একটা ব্যাপার লক্ষ্য করেছেন?
ইদানিং খাদ্য অপচয় করাটা একটা ফ্যাশনে পরিণত হয়েছে! কোন অনুষ্ঠানে-পার্টিতে-কুটুম বাড়িতে নিমন্ত্রণে গিয়ে পুরো খাবারটা না খেয়ে প্লেটের এক কোণা দিয়ে একটু খেয়ে পুরোটা ফেলে দেওয়া হয়। বিষয়টা এখন এমন হয়ে গেছে, যে যত বেশী খাবার নষ্ট করতে পারে সে তত বেশী স্মার্ট!
এটা খুবই দুঃখজনক এবং বাজে একটা অভ্যাস।
অতীতের দিকে তাকালে আমরা দেখব, শুধুমাত্র খাদ্যের অভাবে পৃথিবী থেকে কত কোটি-কোটি প্রাণ ঝরে গেছে। ক্ষুধার যন্ত্রণা সহ্য করতে না পেরে কত মানুষ আত্মহুতি দিয়েছে। আশ্চর্য হলেও সত্য বর্তমান আধুনিক পৃথিবীতেও খাদ্যের অভাবে প্রতিদিন মারা যাচ্ছে প্রায় বিশ হাজার শিশু! হ্যা, প্রতিদিন বিশ হাজার শিশু! শুধুমাত্র ক্ষুধায় ভোগে মারা যাচ্ছে! প্রতিদিন ক্ষুধা পেটে না খেয়ে ঘুমোতে যায় পৃথিবীর ৮০৫ মিলিয়ন মানুষ! ভরপেটে খেতে পারেনা প্রায় দুই বিলিয়ন মানুষ!
তোমরা যারা স্মার্ট সাজতে গিয়ে খাদ্য নষ্ট করছো, কি জবাব দেবে তোমরা তাদের কাছে?
ক্ষুধার কষ্টে ভোগা এইসব মানুষেরা যদি কখনো তোমাদের সামনে এসে দাঁড়ায় তাহলে তাদের চোখের দিকে কি করে তাকাবে?
একদানা খাদ্য নষ্ট করা মানে পৃথিবীর খাদ্য ভাণ্ডার থেকে একদানা খাদ্য কমে যাওয়া।
সামগ্রিকভাবে চিন্তা করলে দেখা যাবে পৃথিবীর জনসংখা এবং খাদ্য সমানুপাতিকই আছে। কিন্তু সেই খাদ্যগুলোর সঠিক বন্টন হচ্ছেনা।
একজন স্বাভাবিক সুস্থ্য মানুষের দৈনিক ১৫ শ থেকে ১৮ শত কিলোক্যালোরি খাদ্যের দরকার হয়। অথচ, পয়সাওয়ালা বড় লোকেরা গ্রহন করে দৈনিক ২৮ শত থেকে তিন হাজার কিলোক্যালোরি খাদ্য। এই অতিরিক্ত খাবারটা তাদের কোন সাহায্যই করছেনা বরং বাড়িয়ে দিচ্ছে স্থুলতা, প্রেসার এবং ডায়াবেটিসের মত ভয়াবহ রোগ।
একই রাস্তায় দুইজন মানুষ প্রতিদিন দৌড়ায়। একজন দৌড়ায় খাদ্য হজম করতে আরেকজন দৌড়ায় একবেলা খাদ্য সংগ্রহ করতে!
খাদ্য সংগ্রহের প্রতিযোগীতাই মানব জাতির উত্থানের মূল কারণ। সভ্যতা বিকাশের প্রথম ধাপে মানুষেরা বিচ্ছিন্নভাবে ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসবাস করত। নিজ পরিবার বা গোত্রের বাহিরে অন্যকারো সঙ্গে কোন প্রকার সম্পর্ক এবং যোগাযোগ রাখতনা। নিজ গোত্রের বাহিরের মানুষদেরকে শত্রু এবং প্রাকৃতিক খাদ্যের অংশীদার মনে করা হত। শিকার নিয়ে প্রায়ই তাদের মধ্যে যুদ্ধ হত। যুদ্ধে এক পক্ষ জয়লাভ করলে অন্যপক্ষ স্বাভাবিক নিয়মেই নিশ্চিহ্ন হয়ে যেত।
তবুও তাদের খাদ্যের ঘাটতি থেকে যেত। যখন দেখল প্রাকৃতিক খাদ্য দ্রুত ফুরিয়ে আসতে শুরু করেছে। তখন তারা ভাবতে বসল। এবং সেই সময় 'খাদ্য উৎপাদন না করে প্রকৃতির উপর নির্ভর করলে মানবজাতি বিলুপ্ত হয়ে যাবে।' এই চরম সত্যটাকে অনুভব করল।
সময়ের প্রয়োজনে, সেই ভয়াবহ দুঃসময়ে বিচ্ছিন্ন গোত্রগুলো পরস্পর মিলিত হল। এবং খাদ্য উৎপাদনের পদ্ধতি বের করে ফেলল! শুরু হল মানুষের সভ্য হওয়ার প্রক্রিয়া।
আর পিছু ফিরে তাকাতে হয়নি মানুষদের।
খাদ্যের প্রয়োজনে যেই সভ্যতার শুরু হয়েছিল সেই সভ্যতার ধারাবাহিকতা এখনো চলছে। খাদ্যের জোগানের নিশ্চয়তায় যেই সভ্যতা মানুষ সৃষ্টি করেছে সেই সভ্যতাই এখন পৃথিবীর সিংহভাগ মানুষের মুখের খাবার কেড়ে নিচ্ছে!
সেই সভ্যতাই সমাজে সৃষ্টি করেছে বৈষম্যের। কর্পোরেট-বণিকদের হাতে খাদ্য উৎপাদনের দায়িত্ব চলে যাওয়ার পর তারা ক্রমে-ক্রমে নিজেদের ইশ্বর বানিয়ে ফেলেছে। তারা তাদের বাণিজ্য প্রসারের প্রয়োজনে উদ্বৃত্ত খাদ্যকে সাগরে ফেলে দেবে তবুও দাম কমাবেনা।
অতিরিক্ত দাম দিয়ে যারা খাদ্য কিনে খেতে পারবে তারাই টিকে থাকবে। যারা কিনতে পারবেনা তারা সেই অতীতের মত খাদ্যের জন্য, খাদ্য কেনার টাকার জন্য মারামারি করবে, চুরি ছিনতাই করবে, যুদ্ধ করবে।
সেই যুদ্ধ থামাতে তথাকথিত সভ্য মানুষদের সংঘঠন জাতিসংঘ জাহাজ বোঝাই অস্ত্র দিয়ে সৈন্য পাঠাবে। হাজার বিলিয়ন ডলার খরচ করবে শান্তি ফিরিয়ে আনার জন্য। কি হাস্যকর প্রচেষ্টা!
(শাহজাহান আহমেদ)