সাল থেকে বর্তমান সময় পযনর্ত্ম বাংলা ভাষা নানা পরিবর্তনের মাঝ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে ।
বিশ্বের মধ্যে একমাত্র বাংলাদেশের রাষ্ট্রভাষা হচ্ছে বাংলা ।তাই বিশ্বের দরবারে এই ভাষার মর্যাদা রক্ষা এবং সুষ্ঠুভাবে লালিত পালিত করার পুরো দায়িত্বটা আমাদেরই । যেমন বর্তমানে বিশ্বে ইংরেজী ভাষা আনর্ত্মজাতিকতার রূপ গ্রহণ করে নিউজিল্যান্ড,অষ্ট্রেলিয়া,কানাডা,যুক্তরাষ্ট এবং যুক্তরাজ্যের রাষ্ট্রভাষা হওয়া সত্তেও এই ইংরেজী ভাষায় মর্যাদা রক্ষা ও প্রতিপালিত করার মূল দায়িত্ব বৃটিশদের ।তেমনীভাবে পশ্চিম বাংলা ,বিহার ও আসামের একাংশ এবং মধ্যপ্রাচ্য ও বৃটেনে বাংলা ভাষাভাষী জনগোষ্ঠী থাকা সত্তেও এখন এর মর্যাদা রক্ষা আর প্রতিপালন করার মূল দায়িত্ব এই বাংলাদেশের বাঙালীদের ।
বাংলা সাহিত্যেও মূল ধারার উত্তর সুরী হচ্ছি আমরাই ।১৯৪৭ এর পর কবি জসীম উদ্দিন ,অধ্যাপক আ: হাই,ড: এনামূল হক,শওকত ওসমান , মুনীর চৌধুরী ,হাসান হাফিজুর রহমান ,শামসুর রহমান - এদের প্রতিভা দিয়ে এই মূল বাংলা সাহিত্য সাফল্যের ধাপে ধাপে অগ্রসর হয়ে বিশ্বের দরবারে স্থান করে নিচ্ছে । এই পৃথিবীতে বাংলাদেশের বাঙালীরাই আদি,অকৃত্রিম ও প্রকৃত বাঙালী ।
শাহিন ০৩ সিভিল
আহ্বায়ক
রুয়েট বন্ধুসভা