somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

‘শান্তির স্বপ্নে’ও প্রেতাত্মার থাবা

০৬ ই ফেব্রুয়ারি, ২০০৯ রাত ৮:১০
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

সেনাপ্রধান ও রাষ্ট্রপতি থাকা অবস্থায় ‘ইন দ্যা লাইন অব ফায়ার’ (প্রকাশঃ সেপ্টেম্বর ২৫, ২০০৬) নামে আত্মজীবনী মূলক বই লিখে পাকিস্তানের স্বৈরশাসক পারভেজ মোশাররফ সারা দুনিয়ায় হৈ চৈ ফেলে দিয়েছিলেন। তখন তার বিরুদ্ধে গুরুতর অভিযোগ উঠেছিল। তিনি নাকি বইতে কারগিল যুদ্ধ, বিজ্ঞানী কাদির খান ইত্যাদি নিয়ে অর্ধসত্য বা মিথ্যা কথা বলেছেন।পাকিস্তানের নিরাপত্তার স্বার্থ বিঘ্ন হতে পারে এমন অনেক বিষয়ে তথ্য পাচারের বিস্তর অভিযোগ উঠলেও ঐবছর তার বইয়ের ব্যাপক কাটতি কিন্তু কেউ আটকাতে পারেনি। আর তাবত বিশ্ব ভাল করেই জানে, দু’একটি পরাশক্তি হাতে থাকলে বড়-ছোট কোন অভিযোগই কিছুদিন পরে আর অবশিষ্ট থাকে না।

আমেরিকা, বৃটেন কিংবা উন্নতবিশ্বে সেনাপ্রধান কে বা তিনি কিইবা বললেন তা নিয়ে দুনিয়ার মানুষ খুব বেশী মাথা ঘামায় না।কারন তাঁরা সরকারী চাকুরিজীবি, অর্পিত দায়িত্ব পালন করাই তাঁদের কাজ।কিন্তু আমাদের মত দেশগুলো বিশেষ করে পাকিস্তান, থাইল্যান্ড, বাংলাদেশ, ফিজি ইত্যাদির পরিস্থিতি সম্পূর্ণ উলটা। কারণ ইনারা সরকারী চাকুরির পাশাপাশি ‘উপরি’ কিছু দায়িত্ব পালন করে থাকেন। এই 'উপরি'ই তাঁদের অতিরিক্ত পরিচয় বাড়াতে সাহায্য করে।

প্রজাতন্ত্রের এমন গুরুত্বপূর্ণ আসনে আসীন ব্যক্তিবর্গ সাধারনত চাকরি থেকে অবসরে গিয়ে আত্মজীবনীমূলক বই লিখে থাকেন। কখনো তাঁরা রাষ্ট্রের নিরাপত্তা সংশ্লিষ্ট অনেক অপ্রিয় সত্য কথা সারা জীবনের জন্য চেপেও যান।যেমন, বিচারপতি শাহাবুদ্দীন আহমেদ।একটি দলের উপর তিনি এতই মনক্ষুন্ন যে, আত্মজীবনীমূলক বই লেখার ইচ্ছা এখন আর করেন না।উল্লেখ্য, সেনাপ্রধান মইন ইউ আহমেদের চাকরির মেয়াদ শেষ হয়েছে আগেই।তত্ত্বাবধায়ক সরকার ২০০৮ সালে আরো এক বছর বাড়িয়ে দিয়েছেন।তখন বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মন্তব্য করেছিলেন, ‘মেয়াদ আর কত বাড়বে? সবকিছুর একটা শেষ আছে।’

যাহোক, সেনাপ্রধান জেনারেল মইনের আত্মজীবনীমুলক বই ‘শান্তির স্বপ্নে সময়ের স্মৃতিচারণ’ বেরিয়েছে।জাতীয় নিরাপত্তা বিষয়ক বিশ্লেষকেরাই বিচার করবেন গুরুত্বপূর্ণ কোন গোপন তথ্য জেনারেল তিনি জনগনকে জানিয়েছেন কি না অথবা সেগুলো বাইরে জানানোর আদৌ প্রয়োজন রয়েছে কিনা।আমরা সেদিকে না গিয়ে বইয়ে বর্ণিত বহুলখ্যাত ‘ওয়ান-ইলেভেন’-এর অজানা রহস্য ও সেসময়ে প্রকাশিত জনপ্রিয় দেশী ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন মিডিয়া বিবেচনা করে আলোচনা করব।আর শেষে তৃতীয় বিশ্বের অনেক সেনাপতির ঘনিষ্ঠ বন্ধু বুশকে নিয়ে একটি গল্প দিয়ে আজকের নিরস আলোচনাটির সমাপ্তি টানবো।

জরুরী অবস্থা না এলে হয়তো আমরা জানতেই পারতাম না জেনারেল মইনের রয়েছে অসাধারন লেখনী ক্ষমতা। সুন্দর ভাষা ও শব্দ চয়নে ইতিবাচক কলাম লিখে তিনি ইতোমধ্যে পরিচিতি লাভ করেছেন।বাংলা নববর্ষ ১৪১৫ (১৪ এপ্রিল ২০০৮) নিয়ে বিভিন্ন পত্রিকায় তাঁর একসাথে প্রকাশিত অসাধারন লেখাটি পজেটিভ বাংলাদেশ গড়তে বেশ সাহায্য করবে।তিনি আশাবাদী ও স্বপ্নবিলাসী মানুষ যা নিজেই বলে থাকেন।সেজন্যই হয়তোবা ওয়ান-ইলেভেন আনতে সহায়তা করেছেন।সব মানুষকে ঐক্যবদ্ধ বা মন জয় করতে নিজস্ব ব্র্যান্ডের গনতন্ত্র, ২৮শে অক্টোবর, জাতির জনক, স্বাধীনতার ঘোষক ইত্যাদি ইস্যু নিয়ে জনপ্রিয় কথাও বলেছেন।যেরকম আমরা এরশাদের মুখ থেকে ক্ষমতা দখল করে নেয়ার পরে দূর্নীতি ও অশ্লীলতার বিরুদ্ধে প্রায়শই শুনতাম।এমনকি দূর্নীতির এই বরপুত্র কৃচ্ছতা সাধনের নিমিত্তে মিডিয়াকে খবর দিয়ে সাইকেল চালিয়েও একসময় অফিস করতেন। আর অশ্লীলতার বিরুদ্ধে তার জেহাদের কথা নাইবা বললাম।

এক-এগারোর সাথে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত নায়কদের মুখ থেকে আমরা এর অন্তর্নিহিত রহস্য আগে জানতে পারিনি। শুধু জেনেছিলাম এটি পূর্বপরিকল্পিত।জেনারেল মইন বইতে এর বিস্তারিত বিবরন দিয়েছেন। তিনি লিখেছেন, ‘১১ জানুয়ারি খুব ভোরে উঠে ফজরের নামায পড়ে কায়মনে আল্লাহর কাছে হাত তুলে বললাম, হে আল্লাহ, জীবনে আমি অনেক ভুল করেছি………....... মোনাজাত শেষ করে আমি অফিসের সময় শুরু হওয়ার আগেই অফিসে চলে এলাম। প্রথমে খবর ও পরে জাতিসংঘ সদর দপ্তর থেকে টেলিফোন পেলাম। আন্ডার সেক্রেটারি জেনারেল মিঃ গুইহিনো কোনোরকম ভনিতা না করেই জানালো, সব দলের অংশগ্রহণ ব্যতীত নির্বাচন তাদের কাছে গ্রহণযোগ্য নয়। এরকম একটি নির্বাচন অনুষ্ঠানে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী যদি ভূমিকা রাখে তাহলে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশন থেকে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীকে প্রত্যাহার করার বিষয়টি গুরুত্বসহকারে বিবেচনা করা হবে। অনুষ্ঠিতব্য নির্বাচনের ব্যাপারে জাতিসংঘের এরূপ কঠোর হুঁশিয়ারির পর আমার বুঝতে অসুবিধা হলো না যে, এমন একটি নির্বাচন অনুষ্ঠানে সেনাবাহিনীর সম্পৃক্ততা আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও সেনাবাহিনীর ভাবমূর্তিকে বিতর্কিত করে তুলবে।’

তাহলে বোঝা যায়, জাতিসংঘের কঠোর হুঁশিয়ারীই তাঁকে ১-১১ আনতে অনুঘটকের ভূমিকা পালন করেছে। আসলে সত্যি কি এরূপ ঘটেছিল? কোনো স্বাধীন রাষ্ট্রের আভ্যন্তরীন ইস্যুতে জাতিসংঘ কি এমন অশোভন হুমকি দিতে পারে? ইকোনোমিস্ট ২১ ফেব্রুয়ারী ২০০৭-এ এক মন্তব্য প্রতিবেদনে লিখেছে, ‘They must have known that the United Nation’s threat was almost certainly hollow. After all, Pakistan and Fiji didn’t lose their peacekeeping contract after coups in their countries (অর্থাত বাংলাদেশের জেনারেলরা অবশ্যই নিশ্চিত ছিলেন যে, ইউএনের এই থ্রেটটা ছিল একটা ফাঁকা বুলি। কারন পাকিস্তান ও ফিজিতে জেনারেলরা ক্ষমতা ছিনিয়ে নেয়ার পরেও তাদের সাথে ইউএন’র পিসকিপিং কন্ট্রাক্ট কিন্তু বাতিল হয়ে যায়নি।)’

আমেরিকা অঞ্চলের মানবাধিকার আইনজীবীদের সংগঠন ‘আমেরিকান অ্যাসোসিয়েশন অব জুরিস্ট’র কানাডা চ্যাপ্টারের সভাপতি এবং আন্তর্জাতিক মানবাধিকার নিয়ে কর্মরত ‘ইন্টারন্যাশনাল অ্যাসোসিয়েশন অব ডেমোক্র্যাটিক ল’ ইয়ার্সের কর্মকর্তা অ্যাটর্নি উইলিয়াম স্লোন ২০০৮ সালের ৮ মার্চ নিউইয়র্ক ভিত্তিক ‘ফেডারেশন অব অর্গানাইজেশন্স এগেইনস্ট বাংলাদেশ ওয়ার ক্রিমিনালস’ নামক একটি সংগঠন কর্তৃক আয়োজিত এক সাংবাদিক সম্মেলনে বলেছিলেন, ‘পাকিস্তানি স্টাইলে বাংলাদেশে মাইনাস টু ফর্মুলা বাস্তবায়নের পরিকল্পনা হঠাত করে আসেনি। ১-১১-এর পরিস্থিতিও পূর্বপরিকল্পিত।নির্বাচনের ইস্যুকে কেন্দ্র করে রাজধানী ঢাকায় প্রকাশ্যে পিটিয়ে মানুষ হত্যার নীলনকশাও পুরনো।‘পিলে চমকানোর মতো এসব তথ্য ফাঁস করে জ্যাকসন হাইটসে উইলিয়াম আরো জানিয়েছিলেন, ‘খালেদা জিয়ার সরকার পদত্যাগের সাথে সাথে গঠিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে নির্বাচনের ইস্যুতে কী ধরনের আন্দোলন হবে এবং নির্বাচন বানচালের জন্য কী ভয়ঙ্কর পরিস্থিতির অবতারণা করা হবে, এরপর জরুরী আইন হতে পারে, জরুরী আইনের সময় সামরিক বাহিনীকে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব দেয়া হবে, এমনি অবস্থায় চালানো হবে দুর্নীতি দমন অভিযান এবং সে অভিযানের টার্গেট হবেন দুই নেত্রী, সংস্কারের নামে প্রধান দু’টি দলকে ভেঙে চুরমার করার পর আমেরিকার পছন্দের লোকদের নেতৃত্বে গঠন করা হবে নতুন রাজনৈতিক ফ্রন্ট এবং নির্বাচনের মাধ্যমে সেই ফ্রন্টের লোকজনের সমন্বয়ে সরকার গঠন করা হবে।’ তিনি দাবী করেন এসব অনেক আগেই এক ডেইলির সম্পাদক ও এক এমপির মাধ্যমে তিনি জেনেছিলেন । (সূত্রঃ নয়াদিগন্ত মার্চ১০, ২০০৮)

ডঃ কামাল হোসেনও বলেছিলেন, ‘এক-এগারো আমরাই এনেছি।’ সেসময়ে কারাধীন শেখ হাসিনার এক অভিযোগের বিষয়ে জাতীয় প্রেস ক্লাবে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে ডঃ কামাল হোসেন আরো বলেছিলেন, ‘দেশ গোল্লায় যাক। তাই বলে দুই নেত্রীকে পূজা করতে হবে নাকি? (আমারদেশ, মে১, ২০০৮)’

তাহলে আমরা কি করে বিশ্বাস করবো সব বাহিনীর প্রধান জেনারেল মইন এসবের কিছুই কি অগ্রিম জানতেন না বা এর সাথে নিজেকে কখনো অন্তর্ভূক্ত করেননি? না কি ধরে নিব অদৃশ্য কোনো প্রেতাত্মার থাবা আমাদের সাহসী সেনাপতিকেও নির্মম সত্য প্রকাশে টুটি চেপে ধরেছে?

আমরা ১-১১ পূর্ব-প্রেক্ষাপটটি বিবেচনায় আনলে সহজেই বুঝতে পারি শক্তিধর রাষ্ট্রদূতদের সাথে সবচেয়ে বেশী সাহায্য করেছেন জাতিসংঘের আবাসিক প্রতিনিধি রেনাটা লক ডেসালিয়ান। তিনিই জাতিসংঘের পক্ষে একটি আনুষ্ঠানিক ঘোষনা দিয়েছিলেন।সেখানে তিনি বলেছিলেন, ‘২২ জানুয়ারীর ঘোষিত নির্বাচনে সেনাবাহিনী সহায়তা দিলে আগামী দিনে জাতিসংঘ শান্তি মিশনে আদৌ যোগ দিতে ও বেতন ভাতা কমাতে পারবে কিনা সেটি বিবেচনা করা হবে। অবশ্যি পরে এই ধমকা-ধমকি পরে ভূয়া বলে ধরা পড়েছে। জাতিসংঘ সদর দপ্তর থেকে যে বিবৃতি পাঠানো হয়েছিল সেখানে বাংলাদেশ সম্পর্কে উতকন্ঠা ছিল, কিন্তু এ ধরনের কথা ছিল না। রেনেটা বিবৃতিতে নিজ দায়িত্বে এই কথাগুলো ঢুকিয়ে ছিলেন।’ (সূত্রঃ আমারদেশ, ১২ অক্টোবর, ২০০৮)

ইকোনোমিস্টও লিখেছে, ‘বাংলাদেশের আবাসিক প্রতিনিধি যা করেছে জাতিসংঘের গত ষাট বছরের ইউএনের ইতিহাসে তা নেই। এই হুমকির পরেই জেনারেল মইন বাংলাদেশের রাস্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিনের অফিস বরাবর মার্চ করে ইমার্জেন্সী জারী, ইলেকশন বাতিল এবং মিলিটারী ব্যাকড্ কেয়ারটেকার সরকার প্রতিষ্ঠা করতে ‘আদেশ’ দেন। (ফেব্রুয়ারী ২১, ২০০৭)’

সেসময় বঙ্গভবনে রাষ্ট্রপতির প্রেস সচিব এবং পরবর্তীতে উপদেষ্টা মোখলেসুর রহমান চৌধুরীও প্রেসিডেন্টের নিকট মইনের ‘বিনয়াবনত হয়ে অনুরোধের’ দাবীকে মিথ্যা বলে উড়িয়ে দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, রাষ্ট্রপতির ভাষণ, জরুরি অবস্থা জারির কাগজপত্র এবং প্রধান উপদেষ্টার পদ থেকে রাষ্ট্রপতির পদত্যাগপত্র ইত্যাদি কাগজপত্র সেনাপ্রধান আগেই তৈরি করে সঙ্গে করে নিয়ে এসেছিলেন। রাষ্ট্রপতিকে জোর করে এসব কাগজপত্রে স্বাক্ষর করানো হয়েছিল। রাষ্ট্রপতি এ বিষয়টি নিয়ে তার পত্নী ও আমার সঙ্গে কথা বলতে চেয়েছিলেন। আমাকে তিনি তাদের উপস্থিতিতে ডেকেছিলেন। কিন্তু আমাকে সেখানে যেতে দেয়া হয়নি। (আমাদের সময়, ফেব্রুয়ারী ২, ২০০৯)

সেসময়ে নবম পদাতিক ডিভিশনের জিওসি, ওয়ান ইলেভেনের অন্যতম রূপকার ও বর্তমানে অস্ট্রেলিয়ায় বাংলাদেশের হাইকমিশনার লেফটেন্যান্ট জেনারেল মাসুদউদ্দিন চৌধুরী পরোক্ষভাবে জেনারেল মইনকে উদ্দেশ্য করে বলেছেন, ‘ওয়ান ইলেভেনের প্রেক্ষাপট নিয়ে আজ বিভিন্ন জন বিভিন্ন মত প্রকাশ করছেন। প্রত্যেকেই সেই ঐতিহাসিক ঘটনাকে নিজের মতো করে বলার চেষ্টা করছেন। আমি নিজেও ওয়ান ইলেভেনের ঘটনাবলির সঙ্গে জড়িত ছিলাম। ওইদিন অন্যদের সঙ্গে আমিও উপস্থিত ছিলাম বঙ্গভবনে। ১১ জানুয়ারি সারারাত বঙ্গভবনেই ছিলাম। আমি সকল ঘটনার সাক্ষী। তিনি বলেন, ইতিহাসই বিচার করবে ওয়ান ইলেভেনের সঙ্গে যারা যুক্ত ছিল তারা নায়ক না খলনায়ক। আমরা কেন নিজেরা নিজেদের নায়ক বানাতে যাব? জেনারেল মাসুদ বলেন, ওয়ান ইলেভেন নিয়ে আমারও অনেক কিছু বলার আছে। অনেক অজানা তথ্য আমি জানি। একদিন সেসব অবশ্যই বলব। আজ দেখছি, অনেকেই সত্য-মিথ্যা মিলিয়ে অনেক কথা বলছেন। এসবের জবাবও একদিন আমি দেব। এখন নয়। এখন আমি সরকারি কর্মচারী। এখন কিছু বললে নিজের অবস্থানের কথা মাথায় রেখে বলতে হবে। সব কিছু বলাও সম্ভব হবে না। ওয়ান ইলেভেনের সঙ্গে জড়িত থাকার কারণে ইতিহাসের কাছে আমি দায়বদ্ধ। সেই দায় আমাকে একদিন মেটাতেই হবে। (আমাদের সময়, ফেব্রুয়ারী৪, ২০০৯)’

মইনের উক্ত বইয়ের মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠানে উপস্থিত প্রধান অতিথি টিআইবি প্রধান অধ্যাপক মোজাফফর আহমেদ ‘১/১১-এ প্রেসিডেন্টের কাছে বিনয়াবনত হয়ে দেশের স্বার্থে সিদ্ধান্ত নেয়ার অনুরোধ জানান’-এর বিপরীতে সেনাপ্রধানকে উদ্দেশ্য করে বলেন, ‘আপনি যদি বাইরে কান পাতেন তাহলে মানুষের কাছে অন্য কাহিনী শুনতে পাবেন।’ উল্লেখ্য, উক্ত অনুষ্ঠানে জেনারেল মইন এমনসব বুদ্ধিজীবি ডেকে এনেছিলেন যাঁরা বাংলাদেশে শক্তিশালী সেনাবাহিনীর প্রয়োজনীয়তায় বাজেটে অতিরিক্ত বরাদ্ধ নিয়ে ফিবছর কথা বলে থাকেন। এমনকি ওই অনুষ্ঠানেও অধ্যাপক মোজাফফর আহমেদ বলেছেন, ‘জেনারেল মইন অন্যত্র স্বচ্ছতা আনার চেষ্টা করেছেন কিন্তু সেনাবাহিনীর (সশস্ত্রবাহিনী) কর্মের স্বচ্ছতা নেই (নয়াদিগন্ত জানুয়ারী৩০, ২০০৯)।’ অথচ প্রবীন এই অধ্যাপক ভাল করেই জানেন কোন দেশেরই স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষাকারী বাহিনীর আভ্যন্তরীন কর্মকান্ড জনসমক্ষে উন্মোচন বা সরকার ছাড়া কাউকে স্বচ্ছতা প্রমাণ করতে দেয়ার সুযোগ নেই।মইন কিন্তু এর ন্যুনতম প্রতিবাদও করেননি।

প্রেসিডেন্টের ভাবার জন্য কিছু সময় চাওয়া নিয়ে মইন অন্যত্র লিখেছেন, ‘আমি জানতাম ইতোপূর্বে উপদেষ্টা পরিষদে অনেক ইতিবাচক সিদ্ধান্ত অজানা কারন ও প্রভাবে পরিবর্তন হয়ে গিয়েছে। যার কারনে আমরা কোনো দুষ্টচক্রকে আবার নতুন কোনো খেলা শুরু করার সুযোগ দিতে চাচ্ছিলাম না।’ ‘দুষ্টচক্র’ বলতে তিনি কাদের বুঝিয়েছেন তা সচেতন পাঠকদের বুঝতে আশা করি কষ্ট হবেনা। বর্তমান সরকারে অন্য জোট ক্ষমতায় থাকলে জেনারেল মইন এমন বইয়ের মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠান করতেন কিনা তা নিয়ে যেকোনো পাঠকই সন্দেহ করতে পারেন।কারন এক সময় সব জোটই সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিরোধিতা করলেও বর্তমান পরিস্থিতি অনেকের জন্যই শাপে বর হয়েছে। বুদ্ধিজীবিদের সুরও পাল্টেছে, পত্র-পত্রিকাগুলোও হয়তো জরুরী অবস্থা নিয়ে আর মাথা ঘামাতে রাজী নয়। অথচ ২২শে অক্টোবর, ২০০৭ এ জেএফকে স্কুল অফ গভর্ণমেন্ট একই গোত্রীয়ভুক্ত বুদ্ধিজীবিরা প্রতিষ্ঠানটির ডীন ডঃ ডেভিড এলউড বরাবর ইমেইলে অনুরোধ জানিয়ে ইন্টারনেটে স্বাক্ষর সংগ্রহ অভিযানে নেমে পড়ে সেনাপ্রধাণকে এক অনুষ্ঠান থেকে দূরে রাখতে সমর্থ হয়েছিলেন।

ওয়ান-ইলেভেনের এক বছরপূর্তি উপলক্ষ্যে ১১ জানুয়ারী ২০০৮-এ দৈনিক প্রথম আলো ‘বঙ্গভবনে সেই সময়ে যা ঘটেছিল’ শিরোনামে যা লিখেছে তার সাথে মইনের বর্ণনার মূল পার্থক্য তেমনটি নেই। মইন শুধু প্রেসিডেন্টের সাথে তাঁর আচরনগত ‘পার্থক্য’ দেখিয়েছেন যা বইয়ের মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠানের বুদ্ধিজীবিরাও বিশ্বাস করেননি।পাঠকেরা প্রথম আলোর ওই তারিখের আর্কাইভে গিয়ে দেখে নিতে পারেন।একটি পত্রিকা কি করে সেনাবাহিনী সংশ্লিষ্ট আভ্যন্তরীন ব্যাপারাদি এমন খুঁটিনাটিভাবে জানতে পারে তা ভাবতেই অবাক লাগে।একটা সময় ছিল যখন সেনাবাহিনী ও বিচারপতিদের নিয়ে লেখার আগে সাত-পাঁচ ভাবতে হতো, আজ উলটো সংশ্লিষ্ট বিভাগের স্বয়ং মহারথীরাই নয়-ছয় লিখে উদ্ভট জটলা সৃষ্টিতে সাহায্য করছেন।

একটি গল্প দিয়ে আজকের আলোচনা শেষ করতে চেয়েছিলাম।


২০০৯ সালের এক রৌদ্রোজ্জ্বল দিনে পেনসেলভেনিয়া এভিনিউ ধরে একজন বৃদ্ধ লোক হোয়াইট হাউসের সামনে পাতা একটি বেঞ্চে এসে বসলেন।

প্রহরারত এক মেরিন গার্ডের কাছে জানতে চাইলেন, ‘আমি একটু ভিতরে যেতে চাই। প্রেসিডেন্ট বুশের সাথে দেখা করব।’

মেরিন ভ্রুঁকুঁচকে লোকটির দিকে তাকালেন। বিনয়ের সাথে বললেন, ‘স্যার, বুশ এখন আর প্রেসিডেন্ট নন এবং এখানে তিনি আর থাকেন না।’

লোকটি ‘ওকে’ বলে চলে গেলেন।


পরদিন লোকটি আবারো হোয়াইট হাউসে এসে মেরিন গার্ডকে একইভাবে ভিতরে ঢুকে প্রেসিডেন্ট বুশের সাথে দেখা করার আগ্রহ ব্যক্ত করলেন।

মেরিন উত্তরে বললেন, ‘স্যার, গতকাল আপনাকে যা জবাব দিয়েছি আজো তাই দিচ্ছি। বুশ ইজ নো লংগার প্রেসিডেন্ট এন্ড নো লংগার রিসাইড হিয়ার।’

লোকটি এবারো আগের মত মেরিনকে ধন্যবাদ দিয়ে বিদায় নিলেন।

তৃতীয় দিনেও ব্যক্তিটি আগের মতই হোয়াইট হাউসে এসে ওই মেরিনকেই বললেন, ‘আই উড লাইক টু গো ইন এন্ড মিট উইথ প্রেসিডেন্ট বুশ (I would like to go in and meet with president Bush)।’

সংগতকারনেই মেরিন আর রাগ থামাতে পারলেন না। অগ্নিমূর্তি ধারন করে লোকটির দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘স্যার, আজ দিয়ে তিনদিন আপনি একাধারে মিঃ বুশের সাথে কথা বলতে চাচ্ছেন। আর আমি আপনাকে বারে বারে একই কথা বলে যাচ্ছি মিঃ বুশ ইজ নো লংগার প্রেসিডেন্ট এন্ড নো লংগার রিসাইড হিয়ার। আপনি কি আমার কথা বুঝতে পারছেন?’

বৃদ্ধ লোকটি এবার সহজভাবে মেরিনের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘ওহ্, আই আন্ডারস্ট্যান্ড। বুশ যে ‘নো লংগার আওয়ার প্রেসিডেন্ট’ কথাটি আমার ভারী পছন্দের। আই জাস্ট লাভ হিয়্যারিং ইট।’

মেরিনগার্ড মূহুর্তেই লোকটির দিকে আকর্ষন বাড়িয়ে একটি স্যালুট দিয়ে বললেন, ‘সি ইউ টুমোরো ,স্যার।’

২০১০ সালের কোনো একদিন বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর হেড কোয়ার্টারে সামনে কোনো এক বাংলাদেশীর এমন প্রশ্নের জবাবে হয়তো তখনকার সেনাপ্রধান গার্ড লোকটিকে স্যালুট দিয়ে বলবে ‘সি ইউ টুমোরো, স্যার’।
সর্বশেষ এডিট : ০৭ ই ফেব্রুয়ারি, ২০০৯ রাত ৯:২১
৭টি মন্তব্য ৬টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

তীব্র তাপদাহ চলছে : আমরা কি মানবিক হতে পেরেছি ???

লিখেছেন স্বপ্নের শঙ্খচিল, ২৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ২:১৯

তীব্র তাপদাহ চলছে : আমরা কি মানবিক হতে পেরেছি ???



আমরা জলবায়ু পরিবর্তনের হুমকির মুখে আছি,
আমাদেরও যার যার অবস্হান থেকে করণীয় ছিল অনেক ।
বলা হয়ে থাকে গাছ না কেটে... ...বাকিটুকু পড়ুন

ব্যবহারে বংশের পরিচয় নয় ব্যক্তিক পরিচয়।

লিখেছেন এম ডি মুসা, ২৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১০:১৫

১ম ধাপঃ

দৈনন্দিন জীবনে চলার পথে কত মানুষের সাথে দেখা হয়। মানুষের প্রকৃত বৈশিষ্ট্য আসলেই লুকিয়ে রাখে। এভাবেই চলাফেরা করে। মানুষের আভিজাত্য বৈশিষ্ট্য তার বৈশিষ্ট্য। সময়ের সাথে সাথে কেউ কেউ সম্পূর্ণ... ...বাকিটুকু পড়ুন

মহিলা আম্পায়ার, কিছু খেলোয়ারদের নারী বিদ্বেষী মনোভাব লুকানো যায় নি

লিখেছেন হাসান কালবৈশাখী, ২৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:০৯



গত বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল প্রাইম ব্যাংক ও মোহামেডানের ম্যাচে আম্পায়ার হিসেবে ছিলেন সাথিরা জাকির জেসি। অভিযোগ উঠেছে, লিগে দুইয়ে থাকা মোহামেডান ও পাঁচে থাকা প্রাইমের মধ্যকার ম্যাচে নারী আম্পায়ার... ...বাকিটুকু পড়ুন

জানা আপুর আপডেট

লিখেছেন আরাফআহনাফ, ২৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:৫৭

জানা আপুর কোন আপডেট পাচ্ছি না অনেকদিন!
কেমন আছেন তিনি - জানলে কেউ কী জানবেন -প্লিজ?
প্রিয় আপুর জন্য অজস্র শুভ কামনা।



বি:দ্র:
নেটে খুঁজে পেলাম এই লিন্ক টা - সবার প্রোফাইল... ...বাকিটুকু পড়ুন

বন্ধুর বউ কে শাড়ি উপহার দিলেন ব্যারিস্টার সুমন। বাটার প্লাই এফেক্ট এর সুন্দর উদাহারন।

লিখেছেন নাহল তরকারি, ২৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:০৭



এক দেশে ছিলো এক ছেলে। তিনি ছিলেন ব্যারিস্টার। তার নাম ব্যারিস্টার সুমন। তিনি একজন সম্মানিত আইনসভার সদস্য। তিনি সরকার কতৃক কিছু শাড়ি পায়, তার জনগণের মাঝে বিলি করার জন্য।... ...বাকিটুকু পড়ুন

×