।। নিলুফা ইয়াসমীন।।
ইদানিং এমন কোন পেশা খুঁজে পাওয়া যাবেনা যেখানে নারীর পদচারণা নেই, যুদ্ধ বিমান চালনা থেকে শুরু করে পর্বতাহরণ সকল ক্ষেত্রে সব পেশাতেই নারী সফল। একটা সময় ভাবা হত কিছু পেশা আছে যেখানে নারীর প্রবেশাধিকার নেই, নারীর কমনীয় হাত আর রমনীয় মন ঐসব কঠিন কাজ করতে পারবেনা। নারী আজ নিজের কর্মদক্ষতা প্রজ্ঞা দিয়ে প্রমাণ করেছে নারীর পেশা আর পুরুষের পেশা বলে আলাদা কোন কথা নেই। পাহাড়সমান বাধা পেরিয়ে আমাদের নারীরা ঘরে-বাইরে অবদান রাখছেন। কিন্তু সংখ্যার দিক থেকে নারী পিছিয়ে।
নারীর লড়াইয়ের ইতিহাস অল্প দিনের নয়। যুগ যুগ ধরে নারী সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছে। তারপরও নারী তাঁর ন্যায্য পাওনা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। একই সঙ্গে বাড়ছে নারীর প্রতি নির্যাতন-সহিংসতা। অধিকাংশ সময়ই নারী সহিংসতার শিকার হয়ে থাকেন খুবই তুচ্ছ কারণে। নারীকে অধস্তন করে দেখার মানসিকতার আজও কোনো পরিবর্তন হয়নি।
এগিয়ে যাওয়া এই পৃথিবীতে নারী কেন পিছিয়ে থাকবে? নারীর চলার পথে নানা প্রতিবন্ধকতা। এ অবস্থায় নারীর মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত করতে প্রয়োজন সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন। প্রয়োজন আইএলও, সিডিও সনদের (The Convention on the Elimination of Discrimination Against Women) পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন। আর এ ক্ষেত্রে নারী-পুরুষ উভয়কেই এগিয়ে আসতে হবে। প্রত্যেক নারী পারে তার স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দিতে যদি সে প্রত্যয়ী আর আত্মবিশ্বাসী হয়। সমাজ ও পরিবারের সহোযোগিতা এক্ষেত্রে বড় ভূমিকা রাখে।
একসময় মনে করা হতো, রাজনীতি পুরুষের জন্য। এখানে নারীদের কোনো কাজ নেই। কিন্তু সে ধারণার পরিবর্তন হয়েছে। এখন নারীরা রাজনীতিতে নেতৃত্ব দিচ্ছে, মানুষের জন্য কাজ করছে। তবু রয়ে গেছে কিছু বাধা। এ বাধাগুলো কাটিয়ে নারীকে হতে হবে আরও বেশি দক্ষ। । তাহলেই রাজনীতিসহ সব ক্ষেত্রে নারীর ক্ষমতায়ন নিশ্চিত হবে। নারী নিজ গুণে জায়গা করে নেবে সাফল্যের পাতায় পাতায়, বদলে দেবে বিশ্বকে।
‘নারী এশিয়ান ‘ ম্যাগাজিন প্রকাশের মূল প্রতিবাদ্য হল নারীর সফলতার পাশাপাশি আরো এগিয়ে যাবার প্রতিবন্ধকতাগুলো চিহ্নিত করা। ‘নারী এশিয়ান‘ ম্যাগাজিনের এই মহৎ কাজগুলো সুন্দরভাবে সম্পন্ন করার পেছনে যারা কাজ করছেন তারা শুধু নারী নন, নারীপুরুষ সবার সম্মিলিত প্রয়াশেই চমৎকার এই ম্যাগাজিনটি প্রকাশিত হয়। কিন্তু ম্যাগাজিনের নাম ‘নারী‘ কেন এই নিয়ে অনেকে প্রশ্ন তোলেন। তাদের মতে যুক্তরাজ্যে ‘নারীর‘ কি প্রয়োজন, এক ধাপ এগিয়ে আবার অনেকে বলেন শুধু ‘নারী‘ ‘পুরুষ‘ নয় কেন? সনামধন্য ‘বেগম‘ পত্রিকা যুগ যুগ ধরে সবার নজর কেড়েছে কিন্তু ‘সাহেব‘ নামে কেন পত্রিকা নেই এই প্রশ্ন শোনা যায়নি। ‘অনন্যা‘ ম্যাগাজিন বীরদর্পে অনন্য হয়ে আছে। নিজের দেশকে মাতৃভূমি বলতে দ্বিধা নেই, নিজ ভাষাকে মায়ের ভাষা বলতে গর্ববোধ করেন কিন্তু ‘বাবাভূমি, বা ‘বাবারভাষা‘ তো কেউ বলেনা। এই যে কথামালা, সব ‘নারী‘ ম্যাগাজিনকে ঘিরে। আমি বলি, ‘নারী‘ প্রকাশিত হয় নাড়ীর টানে। ‘নারী‘ এখানে প্রতীক, সর্বজনিন। যারা নারীকে হেয় প্রতিপন্ন করে তাদের টুটি চেপে ধরার জন্যই ‘নারীর‘ প্রয়োজন। অন্যায়ে প্রতিবাদী ‘নারী‘, অহসহায়ের সহায় ‘নারী‘।
‘সিডিও‘ সনদে নারীর সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক সকল ক্ষেত্রে নারীর অধিকার সংরক্ষণের সুস্পষ্ট নির্দেশনা রয়েছে। তাছাড়াও সনদ বাস্তবায়নের অগ্রগতি মূল্যায়নের প্রশাসনিক প্রক্রিয়া ব্যাখ্যা রয়েছে। উল্লেখ্য যে, যেহেতু নারী সমাজ নানাবিধ বঞ্চনার শিকার, তাই তারা সমাজের দূর্বল অংশ, তাকে এগিয়ে নিতে নারীর অনূকুলে বিশেষ আইন, বিধি, প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশনাও রয়েছে।
মানব সভ্যতার ক্রমবিকাশের ধারায় বিশেষ করে সম্পদ ও ক্ষমতার লড়াইয়ে নারী নিজেকে সম্পৃক্ত না করে পরিবার ও সমাজ বিকাশের কাজে নিজেকে নিয়োজিত রেখেছে। ফলে পিতৃতান্ত্রিক সমাজ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, এবং তা রক্ষার জন্য দৃষ্টিভঙ্গি, নিয়মনীতি প্রতিনিয়ত দৃঢ়তর করা হচ্ছে। জাতিসংঘের সাম্প্রতিক তথ্য থেকে তার সুস্পষ্ট ইংগিত পাওয়া যায়। যেখানে বলা হয়েছে, বিশ্বের ৭০% কাজ সম্পাদন করে নারী, কিন্তু সম্পদের মালিকানা কেবল ০৩%। ফলে নারী তার বিকাশ ও মানুষের মর্যাদা থেকে বঞ্চিত। যার প্রতিফলন প্রতিনিয়ত লক্ষ্য করছি। ন্যায়ভিত্তিক শান্তিপূর্ণ সমাজ প্রতিটি মা কামনা করেন তার সন্তানের সুন্দর জীবনের আশায়। কিন্তু উক্ত আকাংখা পূরণের জন্য প্রয়োজন অনুকূল পরিবেশ। তাই আসুন, পরিবেশ নিশ্চিত করার প্রচেষ্টা জোরদার করি নিজেদের অবস্থান থেকেই।
লেখকঃ সাংবাদিক, কলামিষ্ট ও নারী এশিয়ান ম্যাগাজিনের বিশেষ প্রতিনিধি।