ভালবাসা অনুভূতিটা আসলে কেমন? হাজারো মানুষের ভিড়ে কোন মানুষ কে হঠাৎ করে অন্য রকম লাগা। তার জন্য বুকের গভীরে কেমন কেমন অনুভূতি। মনে হয় যেন, "এই সেই মানুষ যাকে আমার করে চাই। এই মানুষটাকে ছাড়া জীবনে সব প্রাপ্তির মাঝেও শূন্যতা। মনে হয় যেন সারা পৃথিবীর বিনিময়ে তাকেই চাই।"
এমন অনুভূতি কতোদিন বুকের অলিন্দে জমিয়ে রাখতে পারবেন। এক বছর। এক যুগ। শুধু একটা মানুষের জন্য তীব্র ভালবাসা। ভালবাসার পূর্ণতা হয় বিয়েতে। এক সাথে একই ছাদের নিচে থাকা। পাশ ফিরলেই সেই মানুষকে দেখতে পাওয়া। হাত বাড়িয়ে ছুঁতে পারা। হঠাৎ বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে হাত ধরা। একটা ফুল নিয়ে এসে তার চুলে গুঁজে দেওয়া। গোসলের পরে তার ভেজা চুল আঁচড়ানো দেখা। কথা গুলো হয়তো একটু বেশি কাব্যিক। বাদ দিলাম সব। বাস্তবতায় চলে আসি। অফিস থেকে ফিরলেন। কেউ আপনার জন্য টেবিল সাজালো। বিদ্যুৎ বিল, ছেলেমেয়ের টিউশন ফি, বাসা ভাড়া সব নিয়ে কথা বলা। কিন্তু সবচেয়ে বড় কথা যতো যাই হোক দুইজনে এক সাথেই থাকা। সুখ দুঃখ যাই থাকুক ভালবাসার মানুষকে চোখের সামনে দেখতে পাওয়া।
কিন্তু হাজার হাজার মাইল দূরে থাকে যদি আপনার ভালবাসার মানুষ। যাকে কখনো নিজের চোখে দেখেন নাই। হাত ছুঁয়ে গল্প করতে পারেন নাই। সেই মানুষের জন্য কতোদিন ভালবাসা বুকে আগলে রাখতে পারবেন?
পত্রমিতালী দিয়ে পরিচয় হাজার মাইল দূর জাপানের মিয়াগির সাথে স্নেহময়ের। চিঠিতে চিঠিতে সম্পর্ক গড়ায় প্রেমে। একজন আরেকজন কে এটা ওটা উপহার পাঠায়। হঠাৎ করে ফোনে কল। ইংরেজি তে কথা বলতে গিয়ে শব্দ খুঁজে না পাওয়া। কথাও পরিষ্কার না শোনা। তবুও কতোনা প্রাণ ছুঁয়ে যায় ওদের ভালবাসা দেখে। সামান্য এক স্কুল মাস্টার স্নেহময়। প্রায় প্রত্যন্ত এক গ্রামে থাকে সে। এক সময় ওরা চিঠি লিখেই বিয়ে করে। মিয়াগি আংটি পাঠায়। স্নেহময় পাঠায় শাখা। কতো গভীর ভালবাসা মানচিত্রের দুই প্রান্ত থেকে জীবনের সুতোয় সংসার বুনে যায় দুই জনে। সময় গড়ায় গড়াতেই থাকলো। ওদের বিয়ের ১৫ বছর পূর্ণ হলো। ভাবতে পারেন এই ১৫ বছরে মাত্র তিনবার ফোনে কথা হয়। ৬০০ এর উপরে চিঠি আদান প্রদান হয়। জাপানী রীতি অনুযায়ী বিয়ের ১৫ বছর হওয়ায় মিয়াগি তাঁর স্বামীর জন্য বিশাল এক বক্স করে অনেক গুলো কাগজের ঘুড়ি পাঠায়। জাপানের ঐতিহ্যবাহী ঘুড়ি। স্নেহময় পাঠায় ফুল।
একসময় মিয়াগির ধরা পরে ক্যানসার। অনেক দিন থেকেই অসুস্থ থাকে সে। প্রথম দিকে জানতে পারেনা কি অসুখ। স্নেহময় তবুও যতোটুকু শুনেছে সেভাবে ওর জন্য ওষুধ পাঠায়। মিয়াগি সবই খুব যত্ন করে খায়। স্নেহময় খুব দুশ্চিন্তায় থাকে স্ত্রী কে নিয়ে। চাকরী থেকে ছয় মাসের ছুটি নেয়। এখানে ওখানে যায় রোগের ওষুধের জন্য।
এক ঝরের রাতে ভিজতে ভিজতে বাড়ি ফেরে স্নেহময়। বৃষ্টি বাদল মাথায় নিয়েই সে এক ক্যানসার স্পেশালিষ্ট এর কাছে যায়। কিন্তু বৃষ্টিতে ভিজে নিউমোনিয়া বাধিয়ে ফেলে। গ্রামের সবাই জানে স্নেহময় মানে মাস্টার সাহেবের জাপানী বউয়ের কথা। প্রায় সময় বিভিন্ন জিনিস চিঠি পত্র আসতো বলে। শুধুমাত্র একজন কে ভালবেসে তাকে চোখের দেখায় না দেখেও দুইটা মানুষ কি প্রচণ্ড ভালবাসায় জীবনের সেরা সময় গুলো পার করে গেল। ভালবাসার সাথে যৌনতার অনেক বড় একটা সম্পর্ক আছে। কিন্তু ওদের মাঝে এই ব্যাপারটা ঘটার কোন সম্ভাবনাই ছিলোনা। এটা যেন ওদের কাছে কোন মূখ্য কিছুই নয়। শুধু ভালবাসাই যেন ওদের কাছে সবকিছু। আমায় যদি কেউ বলে এভাবে কি কোন সম্পর্ক রাখতে পারবো কিনা। আমি বলবো- না। কখনোই সম্ভব না আমার পক্ষে এতোটা গভীর করে কোন মেয়েকে ভালবাসা। এতোটা মানুষিক শক্তিও আমার নাই। যা আছে স্নেহময় আর মিয়াগির। মেয়েদের কথা জানি না। কিন্তু কেন যেন মনে হয়, একটা মেয়ের ভালবাসা ঠিকই এমনই হয়। যৌনতা প্রাকৃতিক নিয়মেই সবার প্রয়োজন। কিন্তু মেয়েরা অন্যভাবে ভালবাসতে পারে। কোথায় যেন পড়েছিলাম, একটা মেয়ে যেখানে ভালবেসে মন দিতে পারে সেখানে শরীরটা দেওয়া তার কাছে কিছুই না। কিন্তু ৯৯ ভাগ পুরুষ ই শরীরটাই চায়। অস্বীকার করবোনা আমিও ৯৯ ভাগেই পরি। এই জন্যই এই স্বর্গীয় অনুভূতির প্রেম আমার জন্য নয়। আর স্নেহময় সেই ১ ভাগের মানুষ যে জানে ভালবাসা কি। কতোটা যত্ন তাকে বাঁচিয়ে রাখা যায়।
বিধাতার হিসাব আমরা ঠিক বুঝি না। নিউমোনিয়ায় মারা গেল স্নেহময়। মিয়াগির জন্য সহজ সরল প্রত্যন্ত এক গ্রামের সামান্য স্কুল মাস্টার যেই ভালবাসা ধারণ করে ছিলো তা আসলে ভাষায় প্রকাশ করাটাও দুর্বোধ্য। ঠিক একই রকম ভালবাসাও ধারণ করেছিল মিয়াগি। স্বামীর মৃত্যুর পরে ক্যানসারের রুগি মিয়াগি দেশে আসলো। ঠিক বাংগালী বিধবা নারীর মতো সাদা শাড়ি পরে। ক্যানসারের কারণে চুল পরে যায় তার। গ্রামের মানুষ মিয়াগিকে দেখেই বুঝতে পারে কোন বাড়িতে সে যাবে। মিয়াগির জানা ছিল না হয়তো বিধবা মেয়েরা হাতের শাখা খুলে ফেলে। বিধবা সাজে তার হাতে শাখা ছিল। যেটা তার বৈবাহিক অধিকার বলেই মনে হয়েছে আমার। স্নেহময়ের ঘরে এসে দেখতে পেলো তার দেওয়া সব কিছুই খুব যত্নে রাখা আছে। স্নেহময় কে ওর বুনে দেওয়া মোজা গুলোও। কতোটা ভালবাসা বুকে লালন করতে পারলে এভাবে দুজন দুজনের হয়ে থাকা যায় আমার জানা নেই।
এই সিনেমার অনেক কিছুই আমি ইচ্ছে করেই বলিনি। অনেক চরিত্রের কথাই। শুধু মানুষ দুটোর প্রচণ্ড ভালবাসার কথাই বললাম। যারা দেখেননি তাদের জন্য অনুরোধ থাকলো দেখার জন্য। যদিও পুরো সিনেমার সবকিছুই বলে দিয়েছি। সবকিছু জানার পরেও আমার বিশ্বাস আপনাদের দেখে এতোটুকু খারাপ লাগবেনা। পছন্দের সিনেমা কিন্তু আমরা বারবার দেখি। অর্পণা সেন খুব দুর্দান্ত এক সিনেমা বানিয়েছেন। পছন্দের সিনেমার তালিকায় যোগ হলো আরো একটি ভাল সিনেমা।
যারা দেখেন নাই তাদের জন্য ইউটিউব লিংক:
https://youtu.be/oCSkfqn5Gos
সর্বশেষ এডিট : ১৩ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৭ রাত ১:৫৬