ইসলামী আইন অনুযায়ী দেশ চললেই কি দেশে সুখ-শান্তি ফিরে আসবে? দেশে কোন দরিদ্র মানুষ থাকবে না? অন্যায়-অবিচার বন্ধ হওয়ে যাবে? যারা বলেন যে, ইসলামী শাসন আসলেই, সব কিছুর সমাধান হয়ে যাবে, তারা মিথ্যা বলেন। তাহলে কেন মহানবী (সা)-এর শ্রেষ্ঠ সাহাবীদের একজন আবু যর গিফারী (রা)-কে মরুভূমিতে কপর্দক শূন্য অবস্থায় মৃত্যুবরণ করতে হয়েছিলো?
মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) বলেছিলেন- ''আমার লোকদের মধ্যে আবু যরের আত্মত্যাগ ও আল্লাহভীতি মরিয়ম তনয় ঈসা'র মতো।''... অথচ, এই মানুষটিকেই ইসলামী রাজ্যের শাসনকর্তার নির্দেশে নির্বাসনে থাকার সময় মরুভুমিতে মৃত্যুবরণ করতে হয়।
আরবে তখন খলিফা উসমান-এর শাসন চলছে। হযরত উসমান নিজ বংশের মানুষদের বিশ্বাস করে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে বসিয়েছিলেন। অথচ, এই মানুষগুলো এই সুযোগ নিয়ে নিজ দেশে অশান্তির কালো আগুন ছড়াতে লাগলো। এইসব লুটেরারা এই সুযোগে রাষ্ট্রীয় সম্পদ নিজেদের করতলে নিয়ে নিলো।
হযরত মুয়াবিয়া তখন সিরিয়ার গভর্নর। হযরত আবু যর গিফারী, খলিফা হযরত উমর (রাঃ)-এর শাসনামল থেকেই সিরিয়াতে অবস্থান করছিলেন। আবু যর সেখানে উপদেশ প্রদান, ধর্ম প্রচার, সৎপথ প্রদর্শন এবং মহানবী (সাঃ)-এর পরিবারের মানুষদের মহত্ত্ব সম্পর্কে সিরিয়ার মানুষদের ওয়াকিবহালে ব্যস্ত ছিলেন। হযরত উসমান যখন শাসক হলেন, এরপর থেকেই হযরত আবু যর খলিফা উসমানের সমালোচনা করতে থাকেন। গভর্নর হযরত মুয়াবিয়া এটা পছন্দ করতেন না। তাই, তিনি খলিফার নির্দেশে জীনবিহীন একটি উটে করে হযরত আবু যরকে মদিনা পাঠিয়ে দেন।
মদিনাতে পৌঁছেও তিনি শাসক হযরত উসমানের বিরোধীতা করতে লাগলেন। হযরত উসমানকে দেখতে পেলেই তিনি পবিত্র কুরআনের এই আয়াতটি পাঠ করতেন-
''...আর যারা স্বর্ণ ও রৌপ্য পুঞ্জিভূত করে এবং তা আল্লাহ'র রাস্তায় ব্যয় করে না তাদেরকে মর্মন্তুদ শাস্তির সংবাদ দাও। সে দিন জাহান্নামের আগুনে তা উত্তপ্ত করা হবে এবং তা দ্বারা তাদের ললাট, পার্শ্ব এবং পৃষ্ঠদেশে দাগ দেওয়া হবে। সেদিন বলা হবে, এটিই সেই (জিনিস) যা তোমরা নিজেদের জন্যে পুঞ্জিভূত করতে।'' [আল-কুরআন, ৯ঃ ৩৪-৩৫]
এক পর্যায়ে, হযরত মুয়াবিয়া হযরত আবু যরকে মদিনা থেকে বের করে দেওয়ার নির্দেশ দেন। সেই সাথে বলে দেন, তাঁর যাওয়ার সময় কেউ যেন তাঁকে বিদায় জানাতে না আসেন। কিন্তু, হযরত মুয়াবিয়ার কথা অমান্য করে হযরত আলী (আ), হযরত হাসান (আ), হযরত হুসাইন (আ), হযরত আকীল (রাঃ), হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে জাফর (রাঃ) এবং হযরত আম্মার ইবনে ইয়াসির (রাঃ)- এই ৬ জন বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব হযরত আবু যর (রাঃ)-কে বিদায় সংবর্ধনা দিতে আসেন। সেই সমাবেশে হযরত আলী (রাঃ) বলেন-
''হে আবু যর। তুমি আল্লাহর নামে ক্রোধ দেখিয়েছিলে। সুতরাং, যার উপরে রাগান্বিত হয়েছিলে, তার বিষয়ে আল্লাহতে আশা রেখো। মানুষ তাদের জাগতিক বিষয়ের জন্যে তোমাকে ভয় করতো, আর তুমি তোমার ইমানের জন্যে তাদেরকে ভয় করতে। কাজেই, তারা যেজন্যে তোমাকে ভয় করে তা তাদের কাছে রেখে দাও আর তুমি তাদেরকে যেজন্য তাদেরকে ভয় করো তা নিয়ে বেরিয়ে পরো। যে বিষয় হতে তুমি তাদেরকে বিরত করতে চেয়েছিলে, তাতে তারা কতই না আসক্ত এবং যে বিষয়ে তারা তোমাকে অস্বীকার করেছে উহার প্রতি তুমি কতই না নির্লিপ্ত। অল্পকাল পরেই তুমি জানতে পারবে আগামীকাল (পরকালে) কে বেশি লাভবান আর কে বেশি ঈর্ষনীয়। এমনকি সমগ্র আকাশ ও পৃথিবী যদি কারো জন্য রুদ্ধ হয়ে যায় এবং সে যদি আল্লাহকে ভয় করে, তবে আল্লাহ তার জন্যে তা খুলে দিতে পারেন।
শুধু ন্যায়পরায়নতা তোমাকে আকর্ষণ করে এবং এবং অন্যায় তোমাকে বিকর্ষন করে। যদি তুমি তাদের জাগতিক বিষয়ের প্রীতি গ্রহণ করতে, তাহলে তোমাকে তারা ভালোবাসতো এবং যদি তুমি তাদের সাথে তাতে অংশগ্রহণ করতে, তবে তারা তোমাকে আশ্রয় দিতো।''
আর, এভাবেই, মদীনা থেকে বের করে দেওয়া হয় হযরত আবু যর (রাঃ)। তিনি তাঁর স্ত্রী-সহ মরুভূমিতে জীবিকার সন্ধানে যখন ঘুরে বেরাচ্ছিলেন, একটু বিশ্রামের জন্যে মরুভূমিতে একটি গাছও খুঁজে পাচ্ছিলেন না, তখন, মৃত্যু তাঁর কাছে এসে দাঁড়ায়। সেই সময়ে তিনি তাঁর স্ত্রীকে বলেন-
''বিচলিত হয়ো না। রাসূল (সাঃ) বলেছেন আমার অসহায় অবস্থায় মৃত্যুবরণ হবে এবং কয়েকজন ইরাকী আমাকে দাফন-কাফন করবে। আমার মৃত্যুর পর আমাকে চাঁদরে ঢেকে রাস্তার পাশে বসে থেকো এবং কোন যাত্রীদল যেতে থাকলে তাদেরকে বলবে- রাসূলের প্রিয় সাহাবী আবু যর মারা গিয়েছে।''
সর্বশেষ এডিট : ১৪ ই মে, ২০২২ রাত ৯:৪৫